একসময়ের বিশ্বজয়ীরা আজ মাঠের বাইরে! ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপে ঠাঁই হলো না যাদের

World Cup 2022: আটটি দল এমন রয়েছে, যারা বিশ্বসেরা হয়েও ২০২২ কাতার ফুটবল বিশ্বকাপে জায়গা করে নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে।

যদি বছর পাঁচ-ছয় আগে কেউ আপনাকে বলত, আগামী দুই ফুটবল বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাবে না ইতালি, বিশ্বাস করতেন? না করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটাই একেবারে ধ্রুব সত্যি। ২০ নভেম্বর থেকে শুরু হতে চলেছে ২০২২ ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ। প্রথমবারের মতো এবছর ফুটবল বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হতে চলেছে কাতারে। ইতিমধ্যেই, ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপের সম্পূর্ণ শিডিউল প্রস্তুত। তবে ২০১৮ সালের মতো এবারের বিশ্বকাপেও সুযোগ পেল না ইতালি। ২০১৮ সালের বাছাই পর্বে সুইডেন-বাধা পেরোতে না পেরে রাশিয়া বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পায়নি ইতালি। সেই ব্যর্থতা হজম করে নিয়ে রবার্তো মানচিনির অধীনে নিজেদেরকে গুছিয়ে নিয়েছিল তারা। শুরু করেছিল নতুন সংগ্রাম। হয়ে উঠেছিল ইউরোপ-সেরা। কনমেবলে আর্জেন্টিনার সঙ্গে ৩-০ গোলে পরাজিত হলেও, সকলে আশা রেখেছিলেন এবার হয়তো নিজের মানটা বজায় রাখতে পারবে ইতালি। ২০২২ বিশ্বকাপে নীল জার্সিতে দৌড়তে দেখা যাবে আজ্জুরিদের। তবে সেরকমটা হলো না। এবারও বাছাই-পর্বের শেষে আটকে গিয়েছে ইতালি। উত্তর মেসিডোনিয়ার কাছে পরাজিত হয়ে আবারও শূন্য হাতেই ফিরে যেতে হচ্ছে চেলিনিদের। ইউরো-জয়ীদের ছাড়াই এবারও আয়োজিত হবে বিশ্বকাপ।

তবে, অঘটনের তালিকায় যে শুধু ইতালি রয়েছে, সেরকমটা বলা ভুল। বাদ পড়ার তালিকায় সবথেকে বড় দল ইতালি হলেও, এই তালিকায় রয়েছে আরও বেশ কিছু চমক। ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকার আটটি দল এমন রয়েছে, যারা ফুটবল বিশ্বে প্রথম শ্রেণির দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও ২০২২ কাতার ফুটবল বিশ্বকাপে জায়গা করে নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক, এই নাতিদীর্ঘ তালিকায় কোন কোন দল স্থান পেল।

ইতালি
এই মুহূর্তে ফুটবল-বিশ্বে ইতালি দলটির র‍্যাংকিং ৬। ১৯৩৪, ১৯৩৮, ১৯৮২, ও ২০০৬ নিয়ে চার বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নও হয়েছে এই দল। তবে, ২০১৮ থেকে এই দলটির সময় খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। বাছাই পর্বে ৯২ মিনিটের মাথায় উত্তর মেসিডোনিয়ার কাছে ১-০ গোলে পরাজিত হয়ে ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে আজ্জুরিদের। ২০২০ সালের ইউরো কাপে জয়লাভ করলেও বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে ইউরোপ-সেরাদের এরকম হতাশাজনক পারফরম‍্যান্স সত্যিই ছিল অভাবনীয়।

আরও পড়ুন: টি-টোয়েন্টি মানেই চমক! ফিরে দেখা কুড়ি ওভারের ক্রিকেটের সেরা অঘটনগুলি

৪-৩-৩ ছকে মেসিডোনিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিল ইতালি। তবে লিওনার্দো বোনুচি , চেলিনি এবং ফেদেরিকো কিয়েসারা এই ম্যাচে ছিলেন না প্রথম একাদশে। যথেষ্ট শক্তিশালী দল নিয়ে নামলেও, তাঁরা প্রথম থেকেই ফিনিশ করতে পারছিলেন না ভালোভাবে। ম্যাচে ভালো খেললেও ম্যাচ জেতার জন্য যেটা সবথেকে বেশি দরকার, সেই গোলটা পাননি ইতালির খেলোয়াড়রা। ৬৬ শতাংশ বল দখল রেখে, গোলের উদ্দেশ্যে ৩২টা শট নিয়েও শেষমেশ ব্যর্থ হতে হয়েছিল ইতালিকে।

