মমি বিক্রি হতো ফুটপাথে! কেন দলে দলে মমি খাওয়ার হিড়িক উঠেছিল বিশ্বে?

Mummy Eating Mystery: ভিক্টোরিয়ানরা 'আনর‍্যাপিং পার্টি' আয়োজন করত। সেখানে ব্যক্তিগত বিনোদনের জন্য মিশরীয় মৃতদেহ খুলে দেওয়া হতো।

মমি নিয়ে রহস্যের ইতি নেই। হাজার হাজার বছর পেরিয়ে এসেও, মিশরীয়দের এই বিচিত্র ও আশ্চর্যজনক রীতি আজও গবেষণার আকর। পিরামিড নিয়ে আজও নিত্য নতুন তথ্য এসে হাজির হয়, মমি নিয়েও একাধিক রহস্যের পরত খুলেছে ধীরে ধীরে। রহস্য মানুষকে এমন ধাঁধায় ফেলে যে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। রহস্য থেকে জন্ম নেয় বিশ্বাস, সেই বিশ্বাস হামেশাই অন্ধ করে মানুষকে। দৃষ্টি ও বুদ্ধিরহিত মানুষ তাই ছুটে যায় অবাস্তব অথবা অতিবাস্তবের দিকে। সেই বুদ্ধিরহিত মানুষই একবার মমি খেতেও শুরু করেছিল। শুনতে অবাক লাগলেও এটি সত্য যে, একটি এমনও সময় ছিল যখন ইউরোপিয়রা মিশরীয় মমি নিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, মমি খেতে শুরু করেছিল তারা।

মানুষের বিশ্বাস ছিল, মমি, মানে মানুষের প্রাচীন দেহাবশেষ বিউবোনিক প্লেগ থেকে শুরু করে সামান্য মাথাব্যথা পর্যন্ত যে কোনও রোগই নিরাময় করতে পারে। ভিক্টোরিয়ান যুগে প্রচুর মানুষই রাতের খাবারের শেষে প্রাচীন মিশরীয়দের মমির অংশ খেত মুগ্ধ হয়ে। মধ্যযুগ থেকে প্রায় ১৯ শতক পর্যন্ত এই রীতি প্রচলিত ছিল।

মমি ম্যানিয়া

মমি যে কোনও অসুস্থতা নিরাময় করতে পারে এই বিশ্বাসের ফাঁদে পড়ে বহু শতাব্দী ধরে মানুষ মমি খেয়েছে, অকল্পনীয়! মামিয়া হচ্ছে মমি করে রাখা মৃতদেহ থেকে তৈরি একটি পণ্য। আসলে এটি একটি ঔষধি পদার্থ যা বহু শতাব্দী ধরেই খেয়ে এসেছেন ধনী এবং দরিদ্র নির্বিশেষে সকলেই। অ্যাপোথেকেরির দোকানে পাওয়া যেত এই মামিয়া। মামিয়া আসলে তৈরি করা হয়েছিল মিশরের সমাধি থেকে ইউরোপে নিয়ে আসা মমির অবশিষ্টাংশ থেকেই। ১২ শতকের সময়কাল জুড়ে অ্যাপোথেকেরি তাদের ওষুধ প্রস্তুতে মমির ব্যবহার করে এসেছে। এই সময়ের পরবর্তী আরও ৫০০ বছরের মমিরা ছিল বিবিধ রোগের নির্ধারিত ওষুধ।

আরও পড়ুন- নুন দিয়ে দেহ শুকনোর পর কী এমন মাখানো হতো দেহে? অবশেষে ফাঁস মমি তৈরির রহস্য

অ্যান্টিবায়োটিকহীন সেই বিশ্বে, চিকিত্সকরা মাথাব্যথা হোক বা কোনও অংশ ফুলে যাওয়া, এমনকী প্লেগ নিরাময়ের জন্যও মাথার খুলি, হাড় এবং মাংস ব্যবহারের পরামর্শই দিয়েছেন। তবে সকলেই যে মমির ওষুধের প্রতি অন্ধ বিশ্বাসী ছিল এমন না। রাজচিকিৎসক গাই দে লা ফন্টেইন সন্দেহ করেছিলেন যে, মামিয়া আদৌ কোনও ওষুধই নয়। ১৫৬৪ সালে তিনি দেখেন, আলেকজান্দ্রিয়ায় মৃত কৃষকদের দেহ থেকে নকল মমি তৈরি হচ্ছে! তিনি বুঝতে পারেন আসলে ওষুধের নামে প্রতারণা চলছে! সবসময়ই যে প্রকৃত প্রাচীন মমি ব্যবহার করা হতো এমন না। কিন্তু প্রতারণা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে প্রমাণ করে। ওষুধে ব্যবহারের জন্য মৃত মাংসের চাহিদা ক্রমাগতই বাড়ছিল এবং সত্যিকারের মিশরীয় মমি আসলে ওষুধ প্রস্তুতের চাহিদা মেটাতে পারছিল না। অ্যাপোথেকেরি এবং ভেষজ ওষুধ প্রস্তুতকারকরা ১৮ শতকেও মমি থেকে তৈরি ওষুধ বিক্রি করত।

