ভারতে রোহিঙ্গাদের জন্য ফেরানো মুখ, অন্য শরণার্থীদের জন্য দরজা খোলা! কোথায় যাবেন ওঁরা

মিজোরামের সরকার দারুণভাবে বরণ করছে মায়ানমারের চিন থেকে আসা শরণার্থীদের। এই ধরনের ভিন্নতার একমাত্র প্রধান কারণ কি তাহলে জাতি এবং ধর্ম?

ভারতে রোহিঙ্গাদের নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয় বটে, কিন্তু তার তুলনায় মায়ানমার থেকে আসা আরেক দল শরণার্থীর প্রতি কিন্তু মিজোরামের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণভাবে আলাদা, তারা তাদের প্রতি খুবই অতিথিপরায়ণ।

কেন্দ্রীয় সরকার রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের ‘অবৈধ অভিবাসী’ এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য 'বিপজ্জনক' বলে অভিহিত করেছে। অন্যদিকে, মিজোরামের রাজ্য সরকার ও স্থানীয় মানুষজন মায়ানমার থেকে আসা খ্রিস্টান শরণার্থীদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও কেন্দ্রীয় সরকার এদেরকেও শরণার্থীর মর্যাদা দেয় না।

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১-এ মায়ানমারে সামরিক বাহিনী পুনরায় ক্ষমতা দখল করার পর থেকে বিভিন্ন দল গোপনে মায়ানমার ও মিজোরামের মধ্যবর্তী আন্তর্জাতিক সীমান্ত তিয়াউ নদী পার করে মিজোরাম প্রবেশ করছে। মায়ানমারের ‘সেপায়া’ অর্থাৎ সিপাইরা সেখানকার জনগণের ঘরবাড়ি এবং ক্ষেত জ্বালিয়ে দিয়েছে। ঘন জঙ্গল এবং পাহাড়ের ভেতর দিয়ে দিনের পর দিন হেঁটে সীমান্ত পেরিয়ে মিজোরাম পৌঁছয় এই শরণার্থীরা।

আরও পড়ুন: নির্বিচারে খুন-ধর্ষণ, বন্ধ‍্যা করে দেওয়া! চিনে কতটা অত‍্যাচারের মুখে উইঘুর মুসলিমরা

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় ৩১ হাজার শরণার্থী রয়েছে মিজোরামে, যদিও বিভিন্ন এনজিও-র হিসেবে এর প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। গত বছর থেকে, মায়ানমারের চিন রাজ্যের গণতন্ত্রপন্থীরাও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নিয়মিত বিক্ষোভ, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছে। আরও বাড়ছে সেনাবাহিনীদের দমন-নির্যাতন।

যদিও কেন্দ্রীয় সরকার এইসব শরণার্থীর দায়িত্ব নিতে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে, মিজোরাম এই হাজার হাজার মানুষকে স্বাগত জানিয়েছে। তাদের যথাসাধ্য আশ্রয় দিয়েছে খাদ্য, বাসস্থান এবং শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে।

আইজলে এক সাক্ষাৎকারে মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা বলেন, “তাদের সঙ্গে আমাদের রক্তের সম্পর্ক আছে, এটা আপনাদের বুঝতে হবে।” তিনি আরও বলেন “ঐতিহাসিক কারণে আমাদের মধ্যে সীমান্ত বিভাজন তৈরি হতে পারে, কিন্তু মিজো এবং চিন আসলে একই জাতিগোষ্ঠী। তাই আমরা একই পরিবার, শুধু সীমান্তের দুই পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছি। আজ পরিবারের কিছু সদস্য বিপদে আছে, তাই আমাদের তাদের সাহায্য করতে হবে, তাই না? এটা একান্তভাবেই আমাদের ফ্যামিলি ম্যাটার।”

ভ্যান লালজাওমাও ক্ষমতাসীন দল মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের সহ-সভাপতি এবং সাংসদ। সাক্ষাৎকারে আরও যোগ করে তিনি বলেন যে, “মিজোরাম তাদের আশ্রয় দিয়েছে কারন আমরা একই বংশের, মিজো এবং চিন একই এথিনিসিটির। ব্রিটিশদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতির আগে আমরা সবাই একই জমিতে ছিলাম, এখন যেটা মিজোরাম, মায়ানমারের চিন পাহাড়, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম- এই সমস্ত জায়গায় আমরা বসবাস করতাম। তারা সবাই আমাদের ভাই-বোন, এখন বিপদে। তাদের জন্য সেখানে থাকা খুব বেশি কষ্টের। তাহলে আমরা কেন তাদের আশ্রয় দেব না?”

