প্রশান্ত কিশোরের জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় কি আদৌ প্রাণ ফিরবে কংগ্রেসের!

তাকে পাশে পেলে বেশ হয়। আবার না পেলেও চলে ভাবখানা এমনই ছিল এতদিন। কিন্তু আর ঢাক ঢাক গুড় গুড় নয়, পুনর্জ্জীবন পেতে এ বার সরাসরি প্রশান্ত কিশোরের (Prashant Kishor) শরণে কংগ্রেস (Congress)। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করেই মূলত তাঁর দ্বারস্থ হয়েছে গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি। এখন পর্যন্ত সব কিছু সদর্থক ভাবেই এগোচ্ছে। বিগত চার দিনে তিন-তিন বার কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রশান্ত। শুধু পরামর্শদাতা হিসেবে নয়, দলের সদস্যতা গ্রহণ করে তিনি কাজে হাত দেবেন বলে শোনা যাচ্ছে। তার জন্য ১০ নম্বর জনপথে নিত্য আনাগোনা চলছে তাঁর। তবে আড়ালে থেকে কৌশল রচনার বাইরে সক্রিয় রাজনীতিতে প্রশান্তর রেকর্ড একেবারেই নজরকাড়া নয়। তার উপর নেতৃত্বসঙ্কট, অভ্যন্তরীণ সংঘাতের মতো হাজারো সমস্যায় জেরবার কংগ্রেস। তাই প্রশান্তকে পাশে পেলে আদৌ চমকপ্রদ কিছু ঘটবে কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান কংগ্রেসের একনিষ্ঠ নেতা-কর্মীরাই।

২০১৪ সালে দিল্লির মসনদ হাতছাড়া হওয়ার পর থেকে কংগ্রেসের নির্বাচন জয়ের গ্রাফ লাগাতার অধোমুখীই হয়েছে। পর পর দুই লোকসভা নির্বাচনে তো বটেই, একের পর এক রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনেও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে তারা। লাগাতার কমতে কমতে এই মুহূর্তে একার ক্ষমতায় তাদের সরকার রয়েছে মাত্র দুই রাজ্যে, রাজস্থানে এবং ছত্তীসগঢ়ে। ২০২৪-এর আগে ওই দুই রাজ্যেও নির্বাচন রয়েছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, তৃণমূল  এবং আম আদমি পার্টির মতো দলও তাদের টেক্কা দিতে শুরু করেছে। জাতীয় রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ার আগে তাই সনিয়া গান্ধী নিজে প্রশান্ত এবং দলের মধ্যে সমঝোতা স্থাপনে পৌরহিত্য করতে এগিয়ে এসেছেন। আগামী ১৪ থেকে ১৬ মে পর্য়ন্ত রাজস্থানে কংগ্রেসের ‘চিন্তন শিবির’ রয়েছে। তার আগেই প্রশান্তর দলে যোগ দেওয়ার বিষয়টি পাকা করে নিতে চাইছেন তিনি।

কংগ্রেস সূত্রে খবর, প্রশান্ত নিজেও এ ব্যাপারে উৎসাহ দেখিয়েছেন। কংগ্রেস নেতৃত্বের সামনে বেশ কিছু শর্তাবলী রেখেছেন তিনি। সেগুলি খতিয়ে দেখতে বিশেষ কমিটি গড়েছেন সভানেত্রী সনিয়া। এক সপ্তাহর মধ্যে ওই কমিটি রিপোর্ট জমা দেবে। তার ভিত্তিতেই প্রশান্তকে নিয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন এবং তার আগে গুজরাত, হিমাচলপ্রদেশ, কর্নাটক, ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ এবং রাজস্থান—এই ছয় রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসকে চাঙ্গা করতে ইতিমধ্যে একটি নীল নকশা পেশ করেছেন প্রশান্ত নিজেও। তাতে গগনচুম্বী প্রত্যাশার পরিবর্তে কংগ্রেসের জন্য তুলনামূলক ছোট লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছেন তিনি। ৫৪৩ নয়, ২০২৪-এর নির্বাচনে কংগ্রেসকে ৩৭০টি আসনে জয়ের লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছেন। উত্তরপ্রদেশ, বিহার এবং  ওড়িশায় কংগ্রেসকে একলা চলো নীতি নিয়ে এগনোর পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্রে আবার জোটবদ্ধ হয়ে লড়াইয়ের পরামর্শ দিয়েছেন। রাহুল গান্ধীর তরফে তাতে সম্মতিও মিলেছে বলে খবর।

