অধীর-সেলিম না ধুপগুড়ি — কে 'ভেঙে' দিল ইন্ডিয়া জোট?
INDIA Block : শোনা যাচ্ছে যে, আসন সমঝোতা নিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তথা তৃণমূলের ফর্মুলা শুনে রাহুল গান্ধী তাতে বিশেষ পাত্তা দেননি।
না, এখনই যে ভারতের বিরোধী দলগুলির 'ইন্ডিয়া' জোটের দফারফা হয়ে গেছে, এমন দাবি করা যাবে না ঠিকই। কিন্তু এই জোটের আকাশে যে কালো মেঘ জমছে, আকাশের মুখ যে ভার হয়ে আসছে, সে কথা বলাই যায়। যে জোটের নামকরণের ভয়ে কেন্দ্রের শাসক দল দেশের নাম থেকে ইন্ডিয়া সরিয়ে দিয়ে শুধুই ভারত রাখতে চায়, সেই জোটের এমন অবস্থা বোধহয় হওয়া উচিত ছিল না। কিন্তু দু’টি বিষয় ইন্ডিয়া জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে জনগণকে হতাশ করতে পারে।
এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, ইন্ডিয়া জোট একটি অসাধ্য সাধন করতে নেমেছে। ভারতের তথাকথিত বিজেপি-বিরোধী বিভিন্ন আঞ্চলিক দলগুলিকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসার চেষ্টা হচ্ছে এই জোটের মাধ্যমে। এদের মধ্যে অনেকেই নিজেরা একে অপরের বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়াই করে। তবুও পটনা ও বেঙ্গালুরুর বৈঠক পর্যন্ত ঠিক ছিল। তাল কাটা শুরু হলো মুম্বইয়ের বৈঠকেই। তারপরে দিল্লিতে জোটের সমন্বয় কমিটির বৈঠক থেকে যে নির্যাস বেরিয়েছে তাতে বোঝা গেছে এ দেশের বিরোধীরা নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল মারতে কতটা ভালোবাসে।
মোদি নয়, বিজেপি-আরএসএস বিরোধী একটি ন্যারেটিভ তৈরির চেষ্টা কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী করতে চাইছেন অনেকদিন ধরে। তাতে বুঝে বা না বুঝেই হোক বা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই হোক, ইন্ডিয়া জোটের শরিকরা রাহুল গান্ধীর সেই চেষ্টাতেই সামিল হয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ করে কয়েকজন বাছা বাছা খবর সঞ্চালকের শো বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ইন্ডিয়া জোটের সমন্বয় কমিটি আসল লক্ষ্য থেকে নিজেদের এবং জনগণের দৃষ্টিই সরিয়ে দিল।
এটা ঠিক যে, এই সঞ্চালকদের মধ্যে বেশিরভাগই সরকার পক্ষের ঝোল টেনে নিজেদের অনুষ্ঠান করেন। বিদ্বেষও ছড়িয়ে থাকেন বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে। বিরোধী দলের মুখপাত্রদের ঠিক করে কথা বলতে দেন না। কিন্তু মনে রাখতে হবে এখনও পর্যন্ত এই সঞ্চালকরা বিরোধী দলের মুখপাত্রদের তাঁদের অনুষ্ঠানে ডাকা বন্ধ করেননি।
আরও পড়ুন- INDIA-র মুখ কে? আদর্শ দিয়ে কতটা লড়াই সম্ভব মোদির বিরুদ্ধে?