ওয়াইন যত পুরনো তত তার স্বাদ! তেমনই চিকিৎসকদের বিশ্বাস ছিল মমি যত পুরনো ততই তা থেকে তৈরি ওষুধ সেরা! তাঁদের বিশ্বাস ছিল, তাজা মাংস এবং রক্তের এক অদ্ভুত জীবনীশক্তি আছে যার অভাব রয়েছে দীর্ঘদিনের মৃতদের। এই বিশ্বাস এমনই গভীরে ছিল যে, ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস তাঁর খিঁচুনি রোগ হওয়ার পর মানুষের মাথার খুলি থেকে তৈরি ওষুধ গ্রহণ করেন। ১৯০৯ সাল পর্যন্ত চিকিত্সকরা স্নায়ুর চিকিৎসার জন্য সাধারণত মানুষের মাথার খুলিই ব্যবহার করতেন।

রাজা এবং অন্য অভিজাতদের জন্য, মমি খাওয়াকে রাজকীয় ওষুধ বলে মনে করা হতো কারণ চিকিৎসকদের দাবি ছিল যে, মামিয়া ফ্যারাওদের দেহ থেকে তৈরি। তাই রাজার থেকেই রাজার দেহে আসছে জীবনীশক্তি। ১৯ শতকে কিন্তু মমির দেহ ব্যবহারটি বদলে যায়। রোগ সারাতে কিন্তু মানুষ আর মমি খাচ্ছিল না। ভিক্টোরিয়ানরা 'আনর‍্যাপিং পার্টি' আয়োজন করত। সেখানে ব্যক্তিগত বিনোদনের জন্য মিশরীয় মৃতদেহ খুলে দেওয়া হতো। ১৭৯৮ সালে মিশরে নেপোলিয়নের প্রথম অভিযানের পরে ইউরোপিয়দের কৌতূহল জেগে ওঠে। ১৮ শতকের শেষে, ১৯ শতকের গোড়ায় মিশরে পথেই বিক্রি হতো মমি। মিশরের ফুটপাথ থেকে কেনা আস্ত মমি ইউরোপে নিয়ে আসার অনুমতি দেয় ইউরোপীয়রা।

আরও পড়ুন- মৃত্যুর সহায়িকা বই! মিশরের রহস্যময় ‘বুক অফ দ্য ডেড’-এ আসলে কী আছে?

ভিক্টোরিয়ানদের এই 'আনর‍্যাপিং পার্টি'তে প্রথম দিকে অন্তত চিকিৎসাবিজ্ঞানকে সামান্য সম্মান দেখিয়েই মমির দেহ উন্মোচিত হতো। ১৮৩৪ সালে সার্জন টমাস পেটিগ্রু রয়্যাল কলেজ অব সার্জনসে একটি মমি খুলেছিলেন। সেবার ময়নাতদন্ত এবং অপারেশন জনসমক্ষেই সংঘটিত হয়েছিল। তবে অচিরেই এই চিকিৎসা গবেষণার ভণিতাটি শেষ হয়ে গেল। এবার মমি আর কেবল ওষুধ নয়, মমি কেবলই রহস্য-রোমাঞ্চ। নৈশভোজের আয়োজক মমির মোড়ক খোলার সময় অতিথিদের বিনোদনের কথাই মাথাতে রাখতেন। তিনি যে একটি আস্ত মমির মালিক, বিষয়তা বেশ সম্মানের বলে গণ্য হতো সেই সময়। শুকনো মাংস এবং হাড়গুলিকে ব্যান্ডেজে মোড়া অবস্থায় দেখতে ভিড় করতেন অতিথিরা। 

মমির অভিশাপ

২০ শতক শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মমি আনর‍্যাপিং পার্টি শেষ হয়ে যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক অবশেষ ধ্বংস করা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। এর পরপরেই তুতেনখামেনের সমাধি আবিষ্কার হলো। তুতেনখামেন অভিযানের উদ্যোক্তা লর্ড কার্নারভন ১৯২৩ সালে হঠাৎ করেই মারা যান। আকস্মিক মৃত্যু ঠিকই, তবে অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু 'মমির অভিশাপ' নিয়ে নয়া এক কুসংস্কার ছড়িয়ে পড়ল হু হু করে।

আধুনিক মমি

২০১৬ সালে ইজিপ্টোলজিস্ট জন জে. জনস্টন সেই ১৯০৮ সালের পর প্রথম জনসমক্ষে মমির মোড়ক খোলার আয়োজন করেন। বর্তমানে, মমি সহ যে কোনও পুরাকীর্তি চোরাচালানের কালো বাজারের মূল্য প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কোনও প্রকৃত প্রত্নতাত্ত্বিকই যেমন ইচ্ছা মমি খুলে ফেলবেন না এবং কোনও চিকিত্সকও মমি খাওয়ার পরামর্শ দেবেন না। কিন্তু তাও, মমির লোভ এখনও প্রবল। শুধু কারণটা বদলে গেছে, এখন চোরবাজারে মমি বিকোয় কোটি কোটি টাকায়। এখন আর 'অভিশাপে' ডরায় না কেউ।

More Articles