কেন আবু ধাবিতে হিন্দু মন্দির উদ্বোধন করছেন মোদি? নেপথ্যে রয়েছে যে আসল কারণ

Abu Dhabi Mandir Narendra Modi : মুসলিম প্রধান দেশে হিন্দু মন্দিরের উদ্বোধনে নরেন্দ্র মোদিকেই কেন যেতে হচ্ছে?

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কি মন্দিরের অ্যাম্বাসাডর? পৃথিবীর যে প্রান্তেই মন্দিরের উদ্বোধন হবে, সেখানেই তিনিই হবেন উদ্বোধক? দেশে রাম মন্দির না হয় রাজনৈতিক এজেন্ডা ছিল। লোকসভা ভোটের আগে এই মন্দির তাঁকেই উদ্বোধন করতে হতো, প্রাণ প্রতিষ্ঠাও তাঁকেই করতে হতো। রাম মন্দির কি বিশ্বজুড়ে মন্দির স্থাপনের ভিত্তি ছিল তবে? প্রশ্ন উঠছে কারণ সুদূর আবুধাবিতে তৈরি হয়েছে এক মন্দির এবং সেই মন্দির উদ্বোধন করবেন নরেন্দ্র মোদি। আবুধাবিতে বোচাসানবাসী অক্ষর পুরুষোত্তম স্বামীনারায়ণ সংস্থা বা বিএপিএস সোসাইটি দ্বারা নির্মিত এই হিন্দু মন্দিরটিই প্রথম মন্দির। ২৭ একর জমির উপর নির্মিত হয়েছে এই পাথরের মন্দির। মুসলিম প্রধান দেশে হিন্দু মন্দিরের উদ্বোধনে নরেন্দ্র মোদিকেই কেন যেতে হচ্ছে?

সংযুক্ত আরব আমিরশাহীতে দুই দিনের সফরে গেছেন মোদি। এই সফরের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে বিএপিএস মন্দির উদ্বোধন। সংযুক্ত আরব আমিরশাহীতে দ্বিতীয় বড় হিন্দু মন্দির হচ্ছে এটি। ২০২২ সালের অক্টোবরে দুবাইয়ের প্রথম মন্দিরটি সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর সহনশীলতা মন্ত্রী এইচএইচ শেখ নাহিয়ান বিন মুবারক আল নাহিয়ান উদ্বোধন করেছিলেন। এই নতুন মন্দিরটিতে ১ মার্চ থেকে সাধারণ মানুষ যেতে পারবেন।

দুবাই-আবু ধাবি শেখ জায়েদ হাইওয়ের পাশে আল রাহবার কাছে আবু মুরেখাহতে সংযুক্ত আরব আমিরশাহী সরকারের দান করা ২৭ একর জমির উপর নির্মিত নতুন এই মন্দিরটি। ২০১৯ সালেই এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের কাজটি হয়ে গিয়েছিল। বিশাল এই মন্দিরে ৩,০০০ লোক বসতে পারে এমন একটি প্রার্থনা কক্ষ রয়েছে; একটি কমিউনিটি সেন্টার, একটি প্রদর্শনী কক্ষ, পাঠাগার এবং বাচ্চাদের জন্য পার্কও রয়েছে।

আরও পড়ুন- রামমন্দির: যে বড় সত্য লুকোনো হলো

মন্দিরের সম্মুখভাগে গোলাপি বেলেপাথরের উপর মার্বেলয়ের খোদাই করা কারুকার্য আছে। রাজস্থান এবং গুজরাতের দক্ষ কারিগররা ২৫,০০০টিরও বেশি পাথরের টুকরো দিয়ে তৈরি করেছেন এই অংশটি। গোলাপি বেলেপাথরও রাজস্থান থেকেই আনা হয়েছিল।

মন্দিরটিতে পুরনো নগর স্থাপত্যশৈলী মেনে তৈরি রয়েছে। ১০৮ ফুট উঁচু মন্দিরের সাতটি চূড়া আছে। প্রত্যেকটিই সংযুক্ত আরব আমিররশাহীর সাতটি অংশের রূপক। বিএপিএস মন্দিরটিতে গঙ্গা ও যমুনা নদীর ঘাটের আভাস পাওয়া যাবে। মন্দিরের দু'টি মূল কেন্দ্রীয় গম্বুজ রয়েছে - 'সম্প্রীতির গম্বুজ' এবং 'শান্তি গম্বুজ'। মন্দিরের প্রবেশদ্বারে আটটি মূর্তি আছে, হিন্দুধর্মের আটটি মূল্যবোধের প্রতীক হিসেবে৷

মন্দিরে প্রাচীন সভ্যতার গল্পগুলিরও আভাস পাওয়া যায়। মায়া, অ্যাজটেক, মিশরীয়, আরবি, ইউরোপিয়, চিনা এবং আফ্রিকান সভ্যতার পাথরে খোদাই করা নিদর্শন রয়েছে। রামায়ণের কাহিনিরো পাথরে খোদাই করা আছে। এই মন্দিরটিতে সাতটি উপাসনাস্থল রয়েছে। ভারতের উত্তর, পূর্ব, পশ্চিম এবং দক্ষিণাংশের বিভিন্ন দেবতাকে এই উপাসনাস্থল উৎসর্গ করা হয়েছে।

এর আগে যে সংযুক্ত আরব আমিরশাহীতে মন্দির ছিল না তা নয়। হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়ের ধর্মচর্চার স্থান এখানে ছিল। বিএপিএস হিন্দু মন্দিরের এই মুহূর্তে চাহিদা বাড়ল কেন? 

