ফুটবল বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করে ভারত! নেপথ্যে যে কারণ
Football World Cup: শৈলেন মান্না জানিয়েছিলেন বুট একটি কারণ হলেও মূল কারণ নয়। ভারতের বিশ্বকাপ না খেলার মূল দু’টি কারণ হল- বিশ্বকাপের প্রতি উদাসীনতা এবং অর্থাভাব।
বর্তমানে ভারতের ফিফা র্যাঙ্কিং কত? উইকিপিডিয়া বলছে ১০৬। আপনি যখন এই প্রতিবেদনটি পড়ছেন তখন র্যাঙ্কিং বদলে গিয়েও থাকতে পারে। আমাদের বরাবরই একটা আফসোস থেকেই যায়, ১৪০ কোটির দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দেশে কি ১১ জন ভালো ফুটবলার নেই যারা বিশ্বকাপ পর্যন্ত নিয়ে যাবে আমাদের দেশকে। তবে ভাবলে অবাক হতে হয় বর্তমানে বিশ্ব ফুটবলে ১০০ র্যাঙ্কের পরে থাকা দেশ একবার প্রায় ফুটবল বিশ্বকাপ খেলেই ফেলেছিল। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলার সুযোগ পেয়েছিল আমাদের দেশ, ভারতবর্ষ। ১৯৫০ সালে ফুটবল বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায় ভারত। ফুটবল বিশ্বকাপে অন্যান্য মহাদেশেরগুলির তুলনায় বরাবরই এশিয়ান কোটা থেকে কম দেশ সুযোগ পায়। এহেন অবস্থায় ভারতের বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাওয়া নিঃসন্দেহে একটি গর্বের বিষয় ছিল দেশের কাছে।
তখনও সারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গভীর ক্ষতচিহ্ন৷ এরই মধ্যে খেলার মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে এবং সবাইকে সম্প্রীতির সুতোয় বাঁধতে ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনে উদ্যোগী হল ফিফা৷ এর আগে ১৯৪২ এবং ১৯৪৬-এর ফুটবল বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত করা যায়নি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে। ফলত ১৯৫০ সালে ফুটবলের এই মহাযজ্ঞের আয়োজন করতে কোমর বেঁধে নেমে পড়ে ফিফা। তবে যজ্ঞ করতে নামলেই তো হল না, যাজকেরও প্রয়োজন। ইউরোপ তখনও বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ইউরোপের সব দেশগুলি একযোগে অস্বীকার করল ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করতে। এই অবস্থায় এগিয়ে এল ল্যাটিন আমেরিকার একটি দেশ। কয়েক বছর পর এই দেশ থেকেই উঠে আসবেন পেলে।
অবশেষে, একপ্রকার বাধ্য হয়েই ফিফা অনুমোদন দিল ব্রাজিলে বিশ্বকাপ আয়োজন করার। এই প্রথম ইউরোপের বাইরে কোনও দেশে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। যুদ্ধ পরবর্তী সমস্যায় জর্জরিত জাপান, জার্মানি, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, চেকোস্লোভিয়া-সহ বহু দেশ নাম তুলে নেয় সেই বিশ্বকাপ থেকে। ঠিক হয় আগেরবারের বিশ্বকাপজয়ী (১৯৩৮ ফুটবল বিশ্বকাপ) তথা ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইতালি ও হোস্ট ব্রাজিল ছাড়াও এখানে অংশ নেবে ইউরোপের ৭, আমেরিকার ৬ ও এশিয়ার ১ দেশ৷ এশিয়ান কোটা থেকে প্রথমে ডাক দেওয়া হয় ফিলিপিন্সকে। সেই দেশ রাজি না হওয়ায় এরপর যথাক্রমে ডাক পায় বার্মা এবং ইন্দোনেশিয়া। তারাও রাজি না হওয়ায় ডাক পায় ভারত৷ বাকি তিন দল অংশ নিতে না চাওয়ায় সরাসরি বিশ্বকাপে সরাসরি নিজেদের জায়গা করে নেয় ভারত৷
আরও পড়ুন- একসময়ের বিশ্বজয়ীরা আজ মাঠের বাইরে! ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপে ঠাঁই হলো না যাদের
ভারত বিশ্বকাপে জায়গা করে নিলেও শেষ পর্যন্ত খেলতে পারেনি। সেই কারণগুলো জেনে নেওয়ার আগে আরেকটা বিষয় জানা প্রয়োজন। ওই তিনটি দেশ বিশ্বকাপ খেলায় অস্বীকার করার পর এশিয়ায় এত দেশ থাকতে কেন ভারতকেই সেইসময় বিশ্বকাপ খেলার ডাক দেয় ফিফা? আসলে ১৯৪৮-এর অলিম্পিকে সারা বিশ্বকে খালি পায়ে ফুটবল খেলে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ভারত। অধিনায়ক শৈলেন মান্নার ভারত রুখে দিয়েছিল ফ্রান্স এবং যুগোস্লাভিয়াকে। সেই সুবাদে সরাসরি বিশ্বকাপ খেলার ডাক পায় ভারত। তবে এই আমন্ত্রণের সঙ্গে আরেকটি শর্ত দেওয়া হয়েছিল।
