'হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি' বন্ধ হয়ে গেলে কার অসুবিধা সবচেয়ে বেশি?
WhatsApp University: প্রথম দিন থেকেই এই সরকার যে কোনও ব্যর্থতার দায় নিতে চায়নি, উল্টে হোয়াটসঅ্যাপ হয়ে উঠেছে তাঁদের একমাত্র মাধ্যম, যা দিয়ে তাঁরা দেশের অধিকাংশ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে রাখতে পারেন।
হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধ হয়ে গেলে ভয়ানক বিপদ বহু মানুষের। ভারতীয় টাকার মান আমেরিকান ডলারের তুলনায় রোজ কমছে। গত সপ্তাহতেই আশির গণ্ডি পেরিয়ে সে তিরাশি ছুঁয়ে ফেলেছে। এর মধ্যে যদি হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধ হয়, তাহলে তো আরও বিপদ। বিরোধীরা যেমন প্রচার করছেন, টাকার মান কমলে কী কী বিপদ হতে পারে অর্থনীতির, সরকারের পক্ষ থেকে এই টাকার মান পতনে যে তাঁদের সরকারের খুব দায়িত্ব নেই, তার প্রচারও চলছে। এই সমস্ত প্রচার চলার মধ্যেই যদি হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে যাঁরা সরকারের হয়ে ওকালতি করছেন তাঁদের তো মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘা। সেই জন্য সরকারের পক্ষ থেকে হোয়াটসঅ্যাপ কর্তৃপক্ষের কাছে কৈফিয়ত তলব করা হয়েছে এই বিষয়ে।
যেহেতু বেশিরভাগ মানুষই অর্থনীতির কচকচানি বোঝেন না, তাই সবার আগে জানা দরকার সহজ করে, টাকার দাম পড়ে গেলে কী কী অসুবিধা হতে পারে? তারপরে আবার আসা যাবে হোয়াটসঅ্যাপের সঙ্গে বা সেই অর্থে বলতে গেলে সামাজিক মাধ্যমের সঙ্গে টাকার দাম পড়ার কী সম্পর্ক?
প্রথমত যে সমস্ত জিনিস আমরা বিদেশ থেকে আমদানি করি, যেমন অপরিশোধিত তেল, কীটনাশক, সার, বেশ কিছু ওষুধ, আয়রন ওর ইত্যাদি আমাদের বেশি দাম দিয়ে কিনতে হবে। বেশি দাম দিয়ে এগুলো কিনলে, আমাদের দেশে পেট্রল-ডিজেলের দাম বাড়ে, আর পেট্রল বা ডিজেলের দাম বাড়লে, পরিবহন খরচ বাড়ে, আর পরিবহন খরচ বাড়লে, খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ে। খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়লে, গরিব মানুষ হোক বা মধ্যবিত্ত মানুষজন প্রাথমিকভাবে তাঁদের নিজেদের দৈনন্দিন সাংসারিক খরচ কমানোর চেষ্টা করেন। ভোজ্য তেল থেকে শুরু করে রান্নার গ্যাসের দাম বাড়বে। যেহেতু সবারই পকেটে টান ধরে, তাই গরিব মানুষ আরও গরীব হবেন এবং মধ্যবিত্তও নিজেদের কপট অহংকার ছেড়ে আস্তে আস্তে আরও গরিব হওয়ার দিকে অগ্রসর হবেন। বহু মানুষ ব্যাঙ্কের থেকে ধার করে বাড়ি বানিয়েছেন বা ফ্ল্যাট কিনেছেন, কিংবা অনেকে হয়তো ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষার জন্যও ধার করেছেন, ভাবছেন বিদেশে থেকে ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষা শেষ হলে একটা স্বপ্নপূরণ হবে, তাঁদেরও থাকাখাওয়ার খরচ বাড়বে। যে ধার পাঁচ বছরে শোধ হওয়ার কথা, তা শেষ হতে আরও সময় লাগবে। বহু বেসরকারি সংস্থা তাঁদের কর্মী ছাঁটাই করবে, কারণ যদি সংস্থাকে আপাতত নিজেদের বাঁচাতে হয়, তাহলে কর্মী সংকোচন করা ছাড়া তাঁদের হাতে আর উপায়ন্তর থাকবে না। বেশ কিছু মানুষ হয়তো বিদেশ যাওয়ার কথা ভাবছেন আগামী দিনে, কিন্তু টাকার মান যত পড়বে ডলারের তুলনায়, তত বিমানের ভাড়া বাড়বে, ফলে স্বাভাবিকভাবেই যাঁরা ভাবছিলেন, তাঁরা দু’বার ভাববেন, এবং শেষে সেই ভাবনা পরিত্যাগ করবেন। অবশ্য যাঁরা পাকাপাকিভাবে বিদেশে বাস করেন, ডলারের তুলনায় টাকার দাম পড়লে তাঁদের উচ্ছ্বাসের যথেষ্ট কারণ আছে। যাঁরা এদেশে টাকাও পাঠান, তাঁরা কম ডলার পাঠালে, একই পরিমাণ টাকা পাঠানোও হবে। সেই জন্যেই বিদেশের মাটিতে বসবাসকারী ভারতীয়রা দেশের এখনকার প্রধানমন্ত্রী, বিদেশে গেলেই দুহাত তুলে তাঁকে অভিবাদন জানান। সেই জন্যেই ‘হাউডি মোদি’র মতো অনুষ্ঠান ওই দেশের মাটিতে সংগঠিত করা খুব প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের কাছে।
আরও পড়ুন- কেন দু’ঘণ্টা থমকে হোয়াটসঅ্যাপ, আপনার ব্যক্তিগত ডেটার ক্ষতি হলো না তো?