মিজোরাম বস্তুত মায়ানমার থেকে আসা কোনও শরণার্থীকেই ফেরত পাঠাছে না। মিজোরাম শুধু তাদের নিজের লোক বলে নয়, মানবিক কারণেও পিছনে ঠেলে দিতে পারবে না- এমনটাই বলেন মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি এটাও বলেন যে, রোহিঙ্গাদেরও ভারত থেকে ফেরত পাঠানো উচিত নয়।

ভারত-মায়ানমার সীমান্তের কাছে চাম্পাই শহরের জোতে গ্রামে চিনস্টেট থেকে আসা শরণার্থীদের জন্য একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। জাতিসংঘ-র কর্মকর্তাদেরও শরণার্থী শিবিরে যেতে দেওয়ার অনুমতি নেই। এই শিবিরের বাসিন্দারা আজ পর্যন্ত ভারত সরকার বা জাতিসংঘের কাছ থেকে শরণার্থী হিসেবে পরিচয়পত্র পাননি।

অন্য দিকে, ভারতে রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীরা কঠোর বিধিনিষেধ, নির্বিচারে আটক, রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা প্রায় করা সহিংস আক্রমণ এবং বলপূর্বক প্রত্যাবাসনের উচ্চ ঝুঁকির সম্মুখীন। সরকার বলেছে যে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিতাড়ন না করা পর্যন্ত তাদের ডিটেনশন কেন্দ্রে রাখা হবে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, আনুমানিক ৪০,০০০ রোহিঙ্গা ভারতে রয়েছে। তাদের মধ্যে অন্তত ২০,০০০ জাতিসংঘ-র মানবাধিকার কমিশনে নিবন্ধিত। বাকিরা দেশের অন্যান্য প্রান্তে অনিবন্ধিতভাবে ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে।

ভারতে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং কর্মসংস্থার মতো মৌলিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ২০১৯ সালে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) পাস করে। এই আইনের মতে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে নন-মুসলিম 'অবৈধ অভিবাসীদের' ভারতের নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে। কিন্তু এই আইনটি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ এবং মুসলিম দলগুলো বলে, আইনটি সংবিধানে বর্ণিত ধর্মনিরপক্ষে মূল্যবোধের পরিপন্থী।

রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারে বলে ধারণা করে কেন্দ্র সরকার। অতি জাতীয়তাবাদী হিন্দু গোষ্ঠীগুলো ভারতে মুসলমানদের ওপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণের অংশ হিসেবে জম্মুতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের টার্গেট করে এবং তাদের দেশ থেকে বহিষ্কারের আহ্বান জানায়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করছে এবং রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের নীতি সেই ধর্মান্ধতার প্রতিফলন বলে মনে হচ্ছে।

আবার অন্যদিকে মিজোরামের সরকার দারুণভাবে বরণ করছে মায়ানমারের চিন থেকে আসা শরণার্থীদের। এই ধরনের ভিন্নতার একমাত্র প্রধান কারণ কি তাহলে জাতি এবং ধর্ম? এমনটাই প্রশ্ন উঠে আসছে।

খ্রিস্টান-অধ্যুষিত মিজোরামে গির্জা সংগঠন খুবই শক্তিশালী। হাজার হাজার চিন শরনার্থীদের সাহায্য করতে এই চার্চ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চার্চ ক্যয়ারের লিড সিঙ্গার ডেভিড বলেন, “জেনে রাখুন, মিজোরা কখনও তাদের খাওয়াতে দ্বিধা করবে না। দেড় বছর হয়ে গেছে, দরকার হলে যতদিন দরকার হবে, ততদিনই তাদের মুখে আমরা খাবার তুলে দেব।”

কিন্তু কতদিন এটা টানা যাবে, সেটা এখন বেশ দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। “আমাদের কাছে শরণার্থীদের সাহায্য করার মতো নিজস্ব কোনও অর্থ নেই, আমরা পুরোপুরি মানুষের দানের ওপর নির্ভর করে চলছি,” এমনটা বলেন চাম্পাই জেলার এনজিওর প্রধান সংগঠক লালছুয়ানোমা, এক সাক্ষাৎকারে।

তবে যেমন অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী মায়ানমারে ফিরে যাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে, চিনের এই বাসিন্দারা এখনও হাল ছাড়েনি। প্রতিদিনই তারা দেখে বাড়ি ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন। বৈষম্য, প্রতিরোধ এবং সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ প্রকৃতি এবং বর্তমান সংকটের সমাধানের জন্য ভারতে অভিন্ন উদ্বাস্তু আইনের প্রয়োজন রয়েছে। মুসলমান বাদে বৌদ্ধ, হিন্দু, জৈন, শিখ, পার্সি বা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের কিছু রাজ্যে আশ্রয় দেওয়া ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক কাঠামো লঙ্ঘন করে কি না, সেই প্রশ্ন উঠে আসছে কিছু মহলে।

More Articles