তিলোত্তমা কলকাতাকে নাকি বলা হত 'ব্ল্যাক টাউন'! নেপথ্যে কোন কারণ
The Black Town: ১৮৪৫ সালে গভর্নর এক কমিটি বসিয়েছিলেন শহরের অবস্থা সরেজমিনে তদন্ত করার জন্য। তাঁরা জানিয়েছিলেন, ব্ল্যাক টাউনে নাকে রুমাল গুঁজে পায়ে হেঁটে চলতে হয়েছে তাঁদের।
সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে নিজের চিত্রে ফুটিয়ে তোলার কাজ প্রথম শুরু করেন ফ্রান্স বালথাজার সল্ভিন্স। নিজের চিত্রে ভারতীয় বিশেষত ভারতীয় হিন্দুদের জীবনযাপনের দৃশ্য তুলে ধরতেন সল্ভিন্স। ১৭৬০ সালে বেলজিয়ামের অন্তরীপে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ইউরোপের রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হলে ১৭৯০-এর প্রথম দিকে কলকাতা চলে আসেন সল্ভিন্স। ঠিক করেছিলেন কলকাতায় এসে এখানকার সাধারণ ‘নেটিভ’দের জীবনযাপনের চিত্র তুলে ধরবেন। সেই সময়টা এমন এক সময়, যখন কলকাতাকে ডাকা হত ‘ব্ল্যাক টাউন’ নামে।
অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই কলকাতা বিভিন্ন অংশে বিভক্ত ছিল। কলকাতার একটি ভাগে বাস করত ইউরোপিয়ানরা, আরেকটি ভাগে বাস করত কলকাতার সাধারণ বাসিন্দারা। নিজের নোটে সল্ভিন্স লিখেছিলেন, “কলকাতায় প্রত্যেকটি দেশের বাসিন্দাদের জন্য আলাদা এলাকা ভাগ করা রয়েছে। যেমন ইংরেজদের এলাকা, পর্তুগিজদের এলাকা ইত্যাদি। এই এলাকাগুলিতে বেশ কিছু স্থানীয় বাসিন্দাদেরও দেখা যায়। তাদের অধিকাংশ হয় হিন্দু নয় মুসলমান। তবে তাদের গায়ের রং কাফরির মতো কালো। এই অংশগুলিকে ব্ল্যাক টাউন বলা উচিত।”
আরও পড়ুন- কলকাতার বস্তিতে বাস মুঘল সম্রাটের নাত বউয়ের, রিকশা চালান টিপুর বংশধর!
আসলে কলকাতা শহরের ভেতর তখন দু’টো শহর, রসিকতা করে বলা যায় ‘টু ক্যালকাটাস’। সাহেবপাড়া আর ব্ল্যাক টাউন। মোটামুটি ধরে নিতে পারা যায়, আজকের বিবাদী বাগ আর চৌরঙ্গী ছিল তখনকার সাহেবপাড়া। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হোমরাচোমড়া অফিসার এবং বিদেশি ব্যবসায়ীদের বাস সেখানে। এখানকার চেহারা তাই ভিন্ন, জীবন ভিন্ন। নবাগত যে দেখে, সেই তাকিয়ে থাকে। এইসব অঞ্চলকে দেখে সেই সময় বলা হত, কলকাতা হল সিটি অফ প্যালেস। বিশ্বের তাবড় তাবড় গুণী ব্যক্তি এক বাক্যে স্বীকার করতেন লন্ডনের পর বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর শহর কলকাতা। চৌরঙ্গী দেখে কলকাতাকে নিয়ে এমন মন্তব্য করেছেন অনেকেই। তবে একইসঙ্গে সেই সাহেব পাড়ার সহাবস্থানে ছিল ব্ল্যাক টাউন। এলোপাথাড়ি বাড়ি, খানা, ডোবা, গলি, হই-হট্টগোল, কোনও রীতি নেই, ভদ্রতা-সভ্যতার বালাই নেই, ব্ল্যাক টাউনের এমনটাই বর্ণনা দিয়েছেন সাহেবরা। তাদের মতে, দেশের নেটিভরা নিজেদের এলাকা সাজিয়ে গুছিয়ে পরিষ্কার করে রাখতে পারেনি বা রাখার প্রয়োজন মনে করেনি। কলকাতার এই অংশকে মূলত দু’টি কারণের জন্য ব্ল্যাক টাউন বলা হয়। প্রথমত, এখানকার বাসিন্দাদের গায়ের রং কালো ছিল। দ্বিতীয়ত, এখানকার বাসিন্দারা নিজেদের এলাকাকে অপরিচ্ছন্ন করে রাখত, অন্তত সাহেবদের এমনটাই দাবি।
