রামপুরহাট কাণ্ডে ‘সিট’ কি অপরাধী শনাক্ত করতে পারবে? কী বলছে ইতিহাস?

ঘুমের মধ্যে ১৩টি প্রাণ চলে গেল রামপুরবহাটে। এ নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই রাজ্যের মানুষ উদ্বিগ্ন। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বহু লোক। এ নিরাপত্তাহীনতা ভিত্তিহীন নয়। তৃতীয়বার তৃণমূলের জয়ের পর থেকেই লাগাতার চলেছে এই হিংসাত্মক ঘটনার বাড়াবাড়ি। তবে এবার সমস্ত নজির ছাড়িয়ে গিয়েছে। ১৩জন মানুষ খুন এক রাতে। শিশু, বৃদ্ধ, মহিলা—কে নেই। তারই মধ্যে নিজেদের বয়ানের স্ববিরোধিতায় ঘুরপাক খাচ্ছে শাসকদল। অনুব্রতর হাস্যকর দাবিকে আমল দেননি মমতা স্বয়ং। এদিকে রাজ্য জুড়ে বেড়ে চলা বিক্ষোভ সামাল দিতে খানিকটা চাপের মুখেই তৃণমূল। শাসক দলের এবং প্রশাসকের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। মিলছে দমকল ও পুলিশের বয়ানও। বেগতিক দেখে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা স্বীকার করেছে রাজ্য সরকার। সরিয়ে ফেলা হয়েছে এসপিডিও সায়ন আহমেদ এবং ইন্সপেক্টর ইনচার্জ প্রামাণিককেও। তদন্তের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে সিট। কিন্তু তাতে কি সুরাহা হবে, সিট কি পারবে অপরাধীদের সামনে এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিবিধান সুনিশ্চিত করতে?

 সিট (SIT) হল ‘স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টীম’ বা বিশেষ তদন্তকারী দল। মূলত কোনও গুরুতর অপরাধের সুরাহা করতে যখন স্থানীয় প্রশাসন অপারগ, তখন এই দল গঠন করা হয়। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট, ইউনিয়ন গভর্নমেন্ট এবং স্টেট গভর্নমেন্টের কাছে এই ক্ষমতা থাকে। ফলে খাতায় কলমে এর গুরুত্ব রয়েছে বেশ। এবারও সিট গঠন করে তদন্তে ১১ জনকে এপর্যন্ত গ্রেফতার করেছে সরকার। কিন্তু অভিযোগ যখন শাসকদলের বিরুদ্ধে, ঘটনা যখন চেপে দিতে চেয়েছেন টিভি বাস্টের আড়ালে খোদ অনুব্রত, দায় তখন থাকেই প্রশ্নের, কতটুকু সফল হবে রাজ্যের বিরুদ্ধে রাজ্যেরই তদন্তকারী দল? ফলাফলের একটা অনুমান অবশ্যই করা যায়। সে অনুমান সত্য হয়ে ওঠে যদি এ পর্যন্ত রাজ্যে হওয়া বিভিন্ন অপরাধে আমরা যদি সিটের সাফল্য এবং ব্যর্থতার দিকটি পর্যালোচনা করি। ট্র্যাক রেকর্ড কী বলছে তার?

বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত ২০১৪ সালে পাড়ুই হত্যাকাণ্ডের বিচার চলাকালীন সিটের ভূমিকায় এতটাই বিরক্ত হয়েছিলেন, যে তৎকালীন সিটের প্রধান রাজ্যপুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হবে না কেন–সেই প্রশ্ন পর্যন্ত তোলেন তিনি। এই ঘটনার কয়েকদিন আগেই লাভপুরে আদিবাসী নারীকে গণধর্ষণের ঘটনায় রাজ্য প্রশাসনের তীব্র সমালোচনা করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। সারদা কাণ্ডে সিটের বিপুল ব্যর্থতার কথা সবারই মোটামুটি জানা।

এরপরে পাড়ুই-কাণ্ডে সিআই ডির ওপর ভরসা না করে হাইকোর্ট নিজেই সিট গড়ে দিয়েছিল। কিন্তু দেড় মাসেও তদন্তের কাজ কিছুই হয়নি স্বীকার করতে বাধ্য হয় রাজ্য সরকার। দীপঙ্কর দত্ত এজলাসে এও জানতে চেয়েছিলেন, কার ভয়ে তদন্ত করছেন না ডিজি? এমনকী সিবিআই-এর হাতে তদন্ত ছাড়তে চাইলে সরকারি কৌঁসুলি মিনতি শুরু করে সিবিআইয়ের কাছে যেন তদন্ত না যায়! ব্যাপার দেখে চক্ষু চড়কগাছ সবার। বিচারপতির প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে সরকারি কৌঁসুলি নজিরবিহীন ভাবে এজলাস থেকে সাংবাদিকদের বের করে দেওয়ার আর্জি জানান৷ যদিও তা খারিজ হয়। এজলাসে হাজির থেকে সংবাদ সংগ্রহ সংবাদমাধ্যমের সাংবিধানিক অধিকার৷ আদালত কোনও ভাবেই সেই অধিকারে হস্তক্ষেপ করবে না বলেই জানান বিচারপতি। শাসকদলের তৎকালীন বীরভূম জেলা সভাপতি ছিলেন সেই অনুব্রত মণ্ডল। যিনি এবার দশটি বাড়ি ‘টিভি বাস্ট হয়ে’, ‘শর্ট সার্কিটে’ পুড়ে গিয়েছে বলে দাবি করেছেন। সেবারও তাঁর প্ররোচনামূলক ভাষণের পরপরই সাগর ঘোষের বাড়িতে হামলা করা হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে খুন হন ওই বৃদ্ধ। সেই ভাষণের অসম্পাদিত ভিডিওটি কোর্টে পেশ করার অনুরোধ করেছিলেন বিচারপতি সংবাদ মাধ্যমের কাছে। শুনানির সময় অম্বিকেশ মহাপাত্র প্রসঙ্গও টেনে আনেন বিচারপতি। কার্টুনকাণ্ডে যদি এফআইআর ছাড়াই গ্রেফতার করতে পারে পুলিশ, এক্ষেত্রে এফআইআর থাকা সত্ত্বেও কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না–এও জানতে চান বিচারপতি। সদুত্তর দিতে পারেনি সরকারি কৌঁসুলি। ডিজির একটি চিঠি পেশ করা হয় আদালতে, যেখানে ডিজি জানিয়েছেন লোকসভা ভোট নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তদন্তের তেমন সময় পাচ্ছেন না তিনি। এই ঘটনার পরেই অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বিচারপতি দত্ত কেন ডিজির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হবে না তা জানতে চান।