ফিফা ভারতকে জানায়, বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করতে হলে তাদের বুট পরে অংশগ্রহণ করতে হবে। এআইএফএফ জানিয়ে দেয় ভারতীয় খেলোয়াড়রা বুট পরে খেলতে স্বচ্ছন্দ নয়। হয় তারা খালি পায়েই খেলবে, নয় তারা খেলবে না। ব্যাস! এভাবেই নষ্ট হয়ে গেল ভারতের ফুটবল বিশ্বকাপ খেলার একমাত্র সুযোগ। ২২ মে ১৯৫০, ভারতকে নিয়েই সূচি প্রকাশ করে ফিফা। তার একদিন পর, ২৩ মে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেয় ভারত। একই সঙ্গে বিশ্বকাপ থেকে নাম প্রত্যাহার করে নেয় স্কটল্যান্ডও। তার ফলে ১৯৫০ সালে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী দেশের সংখ্যা ১৩-তে এসে দাঁড়ায়। তবে সেই সময় ভারতীয় দলের অধিনায়ক শৈলেন মান্না জানান বুট মোটেও কোনও কারণ ছিল না। আসলে এআইএফএফ এই ধরনের একটি অজুহাত সব মহলে ‘ফ্লোট’ করিয়েছিল নিজেদের অপদার্থতার দায় ঝেড়ে ফেলতে। শৈলেন মান্না জানান যে, অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন বিশ্বকাপ ফুটবলের গুরুত্ব বুঝতে পারেনি তখনও। সেই সময়ে এআইএফএফ-এর কাছে বিশ্বকাপের থেকেও অলিম্পিক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ২০১১ সালে এক সাক্ষাৎকারে শৈলেন মান্না জানিয়েছিলেন, “আমরা তখনও ফুটবল বিশ্বকাপের মাহাত্ম্য বুঝিনি। এআইএফএফ-এর তরফেও আমাদের সেভাবে বলা হয়নি। আমাদের ধ্যান-জ্ঞান তখন অলিম্পিক। আগে ফুটবল বিশ্বকাপের গুরুত্ব বুঝলে আমরা নিজেরাই উদ্যোগী হতাম বিশ্বকাপ খেলার জন্য।”
আরও পড়ুন- ক্রিকেট-ফুটবল নয়, ব্যাডমিন্টনে বিশ্বমঞ্চের রাজা ভারত, চাণক্য গোপীচাঁদ
শৈলেন মান্না জানিয়েছিলেন বুট একটি কারণ হলেও মূল কারণ নয়। ভারতের বিশ্বকাপ না খেলার মূল দু’টি কারণ হল- বিশ্বকাপের প্রতি উদাসীনতা এবং অর্থাভাব। শোনা যায়, বিশ্বকাপ খেলার প্রস্তাব পেয়ে প্রথমে রাজি হয়ে গেলেও ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন অচিরেই বুঝতে পারে ফান্ডের সমস্যা। সেই সময় বিদেশ যাত্রা, বিদেশে গিয়ে এতদিন থাকা, খেলোয়াড়দের খাওয়া-দাওয়া সহ যাবতীয় খরচ বহন করতে অক্ষম ছিল এআইএফএফ। সেই বিশ্বকাপের হোস্ট ব্রাজিল তখন প্রস্তাব দেয় পুরো খরচ বহন করার৷ কিন্তু তাতেও সায় মেলেনি এআইএফএফ-এর৷ কেন? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। অনেকের মতে, আসন্ন এশিয়ান গেমস এবং অলিম্পিকে মনোনিবেশ করতে চেয়েছিল ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন। সেই কারণে তারা বিশ্বকাপ খেলতে যেতে চায়নি। তাহলে প্রথমে কি ঝোঁকের বশে রাজি হয়ে গিয়েছিল কর্তৃপক্ষ? প্রশ্ন থেকেই যায়।
আবার অনেকের মতে রাজনৈতিক চাপের কারণে খেলতে যায়নি ভারত। সেই সময়ে ভারতের প্রথম সারির রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা চাননি যে অন্য কোনও দেশের উপর নির্ভর করে নিজেদের বিশ্বের দরবারে তুলে ধরুক ভারত। তবে একটি বিষয় নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। যদি ভারত বিশ্বকাপ খেলত তাহলে সেই নিয়ে উৎসাহ বা উদ্দীপনার কোনও অভাব হত না দেশবাসীর মধ্যে। যদি আমরা সেই সময় বিশ্বকাপের মতো একটি মঞ্চে খেলতে পারতাম তাহলে নিঃসন্দেহে ভারতীয় ফুটবলে সুদুরপ্রসারী উন্নয়ন ঘটত। কে বলতে পারে তারপরে হয়তো পরবর্তী আরও অনেক বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করতে পারত ভারত। যদি ভারত সেবারের বিশ্বকাপ খেলত তাহলে বর্তমানে ভারতীয় ফুটবলের চিত্রটি অন্যরকম হত। তবে বাস্তব এটাই যে বিশ্বকাপ খেলার একটি সুবর্ণ সুযোগ বিভিন্ন কারণে হেলায় নষ্ট করেছিল আমাদের দেশ।