বর্তমানেও শোনা যায়, কলকাতা শহরের ১০ শতাংশ জুড়ে রয়েছে বস্তি, তাতে শহরের ২৫ শতাংশ মানুষের বাস। আমরা যখনকার কথা বলছি অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ২৩০ বছর আগে, তখন এই সংখ্যাটা আরও বেশি ছিল বলাই বাহুল্য। ১৮০০ সালের একটা পরিসংখ্যান দেওয়া যাক। সেবছর কোনও এক বিশেষ কারণে কলকাতা জুড়ে এক ডেমোগ্রাফিক্যাল সার্ভে করা হয়। সেই সার্ভেতে দেখা যায়, কলকাতার মোট বাড়ির সংখ্যা প্রায় ৬৫ হাজার। তার মধ্যে ১৭ হাজার বাড়ি টালির, ৩৫ হাজার বাড়ি আসলে খড়ের ঝুপড়ি। বাকি ১৩ হাজার একতলা বা দোতলা পাকা বাড়ি।
ব্ল্যাক টাউনেও কিন্তু প্রচুর পাকা বাড়ি ছিল। শহরের বড় বড় বিত্তবান ক্ষমতাশালী নেটিভরা তাতে বাস করতেন। এক বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বিরাট বিরাট বাড়ি। অন্দরমহল, বৈঠকখানা, খাজাঞ্চিখানা, তোষাখানা, আস্তাবল, সদর দরজা, খিড়কি দরজা, কিন্তু সেগুলি অপরিচ্ছন্ন। প্রচুর টাকা, প্রবল আতিশয্য। নিয়মিত বাড়িতে মোচ্ছব হয় এবং সেখানে নিমন্ত্রিত থাকেন সাহেবরা। সাহেবরা এদের খাতির করে বলেন ‘বাবু’। এই প্রসঙ্গে বর্ণনা দিতে গিয়ে সল্ভিন্স লিখেছিলেন, “এই সমস্ত বাড়িগুলিতে ঢুকতে গেলেই একটি অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়বে। এখানে প্রত্যেক নেটিভদের বাড়ির সামনেই রয়েছে গম্বুজাকার একটি উপাসনা ক্ষেত্র। এটিকে মন্দির (mundars) বলে। এই মন্দির মূলত হিন্দু বাড়িতেই দেখা যায়। এছাড়াও, মুসলমানদের উপাসনার জন্য মসজিদ রয়েছে। এখানে প্রত্যেকটি পাকা বাড়িতে বড় বড় বারান্দা রয়েছে। এই বাড়ির বারান্দায় বাড়ির চাকর বাকররা বাড়ির মালিককে পাখা (punkha) দিয়ে হাওয়া করেন। বারান্দায় বসে বাড়ির বড়লোক হিন্দু মালিক হুক্কা খান।”
তবে মাথায় রাখতে হবে, যতই বড় বাড়ি করে নিন বা যতই ধন-সম্পত্তি রোজগার করে নিন না কেন ব্ল্যাক টাউনের ব্ল্যাক জমিদারকে ইউরোপিয়ানরা কখনই নিজেদের সমগোত্রীয় ভাবতো না। তাদের কাছে অর্থনৈতিক ক্ষমতা, প্রভাব, প্রতিপত্তির থেকেও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল চামড়ার রং। কিছু বাস্তব উদাহরণই দেখা যাক। সেই সময় রাজা নবকৃষ্ণ দেব নিজের মায়ের অন্ত্যেষ্টিতে নয় লক্ষ টাকা খরচ করেছিলেন! নিমু মল্লিক নিজের মায়ের অন্ত্যেষ্টিতে খরচ করেছিলেন তিন লক্ষ টাকা। ব্ল্যাক টাউনের দেওয়ান কাশী মিত্তির