এই সমস্ত বিষয়গুলো বুঝতে কিন্তু ‘সমগ্র অর্থনীতি’ বা ‘সমগ্র রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকত্তোর হওয়ার প্রয়োজন নেই, এই সমস্ত বিষয়গুলো আমরা দৈনন্দিন জীবনচর্চা দিয়েই বুঝতে পারি কিন্তু সম্প্রতি আমাদের দেশের অর্থমন্ত্রী একটা অদ্ভুত যুক্তি দিয়েছেন এই টাকা এবং ডলার বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে, যা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বিস্তর হাসাহাসি চলছে। তিনি বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ডলার যদি শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং সেই একই সময়ে টাকার নিজস্ব শক্তি যদি অপরিবর্তিত থাকে কিংবা যদি টাকাও শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি ডলার আরও গুরুত্ব বাড়িয়ে ফেলে, তাহলেও টাকার বিনিময় মূল্য বা মান কমতে পারে। যদিও তিনি তাঁর মতোন করে যুক্তি সাজিয়েছেন কিন্তু তাঁর যুক্তিতে একটা বড়ো ফাঁক রয়ে গেছে- টাকা ছাড়াও সারা দুনিয়ায় আরও অনেক মুদ্রা রয়েছে যাঁদের বিনিময় মূল্যও ডলারের সাপেক্ষেই নির্ধারিত হয়। যদি শুধু ডলারই শক্তিশালী হতো, তাহলে অন্য মুদ্রাদের উপর কি এর প্রভাব পড়ত না?
জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী হয়তো এই হিসেবটা করে দেখেননি, বা বলা ভালো অর্থনীতির স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী অর্থমন্ত্রী সম্ভবত ভেবেছেন যে, তিনি দেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করলেও গত আট বছরে বেশিরভাগ মানুষ একটাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে থাকেন, এবং তা হলো ‘হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়’ যেখান থেকে শুধু ভুল তথ্যই প্রচার করা হয়, যেখান থেকে শুধু মানুষকে গুলিয়ে দেওয়াই হয় এবং তাই তিনিও বিষয়টিকে আরও গুলিয়ে দিয়েছেন। সেই জন্যই দু’ঘণ্টার জন্য সাইবার হানা বা অন্য যে কোনও কারণে হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধ হলে, তাঁদের যে তুমুল অসুবিধা তা তাঁরা বিলক্ষণ জানেন। একমাত্র পাকিস্তান এবং অর্থনৈতিকভাবে চরম টালমাটাল অবস্থায় থাকা শ্রীলঙ্কা বাদে বেশিরভাগ দেশের তুলনায় টাকার মূল্যমান হ্রাস কিন্তু উদ্বেগজনকভাবে বেশি। গতবছর ৩১ ডিসেম্বরে টাকার দাম ছিল ডলারের তুলনায় ৭৪.৪ আর এই বছরের অক্টোবর এখনও শেষ হয়নি, এখনই তাঁর মূল্য ৮৩ টাকা। এই হ্রাস যদি শতাংশে হিসেব করা যায় তা প্রায় ১২ শতাংশের কাছাকাছি, অথচ এই একই সময়কালে ইন্দোনেশিয়া, যেখানে সংখ্যাগুরু মানুষই মুসলিম ধর্ম পালন করেন, সেখাকার মুদ্রা ‘রুপিয়া’র পতন কিন্তু ১০ শতাংশের নিচে। ব্রাজিল বা মেক্সিকোর মুদ্রার পতনও কিন্তু ডলারের তুলনায় ৫ শতাংশের নিচে। পাশাপাশি থাই ভাট এবং ফিলিপিন্সের পেসোর পতন হয়তো এই সময়কালেই ১৫ শতাংশের কাছাকাছি, কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপে যেভাবে বেছে বেছে এই দেশের মুদ্রার মানের পতন দেখানো হচ্ছে, সেটা অর্ধসত্য, আর কে না জানে অর্ধসত্য মিথ্যের থেকেও ভয়ঙ্কর।
আরও অনেক মেসেজ আসছে এই সামাজিক মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে, যা দেখলে বা পড়লে মনে হবে, ভারতের টাকার মান তো ইউরো বা ইংল্যান্ডের পাউন্ডের তুলনায় কম পড়েছে কিন্তু একটা কথা সযত্নে ওই হোয়াটসঅ্যাপগুলোতে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা হলো ওই দেশগুলোতে রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের একটা সরাসরি প্রভাব আছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে কম। তাই যখন রোজ টাকার মূল্যমান পড়ছে, তখন হোয়াটসঅ্যাপ কিছুক্ষণ বন্ধ হলেই বিপদ! মানুষকে ভুল বোঝানোর এর চেয়ে ভালো মাধ্যম আর নেই। তবে ভুল বুঝিয়ে কি বেশিদিন রাখা যাবে?
