কলকাতার বস্তিতে বাস মুঘল সম্রাটের নাত বউয়ের, রিকশা চালান টিপুর বংশধর!

Ex Wealthy Royal Successors Of India: ওসমান আলি খানের প্রায় ১২০ জন বংশধর লন্ডনের ব্যাঙ্কে জমা থাকা ৩৬ মিলিয়ন পাউন্ডে তাদের প্রাপ্য অংশের জন্য আইনি লড়াই চালাচ্ছেন।

আজ যে রাজা, কাল সে ফকির।

সময় সুযোগ দেয় সবাইকে,

শেষ অবধি মানুষের থাকে না কিছুই।।

এই কবিতা উত্থাপনের কারণ একটাই। যে আজ রাজা হয়ে ধনসম্পত্তি আগলে বসে আছে কাল তার কপালে কী লেখা আছে তা কেই বা বলতে পারে। কালের নিষ্ঠুর পরিহাসে মানুষের জীবন বারবার অগোছালো হয়ে যায়। সত্যিই তো, জীবনে প্রতিটা মুহূর্তে যে কী হতে চলেছে সেটা হয়তো কেউ কোনওদিন আন্দাজও করতে পারে না। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর ভারতের পাঁচশ’রও বেশি অভিজাত পরিবারের পতন ঘটে। তাদের লোক দেখানো আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন নাটকীয়ভাবে ম্লান হয়ে যায়। অভিজাত মহারাজা-মহারানি, শাসক, নবাব, বেগম ও রাজকুমার-রাজকুমারীরা ক্ষমতাহারা হয়ে যায় এবং জমিদার প্রথা বাতিলের কারণে বিপুল পরিমাণ জমিজমাও তাদের হাতের বাইরে চলে যায়। এরপরও অভিজাত পরিবারগুলোর অনেকেই প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ হওয়ার চেষ্টা করেছেন। হয়েছেনও অনেকে। আবার এমনও অনেকে আছেন যারা নিজের অলঙ্কার ও সর্বস্ব বিক্রি করে ঋণগ্রস্ত অবস্থায় বর্তমানে ফকিরের মতো জীবনযাপন করেছেন।

১. হায়দরাবাদের শেষ নিজাম ওসমান আলি খানের বংশধর 

হায়দরাবাদের শেষ নিজাম ওসমান আলি খানের নাম কে না শুনেছে। তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ২১০.৮ বিলিয়ন ডলার। ২০১২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, তিনি বিশ্বের ষষ্ঠ ধনী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি পেপার ওয়েট হিসেবে ব্যবহার করতেন ১৮৫ ক্যারাটের এক হিরে। জানা যায়, তার ১৮ টি ছেলে আর ১৬ টি মেয়ে ছিল। মীর ওসমান আলি খানের মৃত্যুর পর ১৯৬৭ সালে হায়দরাবাদের নিজাম পদে বসেছিলেন যুবরাজ মোকাররম জাহ, যিনি বর্তমানে তুরস্কে বসবাস করেন। তবে, সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, ওসমান আলি খানের প্রায় ১২০ জন বংশধর লন্ডনের ব্যাঙ্কে জমা থাকা ৩৬ মিলিয়ন পাউন্ডে তাদের প্রাপ্য অংশের জন্য আইনি লড়াই চালাচ্ছেন।

২. রাজা ব্রজরাজ ক্ষত্রিয় বীরবার চামুপাতি সিংহ মহাপাত্র, তিগিরিয়া

যার একসময় ছিল ২৫ টি গাড়ি, আর তাঁর সেবায় নিয়োজিত ছিল ৩০ জন দাস-দাসী। শেষ জীবনে তিনি বেঁচে ছিলেন গ্রামের মানুষের দয়া দাক্ষিণ্যে। তার প্রথম জীবন কেটেছিল আমোদ প্রমোদে। কিন্তু শেষ জীবনে ভরসা ছিল গ্রামবাসীদের দেওয়া চাল-ডাল। ভারতে রাজতন্ত্র লোপ পাওয়ার আগে তিনিই ছিলেন তিগিরিয়ার শেষ নৃপতি।

