দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছে ভারতীয় স্কুলপড়ুয়ারা! রোজ এই ভুল করছে আপনার সন্তানও?

Myopia Symptoms: যে সমস্ত ছেলেরা সাধারণ পড়াশোনার পাশাপাশি খুব গভীরভাবে ধর্মীয়শিক্ষার সঙ্গে লিপ্ত ছিল তাদের মধ্যে এই সমস্যাটি বেশি করে দেখা যেত।

ভারতীয় স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যে হু হু করে বাড়ছে মায়োপিয়ার ঘটনা। মায়োপিয়া, অর্থাৎ দূরের জিনিস দেখতে সমস্যা হওয়া। মজার বিষয় হলো, কোভিড মহামারীরর দাপট কমায় স্কুল যখন আবার চালু হল, তখন মায়োপিয়ার ঘটনা বেড়েছে আরও বেশি। এই মুহূর্তে স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে যে হারে মায়োপিয়ার ঘটনা দেখা যাচ্ছে, তাতে রীতিমতো সিঁদুরে মেঘ দেখছেন গবেষক ও চিকিৎসকরা। তাঁদের মতে এই অসুখটি ভবিষ্যতে জনস্বাস্থ্যকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করবে। তাঁদের আশঙ্কা ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ মায়োপিয়ার শিকার হবেন। মায়োপিয়ার কারণে কেবল স্বাস্থ্যের অবনতি হয় না, শিক্ষা ও চাকরিক্ষেত্রেও সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এ আমাদের সবারই প্রায় জানা।

মায়োপিয়া কেন হয়, সে নিয়ে নানা জনের নানা মত। কারও মতে মায়োপিয়া আদ্যোপান্ত জিনগত, কেউ দোষ দেন বেশি টিভি দেখাকে বা বেশি ইলেকট্রনিক গ্যাজেট ঘাঁটাকে। আবার কেউ বলেন, কম আলোয় পড়াশুনো করলে দূরের জিনিস দেখতে সমস্যা হতে পারে। মায়োপিয়া কী কী কারণে হতে পারে তলিয়ে দেখার আগে, প্রতিবেদনটি শুরু করা যাক বেশ কিছু ঘটনাকে সামনে রেখে।

১৯৯০ শতকের প্রথম দিকে গবেষকরা খুব গোঁড়া জিউশ শিশুদের উপর একটি পরীক্ষা করেন। দেখা যায়, যে সমস্ত ছেলেরা সাধারণ পড়াশোনার পাশাপাশি খুব গভীরভাবে ধর্মীয়শিক্ষার সঙ্গে লিপ্ত ছিল তাদের মধ্যে এই সমস্যাটি বেশি করে দেখা যেত। অথচ তাদের বোনেরা যারা স্বাভাবিকভাবেই ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে স্কুলের গণ্ডি পার হননি বা স্কুলের গণ্ডিতেই পা দেননি তাদের মধ্যে কিন্তু এই সমস্যাটা ছিল না। সেখান থেকে প্রশ্ন উঠতে থাকে, বিষয়টি কেবলই জেনেটিক বা বা জিনগত কিনা। নাকি তার সঙ্গে জীবনধারণেরও কোনও সম্পর্ক আছে? আবার দেখা যায়, যে সমস্ত শিশুরা গভীর পড়াশুনোর পাশাপাশি বাইরের প্রাকৃতিক আলোয় খেলাধুলোও করছে, অদ্ভুতভাবে তাদের মধ্যে মায়োপিয়ার হার তুলনামূলক ভাবে কম।

আরও পড়ুন- বিপদের নাম ‘লেজি আই’, সন্তানের দৃষ্টিশক্তি বাঁচাতে কী করবেন

তখন থেকে ধারণা হয়, দিনের আলোয় কম সময় কাটানো তো বটেই, পাশাপাশি একাধিক কারণ মায়োপিয়ায় শিকার হওয়ার নেপথ্যে থাকতে পারে। যেমন ধরা যাক, পড়াশুনো করা কিংবা নিখুঁত সূক্ষ্ম শৈল্পিক কাজ- যেগুলো খুব কাছ থেকে করতে হয়, যার ফলে চোখের উপর চাপ পড়ে, তার জন্যও মায়োপিয়া হতে পারে।