আরও পড়ুন- গীতা ছুঁয়ে শপথ, ঋষি সুনককে কেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মানল ব্রিটেন
একদিকে ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান ক্রমশ নিচে নামছে, এমনকী পাকিস্তান ও বাংলাদেশের নিচে নেমে গেছে সেদিকে নজর নেই, অন্যদিকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করলেই, সামাজিক মাধ্যমের ছোট বড় নেতা, কর্মী-সমর্থকদের একটাই নিদান, “আপনারা সব দেশদ্রোহী, আপনারা পাকিস্তানেই চলে যান।” টাকার মূল্যমান হ্রাস বা ক্ষুধা সূচকে তলানিতে যাওয়া বা বিপুল পরিমাণ বেকারত্বের জন্য হয়তো একমাত্র অর্থমন্ত্রীই দায়ী নন, তার পিছনে আরও অনেক কারণ আছে কিন্তু প্রাথমিকভাবে দায় তো তাঁদেরই, যাঁরা এই মুহূর্তে দেশ শাসন করছেন। সেই দায় ঝেড়ে ফেলে গত সত্তর বছরের কংগ্রেস শাসন এবং মূলত দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুকে দায়ি করে হোয়াটসঅ্যাপে অর্ধসত্য বার্তা তৈরি করে পাঠালেই তো আর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না। যেকোনও প্রকারে দায় অস্বীকার করাই যেন এই সরকারের কাজ, কিন্তু দায় না নিলে তো তার থেকে বেরনোর উপায়ও বের করা যায় না।
২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর যখন নোটবন্দি ঘোষণা করা হয়েছিল তখন বলা হয়েছিল, দেশের মধ্যে যত কালো টাকা আছে, তা এই পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে উদ্ধার হবে। তখন হোয়াটসঅ্যাপে এমন বার্তাও হয়তো অনেকে পেয়েছেন, যে দু’হাজার টাকার নোটে এমন একটি প্রযুক্তি লাগানো আছে যাতে কোনও মানুষ যদি সেই টাকা মাটির নিচেও লুকিয়ে রাখেন তাহলেও জানা যাবে কোথায় তা লুকিয়ে রাখা আছে। পরে যখন দেখা গেল, সমস্ত টাকাই ব্যাঙ্কে ফিরে এসেছে, তখন তাঁরা বলতে শুরু করলেন যে নোটবন্দির উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। আজও দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এই নোটবন্দি সংক্রান্ত জনস্বার্থ মামলা চলছে। অথচ এই নোটবন্দির জন্য, টাকা বদল করতে গিয়ে যে বহু মানুষ মারা গেলেন, তার দায় কে নেবে?
আসলে প্রথম দিন থেকেই এই সরকার যে কোনও ব্যর্থতার দায় নিতে চায়নি, উল্টে হোয়াটসঅ্যাপ হয়ে উঠেছে তাঁদের একমাত্র মাধ্যম, যা দিয়ে তাঁরা দেশের অধিকাংশ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে রাখতে পারেন। তাই সেই মাধ্যম বন্ধ হলে, সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় তাঁরাই পড়েন। যখন নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসেননি তখন থেকেই একটা প্রচার চালানো হয়েছিল, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ একজন অক্ষম মানুষ, একমাত্র নরেন্দ্র মোদির মতো শক্তিশালী মানুষই পারেন ডলারের তুলনায় টাকার দামকে চল্লিশে নিয়ে যেতে। সেই সময়ে ডলারের তুলনায় টাকার মান ছিল ষাট-বাষট্টির মতো। তখনও টাকার মানের একটা পতন হচ্ছিল, আর বলিউডের বেশ কিছু শিল্পীরা রোজ সামাজিক মাধ্যমে এই টাকার পতন নিয়ে টুইট করছিলেন যা হোয়াটসঅ্যাপ মারফৎ ছড়ানো হচ্ছিল সচেতন ভাবে। তখন খুব সচেতনভাবে একটা দৃশ্যকল্প তৈরি করা হচ্ছিল যে, নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এলেই ’আচ্ছে দিন’ আসবে। সে স্বপ্ন যদিও আজ ঘোর বাস্তব, সে স্বপ্ন আজ বড় একটা দুঃস্বপ্ন, যদিও সেই স্বপ্নের ফেরিওয়ালারা আজ মুখে কুলুপ এঁটেছেন কিন্তু অর্ধসত্য এবং মিথ্যে দিয়ে তৈরি করা মেসেজ আজও বিতরণ করা হচ্ছে, কারণ শাসক দল বুঝে গিয়েছে যে দেশের অধিকাংশ জনগণ নির্বোধ, এবং তাঁদের যা বোঝানো যায়, তাঁরা তাই বুঝবেন। কিন্তু কতদিন?