অল্প বয়সেই কাবু হচ্ছে হৃদয়! যৌবনেই কেন বারবার নেমে আসছে প্রাণঘাতী হার্ট অ্যাটাক?
Young Age Heart Attack : সময় পাওয়ার আগেই সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। কেন যুবসমাজ এত বেশি সংখ্যায় এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে?
মাত্র কয়েকদিন আগের কথা। প্রাক্তন বিশ্বসুন্দরী ও অভিনেত্রী সুস্মিতা সেনের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টের একটি পোস্ট সবাইকে চমকে দেয়। এমনিতে ৪৭ বছর বয়স হলেও ফিটনেসের দিক থেকে এতটুকুও কমতি রাখেননি সুস্মিতা। ব্যায়াম আর পরিমিত খাদ্যাভ্যাসই তাঁর রোজকার রুটিন। সেই সুস্মিতা সেনই ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হলেন! পরীক্ষায় দেখা যায়, তাঁর মহাধমনীর প্রায় ৯৫ শতাংশে ব্লকেজ রয়েছে। তারপর শুরু হয় চিকিৎসা।
শুধু এটাই নয়। ২০২২-এ উত্তরপ্রদেশের কানপুরের একটি ঘটনাও সবাইকে চমকে দিয়েছিল। ১৬ বছরের অনুজ পাণ্ডে, স্থানীয় স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। ডিসেম্বর মাসে বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলছিল। হঠাৎই তার তীব্র বুকে ব্যথা শুরু হয়। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে যায় অনুজ। তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলেও শেষরক্ষা হয়নি। চিকিৎসকরা মৃত বলে ঘোষণা করেন। কারণ হিসেবে বলা হয়, হার্ট অ্যাটাক! বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর।
একটু খোঁজ নিলেই দেখা যাবে, আমাদের আশেপাশে এরকম মৃত্যুর সংখ্যা প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে। ২০২২-র শেষে ভারতে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্তের সংখ্যা এত বেড়ে যায় যে, ডাক্তাররাও চিন্তায় পড়ে যান। ষাটোর্ধ্ব মানুষরা তো আক্রান্ত হচ্ছেনই; সেইসঙ্গে অল্প বয়সিদের মধ্যে হৃদরোগের সম্ভাবনা আরও প্রবল হচ্ছে। ২৫ থেকে ৪৪ – এই বয়সের মানুষজনের শরীরে নীরবে নেমে আসছে হার্ট অ্যাটাক। ঠিকঠাক সময় পাওয়ার আগেই সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। কেন যুবসমাজ এত বেশি সংখ্যায় এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে?
আরও পড়ুন : উচ্চ রক্তচাপ মানেই মৃত্যুর হাতছানি, ভারতে হু হু করে বাড়ছে হৃদরোগের ঝুঁকি
২০২২ সালে আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেসের সেডারস-সিনাই মেডিকেল সেন্টার একটি সমীক্ষাআর আয়োজন করে। সেখানে দেখা যায়, ২৫-৪৪ বছর বয়সিদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের মাত্রা আগের তুলনায় অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। আগের থেকে সেই হৃদরোগ আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে ২৯.৯ শতাংশ! আর ভারতে এই সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ শতাংশ। অর্থাৎ, পৃথিবী জুড়েই হার্ট অ্যাটাক নিজের থাবা আরও মজবুত করছে। ডাক্তাররা বলছেন, সবচেয়ে বেশি হচ্ছে সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাক। খানিকটা নীরবে, আচমকা আমাদের শরীরে হানা দিচ্ছে এই রোগ। আর যখন আসছে, সব শেষ করে দিয়ে চলে যাচ্ছে।
কেন অল্প বয়সিরা হৃদরোগে ভুগছেন?
অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, দুশ্চিন্তা, স্ট্রেস, সিগারেট-মদ্যপান ইত্যাদি নানা কারণ তো রয়েইছে। সেইসঙ্গে রয়েছে স্থূলতা। তবে এর পাশাপাশি আরও বেশকিছু কারণ রয়েছে, যেগুলোর দিকে সচরাচর আমরা নজর দিই না।
১) কোভিড : ২০২০-র শেষ থেকে গোটা পৃথিবী সাক্ষী থাকে এই মারণ রোগের। সামান্য ক্ষুদ্র, আণুবীক্ষণিক একটি ভাইরাস, সেটাই গোটা বিশ্বের, মানবজাতির ত্রাস হয়ে উঠল। কয়েক কোটি মানুষ আক্রান্ত হলেন করোনায়, এক নিমেষে উধাও হয়ে গেলেন কয়েক লক্ষ মানুষ। হাহাকার আর মৃতদেহের ছবির সাক্ষী থাকল মানুষ। সেই করোনাই মানুষের শরীরের অনেক দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি করে দিচ্ছে। ডাক্তার এবং গবেষকরা বলছেন, মানবদেহের হার্টের পেশি ও করোনারি আর্টারিতে আঘাত হেনেছে এই ভাইরাস। ফলে আগের থেকে অনেকটাই দুর্বল হয়ে গিয়েছে মানব হৃদয়। তাই সামান্য একটু কিছু হলেই হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বাড়ছে।
আরও পড়ুন : সুস্মিতা সেনের হার্ট অ্যাটাক! কেন চরম ‘ফিট’ মানুষও আক্রান্ত হচ্ছেন হৃদরোগে?
২) ওয়ার্ক ফ্রম হোম : করোনা ভাইরাসের এই মহামারীর হাত ধরেই গোটা পৃথিবী দেখেছিল লকডাউন। আর সেখান থেকেই শুরু হয় ওয়ার্ক ফ্রম হোমের সিলসিলা। একটু একটু করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও সেই ওয়ার্ক ফ্রম হোম এখনও টিকে আছে অনেক জায়গায়। ফলে অফিস আর বাড়ির স্ট্রেস একসঙ্গে আঘাত হানছে মানুষের শরীরে ও মনে। সর্বক্ষণ এই পরিস্থিতি থাকলে হার্ট দুর্বল হতে বাধ্য।
৩) মানুষের অজ্ঞানতা : অনেক সময় একটু বুকে ব্যথা হলেই বাড়ির লোকেরা বলে, ও কিছু নয়। সামান্য গ্যাস থেকে এরকম হচ্ছে। ওষুধ খেয়ে নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিংবা বলা হয়, পেশিতে একটু টান ধরেছে, একটু সময় দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। এখানেই ভুল করেন অধিকাংশ মানুষ। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, বুকে ব্যথা হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া অবশ্য কর্তব্য। ডাক্তাররা বলছেন, বুকে ব্যথা বা ভারী ভাব, চোয়াল ও পিঠে সেই ব্যথা ছড়িয়ে পড়া, বাঁ হাতে ব্যথা, ঘাম – এসব লক্ষণ দেখলে এক সেকেন্ডও দেরি করা উচিত হবে না।
আরও পড়ুন : চুপি চুপি কেড়ে নিতে পারে জীবন, কেন এত বাড়ছে নীরবে হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতা?
৪) অত্যাধিক ব্যায়াম : বিগত কয়েক বছরে একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, অনেকেই রয়েছেন যারা জিম করতে করতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, সুস্মিতা সেনরা বেঁচে গিয়েছেন সেটা অত্যন্ত আশার কথা। কিন্তু সবার এমন ভাগ্য হয়নি। শরীরচর্চা করতে করতে আচমকা বুকে ব্যথা, ব্ল্যাক আউট, তারপর মৃত্যু – এমন বহু ঘটনার সাক্ষী থেকেছে মানুষ। তাই ডাক্তারদের মত, ব্যায়াম করা, জিমে যাওয়া অবশ্যই ভালো। প্রয়োজনীয়ও বটে। কিন্তু কখনই অতিরিক্ত স্ট্রেস নেওয়ার দরকার নেই। আর ডাক্তার ও উপযুক্ত ট্রেনারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা আবশ্যিক।
এসবের পাশাপাশি দুশ্চিন্তা, স্ট্রেস, অবসাদ যত কম আসে তত ভালো। হার্টকে আরও দুর্বল করে দেয় এসব। সামান্য এদিক থেকে ওদিক হলে শীঘ্রই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত। তা না হলে এই পরিসংখ্যান আরও ভয়ের দিকে যাবে।