তবে এর আগে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে কংগ্রেসের সঙ্গে ভেস্তে গিয়েছিল প্রশান্ত কিশোরের। ২০২১ সালে বাংলায় তৃণমূলকে জিতিয়ে প্রশান্ত যখন ভোটকৌশলের কাজ থেকে বিরত নেওয়ার ঘোষণা করেন, সেই সময়ও কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনা জারি ছিল। একমাস, দু’মাস নয়, সবমিলিয়ে প্রায় দু’বছর ধরে কথাবার্তা চলছিল তাঁদের মধ্যে। বাংলার নির্বাচনের ফলাফলের পর ২০২১-এর মে থেকে সেপ্টেম্বর—টানা পাঁচ মাস কংগ্রেসের জন্য বরাদ্দ করেছিলেন প্রশান্ত। কিন্তু শেষমেশ ভেস্তে যায় সমঝোতা। পারস্পরিক বিশ্বাস গড়ে না ওঠাতেই সেই সময় কোনও পরিকল্পনাই বাস্তবিক রূপ পায়নি বলে জানান প্রশান্ত। এমনকী কংগ্রেসের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কোনও কালেই তাঁর কাছে সুখকর ছিল না বলে প্রকাশ্যেই মন্তব্য করেন। জানান, ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশে প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরাকে মুখ করে এগোতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাতে আপত্তি ছিল রাহুলের। প্রশান্ত জানান, কোনও দল তাঁকে নিয়োগ করে না, কোন দলের সঙ্গে কাজ করবেন, আর কাদের সঙ্গে কাজ করবেন না, সেই সিদ্ধান্ত তিনি নিজেই নেন। স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে, তাঁর পক্ষে কাজ করা অসম্ভব বলে জানিয়ে দেন।

আরও পড়ুন-গোকুলে বাড়ি ‘সে’! জঙ্গলমহলে নতুন করে মাওবাদী সক্রিয়তা?

এর পরও, ২০১৭-র জয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে ২০২১ সালে পাঞ্জাবের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী তথা প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংহের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন প্রশান্ত। ২০২২-ের নির্বাচনকে সামেন রেখে মন্ত্রীর সমমর্যাদার, ১ টাকা মাসিক বেতনের ওই পদ শুধুমাত্র প্রশান্তর জন্যই সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু নভজ্যোত সিংহ সিধুকে নিয়ে তখন কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে প্রবল বিরোধ চলছে অমরিন্দরের। এমন পরিস্থিতিতে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান প্রশান্ত। কংগ্রেসে যোগ দিতেই এমন সিদ্ধান্ত বেল মনে করা হয়েছিল সেই সময়। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের নেতৃত্বসঙ্কট এবং কর্মশৈলী নিয়ে প্রশ্ন তোলেন প্রশান্ত। গত বছর ডিসেম্বরে, কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে কেন্দ্রে তৃতীয় বিরোধী জোট তৈরির জল্পনা যখন তুঙ্গে, সেই সময় প্রশান্ত বলেন, ‘‘’শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ হিসেবে কংগ্রেস অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ঐশ্বরিক অধিকারের বলে কংগ্রেসের নেতৃত্বের অধিকারী শুধু একজনই হবেন, এই ধারণা থেকে বেরোতে হবে, বিশেষ করে গত ১০ বছরে ৯০ শতাংশ নির্বাচনেই যেখানে হেরে বসে রয়েছে কংগ্রেস। বিরোধী শিবিরের নেতৃত্ব কার হাতে যাবে, তা গণতান্ত্রিক ভাবেই ঠিক হওয়া উচিত।’’

আরও পড়ুন-ছাত্র বলছে, ‘শিক্ষকের কলার ধরতে পারি’, কে এই যাদবপুরের ছাত্রনেতা সঞ্জীব?