শোনপুরের রাজকন্যা রসমঞ্জরী দেবীর সঙ্গে তার বিয়ে হলেও সেই বিয়ে সুখের হয়নি। রসমঞ্জরী রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর ব্রজরাজ দারিদ্রে ডুবে যান। স্বাধীনতার পর তার ভরসা ছিল বার্ষিক ভাতা। যিনি একসময় ১৩ টা বাঘ ও ২৮ টা লেপার্ড মেরেছেন তাঁকেই সরকারি দরবারে কিছু টাকার জন্য হাত পাততে হত। অভাবে জেরবার হয়ে তিনি ১৯৬০ সালে নিজের প্রাসাদ বিক্রি করে দেন। থাকতেন মাটির বাড়িতে। চরম অর্থকষ্টে কেটেছে তার শেষের দিনগুলি। ২০১৫ সালে মারা যান এই রাজা থেকে ফকির হওয়া ব্রজরাজ।

আরও পড়ুন- কনসার্ট থেকে বিয়েবাড়ি- নেই সেই আবাহন, হারিয়েই যাবে বিসমিল্লার ‘পাগলা’ সানাই?

৩. সুলতানা বেগম, বাহাদুর শাহ জাফরের নাতবৌ

বাহাদুর শাহ জাফরের প্রপৌত্র প্রয়াত যুবরাজ মির্জা বেদার বুখতের স্ত্রী সুলতানা বেগম আজ পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় বস্তির একটি ২ কামরার বাড়িতে থাকেন। ১৯৮০ সালে স্বামী মারা যাবার পর সুলতানার বাকি জীবন কেটেছে দারিদ্র্যের মধ্যে। একটিমাত্র রান্নাঘরে প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে কাজ করেন। আর ধোয়া মোছার কাজ করেন রাস্তার পাশের ট্যাপের জল দিয়ে। আগে চায়ের দোকান করে নিজের সংসার চালাতেন সুলাতানা বেগম। তাঁর ৬ ছেলেমেয়ে। বর্তমানে সরকারের থেকে পাওয়া মাসিক ৬০০০ টাকা পেনশনে তিনি নিজের সংসার চালান। সুলতানার মতে, তাঁদের অনেক আত্মীয় আজ যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং অন্যান্য উন্নত দেশে বসবাস করছে কিন্তু তাঁদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই আর তাঁরাও খোঁজ রাখেননি।

৪. ত্রিভাঙ্কুরের রাজার বংশধর

হায়দরাবাদের পর ত্রিভাঙ্কুর ভারতের দ্বিতীয় ধনী রাজ্য বলে পরিচিত। ১৭৫০ সালের মধ্যে ত্রিভাঙ্কুরে রাজ্য অনেক বড় ও সম্পদশালী হয়। তাই রাজা একটি স্বতন্ত্র আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক অবদান রাখতে শুরু করেন। ১৯৯১ সালে ত্রিভাঙ্কুরের রাজা শ্রী চিথিরা থিরুনাল বলরামা ভার্মা মারা গেলে তার ছোট ভাই উথারাডোম তিরুনাল মার্থান্ডা ভার্মা রাজপরিবারের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি বিখ্যাত শ্রী পদ্মনাভ স্বামী মন্দির পরিচালনকারী ট্রাস্টের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ২০১১ সালে পদ্মনাভ স্বামী মন্দিরে যে ৯০,০০০ কোটি টাকা এবং সোনা দানা পাওয়া গিয়েছিল সেই সম্বন্ধে মার্থান্ডা ভার্মার দাবি ছিল– তিনি মন্দিরের এই সম্পত্তি সম্বন্ধে অবগত ছিলেন কারণ তাঁদের রাজপরিবার নিজেদের সমস্ত ধন সম্পত্তি এই মন্দিরে দান করে দেন। তাঁর মতে, "যে সম্পদ পদ্মনাভ মন্দিরে পাওয়া গেছে তা ঈশ্বরের সম্পদ হিসেবেই সংরক্ষিত হবে। এই সম্পদে রাজপরিবারের কোনও আগ্রহ নেই।" শেষ জীবনে মার্থান্ডা ভার্মা ও তাঁর পরিবার একজন সাধারণ মানুষের মতোই জীবন কাটিয়েছেন। ২০১৮ সালে মার্থান্ডা ভার্মা মারা যান।

৫. টিপু সুলতানের বংশধর, ‘টাইগার অফ মাইসোর’