মায়োপিয়ার নেপথ্যে বেশ কিছু জিন দায়ী, অর্থাৎ বেশ কিছু ক্ষেত্রে এই রোগ যে জেনেটিক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু মায়োপিযার নেপথ্যে একাধিক আর্থ-সামাজিক বিষয়ও কাজ করে, যার উপর নির্ভর করে মানুষের দৈনন্দিন অভ্যাস, রোজনামচা চলে। অর্থাৎ আর্থ-সামাজিক বিষয় এবং দৈনন্দিন
অভ্যাস, এই দুইয়েরই তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে মায়োপিয়ার নেপথ্যে। বেশ কিছু বছরে আগেও যদি পিছিয়ে যাওয়া যায়, দেখা যাবে মায়োপিয়া বিষয়টি শহরাঞ্চল এবং শহরতলিতেই বেশি দেখা যেত। এখন গ্রামেও হু হু করে বাড়ছে মায়োপিয়ার ঘটনা। ২০২০ সালে প্রকাশিত একটি রিভিউ আর্টিকেল থেকে জানা যাচ্ছে, ভারতের শহরাঞ্চলে ৮.৫% স্কুলপড়ুয়াই মায়োপিয়ার শিকার। সেখানে গ্রামাঞ্চলে মায়োপিয়ার শিকার ৬ শতাংশেরও বেশি। দশ বছর আগেও গ্রামাঞ্চলে যা ছিল ৪.৬ শতাংশ।

প্রযুক্তিগত উন্নতি যেমন আর শহরেই সীমাবদ্ধ নেই, গ্রামেও শহরের মতোই সমানতালে ব্যবহার হয় মোবাইল বা ট্যাব, তার পাশাপাশি দ্রুত নগরায়নের বিষয়টিকেও উপেক্ষা করা যায় না। যার ফলে কেবল প্রযুক্তিরই ব্যপক ব্যবহার বাড়েনি, বাড়িতে বাড়িতে টিভি, কম্পিউটার আসায় কেবল বাচ্চারাদের প্রযুক্তি আসক্তিই বাড়েনি, দ্রুত নগরায়নের ডামাডোলে বাচ্চাদের খেলার মাঠগুলিও চুরি গেছে। ফলে প্রাকৃতিক আলোয় খেলাধুলো করার পরিসরগুলি ক্রমশ কমে এসেছে।

আরও পড়ুন- চোখে অন্ধকার, হাত পা অসাড়, রোজের জীবনেই লুকিয়ে ব্রেন স্ট্রোকের ফাঁদ! সতর্ক হবেন কীভাবে?

২০২২ সালে অফথ্যালমিক ফিজি়ওলজিক্যাল অপটিক্সে প্রকাশিত একটি গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, তামিলনাড়ুর স্কুলপড়ুয়া শিশুদের মধ্যে ১২ শতাংশই ভুগছে মায়োপিয়ায়। ২০২২ সালে 'ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত' একটি গবেষণাও বলছে, তামিলনাড়ু তো বটেই, কেরলেও শিশুদের মধ্যে মায়োপিয়ার হার ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলোর তুলনায় বেশি। এদিকে দেখা যাচ্ছে, কেরলে শিক্ষার হার সব থেকে বেশি। তামিলনাড়ুতেও বাড়ছে শিক্ষার হার।

গবেষকদের দাবি, জনগণের মধ্যে শিক্ষার হার বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে মায়োপিয়ার ঘটনা। মজার বিষয় হলো, এখানে শিশুদের মায়েদের শিক্ষার হারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দেখা যাচ্ছে, মায়েদের শিক্ষার হার বাড়ার পাশাপাশি বাড়ছে মায়োপিয়ার হারও। সেক্ষেত্রে মায়ের দেহে এপিজেনেটিক পরিবর্তনের ফলে শিশুরা জিনগতভাবে রোগটির শিকার হচ্ছে।

গবেষকরা জানাচ্ছেন, পড়াশুনোর পাশাপাশি যদি বাইরে প্রাকৃতিক আলোতে স্কুলপড়ুয়ারা বেশি সময় কাটায় তাহলে মায়োপিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমবে। তাঁদের দাবি বিগত চল্লিশ বছরে, ধীরে ধীরে মায়োপিয়া যেভাবে বেড়েছে, অভিভাবকদের এখনই শিশুদের স্বাস্থ্যের এই দিকটার প্রতি নজর দিতে হবে। শিক্ষা তো আর থেমে থাকতে পারে না। ক্রমান্বয়ে শিক্ষার হার বাড়বে, সেটাই কাম্য। কিন্তু তার পাশাপাশি প্রাকৃতিক আলোয় সময় কাটানো, খেলাধুলো করা, স্ক্রিনটাইম কমানো, এই বিষয়গুলির প্রতি আরও জোর দিতে হবে।

More Articles