প্রশান্তর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার পিছনে যদিও কংগ্রেসের তরফে অন্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। বাংলায় বিজেপি-র বাড়-বাড়ন্ত যখন চরমে, সেই সময় প্রশান্তর কৌশল ধরে এগিয়েই বিপুল সমর্থন পেয়ে তৃতীয় বার বাংলায় ক্ষমতায় ফেরেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অতীতে কংগ্রেস করলেও, সনিয়া-রাহুলের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলেও, বাংলায় মমতার দল তৃণমূলের সঙ্গে সাপে নেউলে সম্পর্ক কংগ্রেসের। বিজেপি বিরোধী জোটের নেতৃত্ব নিয়ে মমতা নিজেও কংগ্রেসের ভূমিকার সমালোচনা করে এসেছেন লাগাতার। একাধিক রাজ্যে কংগ্রেস নেতাদের ভাঙিয়ে নিজের দলে টেনেছেন। তাই অল্প দিনের মধ্যে মমতার সুহৃদ হয়ে ওঠা প্রশান্তর হাত ধরার ক্ষেত্রে স্বার্থের সংঘাত দেখতে পান কংগ্রেস নেতৃত্ব।

তার উপর প্রশান্তর আদব-কায়দাও তাঁদের বিশেষ পছন্দ হয়নি বলে শোনা যায়। দলীয় সূত্রে খবর, নামসর্বস্ব নেতা হয়ে পদ আঁকড়ে বসে থাকা কংগ্রেস নেতাদের বাতিলের খাতায় ফেলে দিতে চেয়েছিলেন প্রশান্ত। বিদ্রোহের আশঙ্কা করে সেই ঝুঁকি নিতে চাননি কংগ্রেস নেতৃত্ব।

তাহলে কি সেসব নিয়ে আর কোনও আপত্তি নেই কংগ্রেস নেতৃত্বের? নির্বাচন সংক্রান্ত তাঁর যাবতীয় সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ায় সায় রয়েছে তাঁদের? নরেন্দ্র মোদির ডান হাত হয়ে অমিত শাহ যেমন নেতা-মন্ত্রী, কাউকে দৌড়ঝাঁপ থেকে নিস্তার দেন না, প্রশান্ত চাইলেও, শতাব্দীপ্রাচীন দলের নেতৃত্বকে তাঁর এই খবরদারি মেনে নেবেন কিনা, সেই নিয়েও ধন্দ রয়েছে। একই সঙ্গে ভোটকুশলী প্রশান্ত এবং রাজনীতিক প্রশান্তর মধ্যেকার বিরাট ফারাকটা নিয়েও কৌতূহল রয়েছে মানুষের। কারণ গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী পদে মোদিকে টিকিয়ে রাখা প্রশান্ত সক্রিয় রাজনীতিতে এসেছিলেন নীতীশ কুমারের হাত ধরে। এককথায় তাঁকে দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি করে দিয়েছিলেন নীতিশ। কিন্তু সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে মতানৈক্যের জেরে রাতারাতি নীতীশের দলকে বিদায় জানান প্রশান্ত। কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতাদের নিয়ে তিনি ধৈর্য রাখতে পারবেন কিনা, নাকি মাঝরাস্তায় রণে ভঙ্গ দেবেন, সেই আশঙ্কাও জাগছে অনেকের মনে।

তাই দু’পক্ষের রফাসূত্র কংগ্রেসের কাছে যেমন চ্যালেঞ্জের, তেমনই প্রশান্তর কাছেও অগ্নিপরীক্ষার সমান বলে মনে করছেন অনেকে। কারণ ২০১৪ সালে মোদির জন্য দিল্লির পথ সুগম করে তোলা প্রশান্ত এখন ঘোষিত ভাবেই মোদিবিরোধী হয়ে উঠেছেন। সরাসরি ‘সাহেব’কে ভোটের ময়দানে দেখার চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন। তাই গায়ে হেরো দলের তকমা সেঁটে যাওয়া কংগ্রেসকে নবজন্ম দেওয়া তাঁর ব্যক্তিগত তাগিদও বটে।

একের পর এক জয়ের মাধ্যমে প্রশান্ত যথার্থ ভাবেই ভোটকৌশলের সংজ্ঞা তৈরি করেছেন। কিন্তু এ যাবৎ বরাবরই বিজয়ী দলের সৈনিক হিসেবে দেখা গিয়েছে তাঁকে। অর্থাৎ ক্ষমতাসীন দলকে পুনরায় মসনদ দখলে অথবা দাপুটে বিরোধী নেতাকে জেতানোর কাজেই সফল হতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। কিন্তু মৃতপ্রায় অবস্থা থেকে কংগ্রেসকে জিয়নকাঠি ছুঁইয়ে বাঁচিয়ে তোলার গুরুদায়িত্ব পালনে তিনি সফল হবেন কিনা, নাকি আগের মতই এ বারও আলোচনা ফলপ্রসূ হবে না, তা সময়ই বলবে।

More Articles