প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড, লোয়ার সার্কুলার রোড, পার্ক সার্কাস, ধর্মতলা স্ট্রিট, লেনিন সরণী, এবং কলকাতার চৌরঙ্গী এলাকায় পায়ে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কিছু এমন মানুষের দেখা পাবেন যাদের পোশাক সাধারণের থেকে অনেক আলাদা। তাদের কারও নাম রাজা, কারও নাম নবাব কেউ বা শাহজাদা। তাঁরা কেউ রাজপুত্র নয় বা সুলতানও নন। কিন্তু তাঁদের শরীরে একজন সুলতানের রক্তই বইছে বলা চলে। তাঁরা মাইসোরের রাজা টিপু সুলতানের বংশধর।

টিপু সুলতানের মৃত্যুর পর তাঁর এই বংশধররা আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। টিপুর মৃত্যুর পর ব্রিটিশরা মাইসোর থেকে তাঁদের কলকাতা পাঠিয়ে দেন এবং নিশ্চিত করেন যে তাঁরা কেউ যেন আর এই স্থানে ফিরে না আসতে পারে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন টিপু সুলতানের কন্যা ফতেমা বেগমের সমস্ত গয়নার দখল নেয় তখন সেই গয়না বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ৬ টি ষাঁড়ের প্রয়োজন হয়। আজ তাঁর বংশধররাই কুঁড়ে ঘরে বাস করেন। কেউ রিক্সা চালান তো কেউ সাইকেল মেরামতের কাজ করেন, কেউ কেউ আবার দর্জির কাজও করেন।

আরও পড়ুন- ২০ বার স্নাতক, বিশ্বের সবচেয়ে শিক্ষিত ব্যক্তি শ্রীকান্ত জিচকর ছিলেন দেশের সর্বকনিষ্ঠ বিধায়ক

৬. জিয়াউদ্দিন তুসি, বাহাদুর শাহ জাফরের উত্তরাধিকারী, শেষ মুঘল সম্রাট

শেষ 'মুঘল সম্রাট' জিয়াউদ্দিন তুসি আজ এক ভাড়া বাড়িতে বসবাস করেন। তিনি বাহাদুর শাহ জাফরের উত্তরাধিকারী। তিনি বিশ্বাস করেন সরকার মুঘল উত্তরাধিকারীদের সমস্ত সম্পত্তি আবার ফিরিয়ে দেবেন। তাই তিনি সরকারকে প্রত্যেক উত্তরাধিকারীদের ভাতা প্রদান করার দাবি জানিয়েছেন যা অনেকদিন আগে সরকার বন্ধ করে দিয়েছিল। তিনি এও আশা প্রকাশ করেন যে এই ভাতার টাকা ৮০০০ টাকায় নিয়ে গেলে আরও ভালো হয় যাতে সকলেই একটু ভালো ভাবে থাকতে পারেন।

৭. গোয়ালিয়রের সিন্দিয়া

গোয়ালিয়রের বিশাল দুর্গ বানিয়েছিল মঙ্গোলিয়ানরা। মুঘলরা এ দুর্গকে কুখ্যাত কারাগারে রূপান্তর করে। ১৯৫৭ সালে বিদ্রোহীরা এটিকে রণনৈতিক ঘাঁটি বানায় এবং শেষ পর্যন্ত এটি সিন্দিয়ার কেল্লা হয়ে ওঠে। মহারাজা জয়াজিরাও সিন্দিয়া তহবিলের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর সময় তাঁর ছেলে মাধব রাও ছিলেন খুবই ছোট, তাই তাঁকে তহবিলের সিক্রেট কোড দিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ফলশ্রুতিতে বছরের পর বছর ধনসম্পদহীনভাবে তীব্র লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে তাঁর পরিবার জীবন অতিবাহিত করেছে।

৮. অযোধ্যার রাজকুমারী সাকিনা

কেন্দ্রীয় ভারতের বিশাল অংশ শাসন করতেন রাজকুমারী সাকিনার পরিবার। বর্তমানে রাজকুমারী সাকিনা ও রাজকুমার রিয়াজ মালচা মহলে থাকেন, তুঘলকের যুগে যা শিকারি কুঠি ছিল। এখন বেশ জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। দীর্ঘ নয় বছর সরকারের সঙ্গে আইনি লড়াই করে শেষে বর্তমানে প্রতিমাসের শেষে তারা পাঁচশ টাকা করে পাচ্ছেন।

More Articles