বলা হচ্ছে বিএপিএস হিন্দু মন্দির ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে। আবুধাবিতে যে এই হিন্দু মন্দির নির্মাণ হবে সেই বিষয়টি ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী মোদি ক্ষমতায় আসার পরপরই তৈরি হয়েছিল। ২০১৫ সালেই সেদেশে সফরের পর মোদি লিখেছিলেন, "আবুধাবিতে একটি মন্দির নির্মাণের জমি বরাদ্দ করার সিদ্ধান্তের জন্য আমি সংযুক্ত আরব আমিরশাহী সরকারের কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। এটি একটি দুর্দান্ত পদক্ষেপ।”

১৯৮১ সালের পর প্রধানমন্ত্রী মোদিই প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যিনি সংযুক্ত আরব আমিরশাহী সফর করেন। সেখানে তিনি আবুধাবির তৎকালীন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ এবং দুবাইয়ের শাসক শেখ মহম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুমের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এই সফরের পরই সরকার মন্দিরের জন্য জমি বরাদ্দ করেছিল। প্রধানমন্ত্রী মোদির সফরের পর, সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর সরকার হিন্দু মন্দির নির্মাণের জন্য ১৩.৫ একর জমি উপহার দেয়। ২০১৯ সালে আরও ১৩.৫ একর জমি বরাদ্দ করে।

২০১৮ সালে আরব দেশে নিজের দ্বিতীয় সফরে দুবাই অপেরা হাউস থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই হিন্দু মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। এবার সপ্তম সফরে সেদেশে গেছেন মোদি। মোদি বলছেন, ভারতের UPI-কে সংযুক্ত আরব আমিরশাহীতে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কাজ চলছে যাতে সরাসরি অর্থ পাঠানো যেতে পারে। মোদি বলছেন, ভারতের Rupay সংযুক্ত আরব আমিরশাহীকে তাদের ডোমেস্টিক পেমেন্ট কার্ড তৈরি করতে সাহায্য করেছে। তারা সেই কার্ডের নাম দিয়েছে জীবন। এবার শিগগিরই সেখানে UPI পরিষেবা শুরু হতে চলেছে।

গত নয় বছরে, সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর সঙ্গে ভারতের সহযোগিতার বাণিজ্য বেড়েছে প্রতিরক্ষা, খাদ্য ও শক্তি নিরাপত্তা এবং শিক্ষার মতো খাতে। দুই দেশই একে অপরের অন্যতম সেরা ব্যবসায়িক অংশীদার। ২০২২-২৩ সালে প্রায় ৮৫ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য করেছে দুই দেশ। এই বাণিজ্যিক সাহায্যেরই কি অংশ মন্দির?

২০২৩ সালে G20 নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনে ভারত এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহী অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারত-মধ্য পূর্ব ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডোর (IMEEC) এবং গ্লোবাল বায়োফুয়েল অ্যালায়েন্স চালু করেছে। ভারতে ৩.৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগকারী দেশ হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহী। বৈদেশিক বিনয়োগের ক্ষেত্রে ভারতে চতুর্থ স্থানে সংযুক্ত আরব আমিরশাহী। সংযুক্ত আরব আমিরশাহী এখন ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানির দেশ এবং তৃতীয় বৃহত্তম ব্যবসায়িক অংশীদার।

আরও পড়ুন- রামমন্দিরের জয়ে আসলে হারল ভারতই?

সংযুক্ত আরব আমিরশাহীতে 'জীবন' জাতীয় ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড সিস্টেম এই বছরের এপ্রিল-জুন মাসেই শুরু হয়ে যাবে। এই বিষয়টির বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ভারতের। আরবিআই এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক গত বছর ডিজিটাল মুদ্রায় একটি এমওইউ স্বাক্ষর করেছে। গুজরাতে হাইব্রিড এনার্জি পার্ক স্থাপনের জন্য ৩০০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার কথা সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর। EMAAR গ্রুপ শ্রীনগরের উপকণ্ঠে একটি শপিং মল এবং একটি বহুমুখী টাওয়ারেও ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে।

IOCL এবং আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি (ADNOC) ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর মধ্যে প্রথম দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি চুক্তির অধীনে ১.২ এমএমটি এলএনজি কেনার জন্য ২০২৬-৩৯ সালের ১৪-বছরের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ভারত এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, দুই দেশই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার যৌথ নকশা ও উন্নয়নে কাজ করছে। মনুষ্যবিহীন বায়ুযান সহ নানা যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যাপক কাজ চলছে দুই দেশের। এত সাহায্যের বিনিময়ে একটি মন্দিরের সমঝোতা করা কোনও ব্যাপারই না।

ভারতবর্ষে মন্দির একটি রাজনৈতিক টার্নিং পয়েন্ট নির্দ্বিধায়। আরব মুসলিম প্রধান দেশ। সেখানে মন্দির প্রতিষ্ঠা, তাও আবার মোদির হাতে- এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করা গেলে ভারতের রাজনৈতিক ময়দানে বিজেপির প্রতি ওঠা 'ধর্মীয় মেরুকরণ'-এর অভিযোগটি কমানো যাবে। লোকসভা নির্বাচনের আগে আবুধাবিতেও 'মন্দির বানায়েঙ্গে' কার্যক্রম তাই ধর্মের রাজনীতির এক বড় অংশ হিসেবেই দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

More Articles