১০ বছর দেশের মানুষের তথ্যই জানে না বিজেপি সরকার! জনগণনা না হলে আখেরে কার লাভ?

Census 2021 India: দেশে কত পরিযায়ী শ্রমিক রয়েছেন, সেই তথ্যও নেই। তাহলে সেই সমস্ত মানুষকে কীভাবে সরকারি পরিষেবা দেওয়া হবে, শুধুই আন্দাজ করে?

আজ থেকে তিন বছর আগে, কেন্দ্রীয় সরকার ভেবেছিল বেশ কিছু প্রশ্নমালা নিয়ে নাগরিকদের কাছে পৌঁছবে। খুব সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নমালা, যার উত্তর পাওয়া যেকোনও দেশের সরকারের পক্ষে খুব জরুরি। আপনার পরিবারে কতজন সদস্য? সেই বাড়িটি কাঁচা না পাকা? বাড়িতে কি নিজস্ব শৌচাগার আছে? নিজস্ব বাহন আছে? ইন্টারনেট সংযোগ আছে? বাড়ির মহিলারা কি সেই ইন্টারনেট ব্যবহার করেন? এইরকম কিছু প্রশ্ন। যদি খেয়াল করা যায়, ২০১১ সালেও এইরকম কিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে। এই প্রশ্নমালার উত্তরের মধ্যে দিয়ে সেই সময়ের সরকারের কাছে কিছু তথ্য এসেছিল যার মধ্যে দিয়েই সরকার জনগণনার ফলাফল পেশ করেছিল। প্রতি দশ বছর অন্তর এই ‘জনগণনা’ করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। ২০২১ সালে এই জনগণনা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু কোভিডের কারণে কাজটি এখনও অবধি করে ওঠা যায়নি। যদিও শুধু কোভিড নয়, এই কেন্দ্রীয় সরকার নাগরিকত্ব নিয়ে এমন আতঙ্ক জনমানসে ছড়িয়েছে যে, যাঁরা এই আদমশুমারি করবেন, তাঁরা অবধি বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের কাছে যেতে ভয় পাচ্ছেন। আর সাধারণ নাগরিকের একাংশও সরকারকে কোনও তথ্য দিতে ভয় পাচ্ছেন। অথচ এই তথ্য যদি না পাওয়া যায়, তাহলে গত দশ বছরে মানুষের কী আর্থসামাজিক পরিবর্তন হয়েছে, তা হিসেব করা সম্ভব হবে না। যদিও কোভিডের ভয় আপাতত কিছুটা স্তিমিত, তবুও ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে এই সরকার আপাতত জনগণনা করতে খুব বেশি উৎসাহী নয়, অন্তত ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচনের আগে তো নয়ই।

দেশের প্রধানমন্ত্রীকে আমরা মাঝে মধ্যেই দেখি দেশের উন্নয়ন বিষয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করতে। কখনও তিনি বলেন, দেশের প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে, আবার কখনও তিনি বলেন, ভারতে নাকি এই মুহূর্তে ৭৬ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, দেশের প্রতিটি বাড়িতে জল পৌঁছেছে এবং সমস্ত নাগরিকের বাড়িতে শৌচাগার আছে… ইত্যাদি। প্রতিটি কথাই অত্যন্ত রাজনৈতিক এবং প্রতিটি কথাই গুরুত্বপূর্ণ। এই কথা নিয়ে নানান বিতর্কও হয়। যাঁরা এই সমস্ত কিছু নিয়ে নিয়মিত চর্চা করে থাকেন তাঁরা বলে থাকেন, প্রধানমন্ত্রীর কথার মধ্যে অনেক কথাই বাড়িয়ে বলা বা অসত্য। কিছুদিন আগে তিনি বলেছিলেন, দেশের মানুষ নাকি আর খোলা জায়গায় মল মূত্র ত্যাগ করেন না, অথচ বাস্তবচিত্র অন্য কথা বলে। এখনও দেশের বেশিরভাগ মানুষের বাড়িতে জল অবধি পৌঁছয়নি, শৌচাগার তো দূর অস্ত।

আরও পড়ুন- ২০২৪ নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি বনাম কে? এখন থেকেই উত্তর খোঁজার চেষ্টায় বিজেপি বিরোধীরা

রাজস্থানে, জাফর ইকবাল বলে একজন মানুষকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মারার ঘটনা ঘটেছিল ২০১৭ সালে। তাঁর বাড়িতে সরকারি খরচে শৌচাগার বানানো হলেও, সেখানে জলের সংযোগ ছিল না। তাঁর স্ত্রী, সকালে উঠে, প্রাতকৃত্য সারতে গিয়েছিলেন কাছাকাছির মাঠে। পৌরসভার কিছু কর্মী সেই দৃশ্য দেখে ছবি তুলছিলেন যাতে সেই ছবি দেখিয়ে জনসমক্ষে তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে হেয় করা যায়। জাফর এই ঘটনার প্রতিবাদ করেন, ফলে পৌরসভার কর্মীরা তাঁকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মারেন। এই ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী যাই বলুন না কেন, তাঁর ‘স্বচ্ছ ভারত’ প্রকল্পের আসল চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই জনগণনার তথ্য না থাকলে, বাস্তবচিত্র ভিন্ন হলেও, প্রধানমন্ত্রীর করা এই সমস্ত দাবি নিয়ে কিছু বলাও যায় না। আগামীতে সরকারের পক্ষ থেকে কোন ধরনের নীতি নেওয়া উচিত, দারিদ্র দূরীকরণে কী করা বাঞ্ছনীয় সে বিষয়েও কোনও পদক্ষেপই করা যায় না।