নিজের দুই ছেলের বিয়েতে চারদিন ধরে লোক খাইয়েছিলেন গোটা কলকাতা জুড়ে। এত কিছু সত্ত্বেও তারা শুধু ইংরেজদের থেকে ‘বাবু’ উপাধিটুকু পেয়েছিলেন, কিন্তু তাদের সঙ্গে ওঠাবসা করার অধিকারটি তারা পাননি। এটি শুধু ভারত বা কলকাতার ক্ষেত্রেই নয়, ইউরোপিয়ানরা যেখানে যেখানে নিজেদের কলোনি গড়ে তুলেছে সব জায়গায় এই একই জিনিসের ভিত্তিতে ক্ষমতা বাটোয়ারা হয়েছে। সে আফ্রিকাই হোক বা বিশ্বের অন্য কোনও জায়গাই হোক। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই ব্ল্যাক টাউনকে কতটা নিচু চোখে দেখত সাহেবরা।
আরও পড়ুন- জেনে অবাক হয়েছিল ইউরোপের কর্তারা! কলকাতাতে রয়েছে এশিয়ার একমাত্র মার্সিডিজ ১৩০ এইচ
১৮৪৫ সালে গভর্নর এক কমিটি বসিয়েছিলেন শহরের অবস্থা সরেজমিনে তদন্ত করার জন্য। তাঁরা জানিয়েছিলেন, ব্ল্যাক টাউনে নাকে রুমাল গুঁজে পায়ে হেঁটে চলতে হয়েছে তাঁদের। সরু সরু গলি, সরু সরু মানুষ। রাশি রাশি এলোপাথাড়ি বাড়ি আর জঞ্জাল। এক সাহেব নিজের বর্ণনায় ব্ল্যাক টাউন সম্বন্ধে লিখেছিলেন, “অদ্ভুত লোক এই ব্ল্যাক টাউনের বাসিন্দারা। ধোঁয়া এদের মশার ওষুধ। তাবিজ এদের কলেরার ধন্বন্তরি। এদের খাদ্যাখাদ্য বিচার নেই, ভালমন্দ বোধ নেই। জুয়া ছাড়া খেলাধুলা জানে না। ঋণ ছাড়া উপার্জনের পথ জানে না।” তবে বাস্তবে মোটেও এতটা দুরবস্থা ছিল না কলকাতার বা ব্ল্যাক টাউনের। সেখানে সাধারণ মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য কবি গানের লড়াই, মোরগের লড়াই, যাত্রা, গানের আসর সবই হত। পুজো-পার্বণও পালিত হত ধুমধাম করে। এছাড়াও অনেক জন হিতকর কাজও করতেন স্থানীয় ক্ষমতাশালী লোকেরা। আসলে শুধুমাত্র কালো চামড়ার মানুষদের প্রতি নিজেদের মনোভাবকে চরিতার্থ করতেই ব্ল্যাক টাউনের নামে দুই ঢোক জল বেশি খেতেন সে যুগের সাহেবরা।
এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় জানিয়ে রাখা দরকার। লেখার শুরুতেই বলেছি, সাহেবপাড়া ছিল আজকের চৌরঙ্গী আর বিবাদী বাগ। প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে ব্ল্যাক টাউন কোথায় ছিল? ফিরে যাওয়া যাক তার কাছে, যার লেখা ধরে আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম। ব্ল্যাক টাউন সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে সল্ভিন্স লিখেছিলেন, এই ব্ল্যাক টাউনের কেন্দ্রে বসতো একটি বড় বাজার। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন বড় বাজারটি হল আসলে আজকের বড়বাজার (Burra Bazaar), আবার অনেকের মতে এটি হল আসলে আজকের বউবাজার (Bow Bazaar)। ধরে নেওয়াই যায়, বর্তমান উত্তর কলকাতার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়েছিল এই ব্ল্যাক টাউন।