৯০ মিনিট খেলা অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও যখন ম্যাচের ফয়সালা হলো না, তখন অনেকেই ভেবে নিয়েছিলেন, পেনাল্টি শুটআউটে গড়াবে ম্যাচ। কিন্তু, সমস্ত সম্ভাবনাকে মিথ্যে করে দিয়ে যোগ করার সময়ের দ্বিতীয় মিনিটে গোলকিপার স্তোলে দিমিত্রিয়াভস্কির লম্বা ফ্রিকিক স্ট্রাইকার বোয়ান মিওভস্কির মাথায় লেগে চলে যায় আরেক স্ট্রাইকার আলেকজান্ডার ট্রায়াকোভস্কির কাছে। ইতালির একজন খেলোয়ারও এই সময় দু'জনের কাছ থেকে বল নিতে পারেননি। আর সেই সুযোগেই বক্সের বাইরে থেকে মাটি ঘেঁষে জোরালো শটে ইতালির বিশ্বকাপজয়ী গোলকিপার জিয়ানলুইজি ডোনারুম্মাকে পরাস্ত করে দেন ট্রায়াকোভস্কি। আর এই একটি গোলই ইতালির বিশ্বকাপের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিল আরও একটিবারের জন্য।

কলম্বিয়া
এই মুহূর্তে বিশ্ব-ফুটবলে কলম্বিয়া দলটির র‌্যাংকিং ১৭তম স্থানে। ২০১৪ সালের কোয়ার্টার ফাইনাল অবধি দক্ষিণ আমেরিকার এই দলটি উঠতে পেরেছিল। কলম্বিয়া দলে তারকার সম্ভারও কম নয়। গত বিশ্বকাপের গোল্ডেন বুট-বিজেতা হামেজ রডরিগেজের মতো খেলোয়াড় থাকার কারণে এ-বছরের কাতার বিশ্বকাপে কলম্বিয়া ছিল হট ফেভারিট। পাশাপাশি গত বছর কোপা আমেরিকাতেও দারুণ পারফরম্যান্স এবং স্কিলের মাধ্যমে বিশ্বের নজর কেড়ে নিয়েছিল কলম্বিয়া।

তবে, কনমেবল কোয়ালিফায়ারসের ময়দানে খুব একটা ভালো পারফরম্যান্স করতে পারেনি এই দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবল দলটি। পেরুর একধাপ পিছনে ৬ নম্বরে শেষ করার কারণে ২০২২ এর কাতার বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেল না কলম্বিয়া। আর স্বভাবতই কলম্বিয়ার এই হতাশাব্যঞ্জক পারফরমেন্সে একেবারেই সন্তুষ্ট নন রদ্রিগেজ।

সুইডেন
১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপের রানার আপ এই দলটি এই মুহূর্তে বিশ্ব ফুটবলের বিংশতম স্থানে অবস্থান করছে। এখনও পর্যন্ত খেলা ২১টি বিশ্বকাপের মধ্যে ১২টি বিশ্বকাপের অংশ হতে পেরেছিল সুইডেন। পাশাপাশি ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালেও পৌঁছতে পেরেছিল এই দলটি। তবে এবারের বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ার স্তরে খুব একটা ভালো পারফরম্যান্স করতে পারেনি সুইডেন। নিজের গ্রুপের দ্বিতীয় স্থানে শেষ করে প্লে অফে পোল্যান্ড এর কাছে পরাজিত হয়ে কাতার বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হয় সুইডেনকে।

চিলি
দক্ষিণ আমেরিকার এই ফুটবল দলটি ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপে তৃতীয় স্থানে শেষ করেছিল। এই মুহূর্তে বিশ্ব ফুটবলের তালিকায় ২৯ নম্বরে রয়েছে চিলি। ১৯৩০ থেকে প্রতিটি বিশ্বকাপেই অন্যতম দল হিসেবে উপস্থিত থেকে এসেছে চিলি। বিশ্বকাপ জয়ের সৌভাগ্য এখনও পর্যন্ত না হলেও ১৯৯৮, ২০১০, ও ২০১৪ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে রাউন্ড অফ ১৬ পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিল দক্ষিণ আমেরিকার এই ফুটবল দলটি।

এই দলের বড় এবং নামজাদা খেলোয়াড়দের মধ্যে রয়েছেন ভিদাল, গ্যারি মেডেল, এবং অ্যালেক্সিস স্যঞ্চেজ। কিন্তু তবুও এবারের বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ারে খুবই খারাপ পারফরম্যান্স করেছে চিলি। কোয়ালিফায়ার স্তরে মাত্র একটি ম্যাচ জেতার কারণে প্রথম থেকেই পিছিয়ে পড়েছিল চিলি। এরপর বায়রন ক্যস্টিলোর কলম্বিয়ার নাগরিক হওয়ার কারণ দেখিয়ে ইকুয়েডরকে টুর্নামেন্ট থেকে বহিষ্কৃত করার চেষ্টা তারা করেছিল। তবে ফিফার নির্দেশে সেই চেষ্টা বিফলে যাওয়ায় ২০২২ কাতার বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয় চিলি।