'যে বেশি চেঁচাবে তার কথাই শোনা যাবে'— এই তত্ত্বেই যখন গোটা মিডিয়া (সামাজিক মাধ্যমসহ) ব্যবস্থা চলছে, তখন 'আমি আর চেঁচাতে পারছি না' বলে রণক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে আসব, তা কখনও হতে পারে না। ব্যক্তিগত স্তরে তাও হতে পারে। কিন্তু যাঁরা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে চান, তাঁরা এই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে পারেন না।
অনেকেই বলতে পারেন, সামাজিক মাধ্যমই যখন আছে, তখন আর এই টিভি চ্যানেলগুলির দরকার কী! ভুলে গেলে চলবে না যে, গণতান্ত্রিক পরিবেশে সবরকম সংবাদ মাধ্যমের সঠিক ব্যবহার করাই রাজনৈতিক দলগুলির কর্তব্য। নয়তো খবরের বুদ্বুদ তৈরি হবে আরও বেশি করে। দেশের নাগরিকেরা দু'পক্ষের বক্তব্য একসঙ্গে শোনার সুযোগ পাবেন না।
একদিকে যেমন তথাকথিত 'গোদি মিডিয়া' এক ধরনের খবরের বুদবুদ তৈরি করছে, অন্যদিকে সামাজিক মাধ্যমেও কিছু সাংবাদিক অন্য ধরনের বুদবুদ তৈরি করছেন। পুরো চিত্রটা কেউই দেখাতে চাইছে না। যার যে পক্ষকে ভালো লাগবে, সে সেই বুদবুদে ঢুকে যাবে। ভারতের গণতন্ত্রের পক্ষে এটা কোনও সুখবর নয়। এটাও এক ধরনের বিদ্বেষ ছড়ানো। যে জোটের নেতা 'ভালোবাসার দোকান' খোলার ডাক দিচ্ছেন, সেই জোটের এমন সিদ্ধান্ত পরস্পরবিরোধী।
ফলে মূল রাজনৈতিক লড়াই থেকে সরে এসে একটি অন্য লড়াইয়ের ক্ষেত্র বা তা নিয়ে জলঘোলা করে ইন্ডিয়া জোটের নেতারা নিজেদের রাজনৈতিক অভিমুখই বদলে দিলেন।
অবশ্য এ ছাড়া আর করারই বা কী ছিল এই নেতাদের! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জোট নিয়ে যে তাড়াহুড়ো করছিলেন বলে অভিযোগ উঠছিল, সেটা নিয়ে তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। একটি জোটের প্রথম বৈঠকের তিন মাস পরেও তার কোনও অভিন্ন কর্মসূচি ঠিক হলো না। যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যা সেই আসন বন্টন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বলেও শোনা যাচ্ছে না। কোনও সমঝোতা না করে যে যার মতো করে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়বে এমন সিদ্ধান্তও জোটের নেতারা নিতে পারছেন না। সিপিআইএম কেরলে ও বাংলায় কী করবে তা নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। আম আদমি পার্টি পঞ্জাবে কংগ্রেসকে একটি আসনও ছাড়তে রাজি নয়। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের অবস্থান ঠিক কী হবে, তা নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান হয়নি এখনও পর্যন্ত।
বরং যেটা শোনা যাচ্ছে যে, আসন সমঝোতা নিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তথা তৃণমূলের ফর্মুলা শুনে রাহুল গান্ধী তাতে বিশেষ পাত্তা দেননি। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী এখনও পর্যন্ত সিপিএমের সঙ্গ ছেড়ে তৃণমূলের হাত ধরতে রাজি নন (যদিও সেটা করলে তাঁর নিজের আসনটি অন্তত তিনি নিশ্চিত করতে পারেন)। সিপিএম এখনও পর্যন্ত কাকে ইন্ডিয়া জোটের সমন্বয় কমিটিতে পাঠাবে তাই ঠিক করে উঠতে পারেনি। এই সপ্তাহের পলিটব্যুরো বৈঠকে হয়তো ঠিক করবেন তাঁদের নেতারা। শরদ পওয়ার ঠিক ভাইপো অজিত পওয়ারের মতো বিজেপির হাত ধরে ফেলবেন না মহারাষ্ট্রের মহাজোটেই থাকবেন, তা নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে।
আরও পড়ুন- সুধীর থেকে অর্ণব- একবারে বাদ ১৪ জন! কেন গোদি মিডিয়াকে বয়কটের সিদ্ধান্ত জোট ইন্ডিয়া-র?
অন্যদিকে, যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনও দিন সনিয়া গান্ধীর নিচে কোনও কংগ্রেস নেতার সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা করতে রাজি হতেন না, তিনি রাহুলকে বাবা-বাছা করে যথেষ্ট রাজনৈতিক জোটের বার্তা দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে খুব একটা চিঁড়ে ভেজেনি বোঝাই যাচ্ছে। কাজেই মমতার গোঁসা হওয়া স্বাভাবিক।
আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও উত্তরবঙ্গে ধুপগুড়ি বিধানসভার উপনির্বাচনের জয়ের পরে বুঝে গেছেন, কংগ্রেসকে ছাড়াও বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বৈতরণী তিনি পার হতে পারবেন। তা সম্ভব হবে বিজেপির নিজেদের সংগঠনের অব্যবস্থার ফলেই। কাজেই তিনি স্পেন-দুবাইয়ে লগ্নি টানতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ইন্ডিয়া জোট থেকে তাঁর মন উঠে গেছে বলেই মনে হচ্ছে।
যেখানে ইন্ডিয়া জোটের অন্যতম প্রধান মুখই এখন জোটের থেকে মুখ ফিরিয়ে রয়েছেন, সেখানে এ জোটের অবস্থাও ২০১৯-এর ইউনাইটেড ইন্ডিয়া জোটের মতো না হয়ে যায়। একটি ব্রিগেড সমাবেশ ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি অন্ধ্রপ্রদেশ সফরের পরেই তিনি বুঝে যান, কেন্দ্র ছেড়ে তাঁর রাজ্যে মন দেওয়াই ভালো।
এবারে জোটের সলতে পাকানোর আগে ইতিমধ্যেই তিনি সেটাই করতে শুরু করেছেন।