১৮৮১ সালে ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে প্রথম জনগণনা হয়েছিল। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের ধারণা ছিল, যদি দেশের জনগণের তথ্য জানা যায় তাহলে শাসন প্রক্রিয়া অনেক সুবিধাজনক হতে পারে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে, ১৯৫১ সালের ৯ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম জনগণনার কাজ হয়। তারপর থেকে প্রতি দশ বছর অন্তর এই প্রক্রিয়া করা হয়ে থাকে। দেশের মধ্যে কাদের খাদ্যে ভর্তুকি পাওয়া উচিত, কোন শিশুরা মিড ডে মিল পাওয়ার যোগ্য, সেই খাতে শিশু প্রতি কত টাকা বরাদ্দ হওয়া উচিত, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে কত টাকা বরাদ্দ করবে সরকার পরবর্তী দশ বছরে, প্রভৃতি নীতি নেওয়ার জন্যেই জনগণনা করা হয়। শুধু এই সব প্রশ্নই নয়, আরও গভীরে গিয়ে কিছু তথ্য নেওয়া হয়, যার মধ্যে দিয়ে কোনও একটি পরিবারের আর্থিক অবস্থারও আন্দাজ পাওয়া যায়। সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, শিক্ষা এবং প্রযুক্তিকে কী চোখে দেখছেন একজন সাধারণ নাগরিক, কতজন সরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা করাতে ইচ্ছুক, সেই তথ্যই যদি না থাকে, তাহলে আগামীতে সরকার কীভাবে কোনও সিদ্ধান্তে আসবে? এই মুহূর্তে সরকারি যা কিছু খরচ করা হচ্ছে, তা ২০১১ সালের জনগণনার হিসেব দেখে একটু আধটু বদল করে নিয়ে করা হচ্ছে কিন্তু সেই হিসেব কোনওভাবেই সঠিক নয়, আন্দাজমতো।

আরও পড়ুন- দেশের মুখ গুজরাত আর বিজেপিই! কেন ধামাচাপা পড়ে গেল আপ ও কংগ্রেসের জয়?

তবে জনগণনা, না করা বা ক্রমশ পিছনোর একটা রাজনৈতিক দিকও আছে, যেটা অন্যতম একটি কারণ এই প্রক্রিয়া নিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কেন টালবাহানা করছে তার নেপথ্যে। মোদি সরকারের মাথায় ছিল, ২০২১ সালের জনগণনার পাশাপাশি, এনপিআর অর্থাৎ ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টারের কাজও সেরে রাখতে হবে। যেহেতু এই এনপিআর এনআরসি, অর্থাৎ ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন্সের প্রথম ধাপ, ফলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই অসমের উদাহরণ দেখে মানুষ আতঙ্কিত হয়েছিল। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, অর্থাৎ সিএএ পাশ করিয়ে কি শুধুমাত্র একটি বিশেষ ধর্মালম্বী মানুষকেই কোণঠাসা করতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার? এই সিএএ, এনআরসি এবং এনপিআর পরস্পর সম্পর্কযুক্ত, তাহলে জনগণনা করার সময়ে যদি মানুষ কোনও তথ্য দিতে অস্বীকার করেন, তখন তো জনগণনার কাজই ব্যহত হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক এখনও এই সিএএ আইনের ধারাগুলোই তৈরি করতে পারেনি। কিছুদিন আগে আবারও ৬ মাস সময় চাওয়া হয়েছে, তাহলে কীভাবে জনগণনার কাজ সম্পন্ন হবে তাই নিয়েও কি দ্বিধাগ্রস্ত তাঁরা?

যতই মুখে কেন্দ্র সরকার বলুক, তাঁরা ‘সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস’ নীতি নিয়ে চলেন, তাঁদের মাথায় সারাক্ষণ একটা বিভাজনের রাজনীতি কাজ করে। প্রধানমন্ত্রী থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কেউই এর বাইরে নন। যদি জনগণনা করে দেখা যায় মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হিন্দুদের চেয়ে কম, কিংবা গত দশ বছরে, হিন্দু জনসংখ্যা বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, তাহলে মুসলিম বিরোধী প্রচারের বেলুন ফুটো হয়ে যাবে। এই যে সারাক্ষণ মোবাইলে আসতে থাকা বিশেষ বিভেদমূলক বার্তা, সেই বার্তাও বন্ধ করে দিতে হবে। আগামী নির্বাচনও যে বিজেপি এই হিন্দু-মুসলমান বিভাজন নিয়েই লড়বে, তার ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দিয়েছেন। আগামী বছরের শুরুতে রামমন্দির উদ্ধোধন হবে বলে ঘোষণা করেছেন তিনি। তাই এখন যদি জনগণনার প্রক্রিয়া চালু হয়ে যায়, এবং তার ফল যদি প্রকাশ্যে আসে, তাহলে উলটো পথে হাঁটা মুশকিল। আসলে সঠিক তথ্য কখনই এই সরকার দেয়নি। কোভিডের সময়ে কত মানুষ মারা গেছেন, তার তথ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। দেশে কত পরিযায়ী শ্রমিক রয়েছেন, সেই তথ্যও নেই। তাহলে সেই সমস্ত মানুষকে কীভাবে সরকারি পরিষেবা দেওয়া হবে, শুধুই আন্দাজ করে? জনগণনা বা আদমশুমারি হওয়া কেন জরুরি তা বোঝা গেলে সরকারকে চাপও দেওয়া যায় নানান বিষয়ে। রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজ এই চাপটুকু অন্তত দিক এখন।

 

More Articles