নাইজেরিয়া
আফ্রিকার ফুটবল দলটি সেই মহাদেশের সবথেকে পুরনো কয়েকটি ফুটবল দলের মধ্যে একটি। ১৯৯৪, ১৯৯৮ এবং ২০১৪ সালে বিশ্বকাপের রাউন্ড অফ সিক্সটিন-এর সদস্য হতে পারা এই দল এই মুহূর্তে ৩১ নম্বরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশ্বের ক্রম তালিকায়। তাদের আক্রমণাত্মক স্টাইল এবং আনন্দদায়ক গোল সেলিব্রেশনের জন্য প্রত্যেক বিশ্বকাপেই চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকে নাইজেরিয়া।

সেরকমটা এই বিশ্বকাপের ক্ষেত্রেও ছিল। তবে এ-বছর নাইজেরিয়ার পারফরম‍্যান্স একেবারেই ভালো ছিল না। এর আগে ২০০৬ সালের বিশ্বকাপেও খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি নাইজেরিয়া। তবে ২০১০ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে কাম ব্যাক করতে পেরেছিল নাইজেরিয়া। এবারেও কোয়ালিফায়ার পর্যায়ে অ্যাওয়ে গোলে ঘানার কাছে পরাজিত হয়ে বিশ্বকাপের মঞ্চ থেকে বাদ পড়তে হয় নাইজেরিয়াকে।

রাশিয়া
প্রত্যেক বছরের বিশ্বকাপে ইউরোপের যে ক'টি দল ধারাবাহিকভাবে ভালো পারফরম্যান্স করে আসে তাদের মধ্যে একটি হলো রাশিয়া। এই মুহূর্তে বিশ্ব ফুটবলের মঞ্চে ৩৫ নম্বর স্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাশিয়া। তবে, এ-বছরে রাশিয়ার বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন অধরা থেকে গিয়েছে রাজনৈতিক কারণে। গতবারের বিশ্বকাপে হোস্ট নেশন হওয়ার পাশাপাশি কোয়ার্টার ফাইনাল অবধি পৌঁছেছিল ভ্লাদিমির পুতিনের দেশটি। রাশিয়া এবং ইউক্রেন যুদ্ধর কারণে ফিফা-র তরফ থেকে বিশ্বকাপে এই দলটিকে ব্যান করা হয়েছিল এই বছর। সেই কারণেই এ-বছর আর বিশ্বকাপ খেলা হলো না রাশিয়ার।

মিশর
বিশ্ব ফুটবলের তালিকায় এই মুহূর্তে ৪০ নম্বরে অবস্থান করছে মিশর। যেহেতু এবারের বিশ্বকাপটা মধ্যপ্রাচ্যে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সেই কারণে মহম্মদ সালাহ্ ছিলেন এই বিশ্বকাপের অন্যতম ফেভারিট খেলোয়াড়। তবে, সেরকমটা হয়নি। সেনেগালের বিরুদ্ধে বাছাই পর্বের ম্যাচে তাদের সব থেকে বড় তারকা মহম্মদ সালাহ্ পেনাল্টি মিস করার পরেই প্লে অফের রাস্তা কার্যত বন্ধ হয়ে যায় মিশরের কাছে।

যদিও এই প্রথম নয়, এর আগেও একাধিক বিশ্বকাপে মিশরকে বাসায় পর্ব থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল। ২০১৮ বিশ্বকাপেও মিশরের পারফরম্যান্স ভালো ছিল না। সালাহ্ কাঁধের চোটের জন্য সে-বছর বিশ্বকাপে উপলব্ধ ছিলেন না। ফলে, গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ের অভাবের কারণেই মূলত বাছাই পর্ব থেকে ছিটকে যায় আফ্রিকার এই দেশটি।

আলজেরিয়া
২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে রাউন্ড অফ সিক্সটিন পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিল আলজিরিয়া দলটি। এই মুহূর্তে বিশ্ব ফুটবলের তালিকায় ৩৭ নম্বর স্থান করে নিয়েছে আলজিরিয়া। কাতার বিশ্বকাপেও তাদের সম্ভাবনা ছিল প্রবল। তবে, ক্যামেরুনের কাছে পরাজিত হয়ে কাতার বিশ্বকাপের স্বপ্ন কার্যত স্বপ্ন হয়েই থেকে যায় এই দলটির।

More Articles