এ তো গেল বেশ কয়েক বছর আগের কথা। সম্প্রতি ছাত্রনেতা আনিস খান হত্যা তদন্তেও সিটের ভূমিকা খুব একটা উজ্জ্বল নয় এখনও পর্যন্ত। সি আই ডি অফিসারদের সঙ্গে নিয়ে হঠাৎ করেই আনিসের বাড়িতে হানা দিয়ে তার মোবাইল হস্তান্তরের নোটিশ ধরিয়ে দেয় সিটের সদস্যরা। দশ মিনিট সময় দেওয়া হয় নোটিশ গ্রহণের জন্য। এমনকি চাপ সৃষ্টি করা হয় বলেও অভিযোগ। নোটিশ গ্রহণ না করলে থানায় তাদের নামে এফ আই আর করা হবে বলে শাসানো হয় তাদের। কিন্তু আনিসের বাবা নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। রাজ্য পুলিশে তাঁর আস্থা নেই, একমাত্র সিবিআইয়ের কাছেই ছেলের ফোন দিতে রাজি তিনি। দরকারে কবর থেকে তুলে ফের ছেলের ময়নাতদন্ত করবেন বলেও জানিয়েছিলেন আনিসের বাবা।

আবার এই তদন্তে সিটের মাথা জ্ঞানবন্ত সিং। ২০০৭ সালে রিজওয়ানুর রহমাওকে আত্মহত্যা করার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন তৎকালীন উপ-নগরপাল (সদর) এই জ্ঞানবন্ত সিং। তৃণমূল তখন বিরোধী দল। বিরোধীদের লাগাতার আন্দোলনে চাপের মুখে পড়ে বামফ্রন্ট সরকার উপ-নগরপাল (সদর) পদ থেকে তাকে অপসারিত করে এবং দীর্ঘদিন তার পদোন্নতি আটকে থাকে। সেই জ্ঞানবন্ত সিং-কে মমতাই আবার আনিস হত্যা কাণ্ডের তদন্তে সিটের প্রধান করেন। এ প্রসঙ্গে রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন এডিজি নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, "এই জ্ঞানবন্ত সিংকেই রিজওয়ানুর রহমান কাণ্ডে দায়ী করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূল কংগ্রেস, কিন্তু এখন হাওড়ার আনিস খুন কাণ্ডে সিটের মাথা তাঁকেই করা হয়েছে। মানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন, যে কোনও পুলিশ আধিকারিকই হোক না কেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে তদন্ত চাইবেন, সেই ভাবেই তদন্ত করবেন সংশ্লিষ্ট ওই পুলিশ আধিকারিক৷” ফলে কতটা স্বচ্ছ ভাবে তদন্ত হবে এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি। সে সংশয় যে ভিত্তিহীন নয়, তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। 

বগতুই গণহত্যা কাণ্ডে রাজ্যের তরফে একটি বিধায়ক প্রতিনিধি দলকে সরেজমিনে ব্যাপারটি খতিয়ে দেখতে পাঠিয়েছেন মমতা। নেতৃত্বে মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। মনে রাখা প্রয়োজন, খুব বেশিদিন আগে না, গত ১৯ মার্চই রাজ্যে ক্রম বর্ধমান হিংসাত্মক ঘটনা নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে, “দুষ্কৃতীরা যদি না থাকে তবে তো পুলিশ ব্যাপারটাই উঠে যাবে” জাতীয় মন্তব্য করেছেন ফিরহাদ হাকিমই। বোঝাই যাচ্ছে এ ব্যাপারে কী ধ্যান-ধারণা রাখেন তিনি। সিট দিয়ে তদন্ত করানো খাতায় কলমে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হলেও, ইতিহাস পর্যালোচনা করে আমরা প্রমাণ পাচ্ছি যে সমস্ত তদন্তটাই রাজ্যের ক্ষমতাধীন। রাজ্য যেমনটি চাইবে ঠিক তেমনটিই বইবে হাওয়া। দরকারে মাসের পর মাস তদন্তের নামে কিছুই করা হবে না। মানুষের স্মৃতি থেকে ধীরে ধীরে ঘটনার ভয়াবহ অভিঘাতটুকু মুছে গেলেই নিশ্চিন্তি। ততদিন কিছু স্কেপগোট ব্যবহার করা হবে। যেমন ১১ জন গ্রেফতার হয়েছে। আদতে এরা চুনোপুঁটি রাঘব বোয়ালেরা নাগালের বাইরেই দিব্যি আরামে থেকে যাবে। মূল সমস্যারও কোনও সমাধান হবে না। আপাতত সিটের নেতৃত্বে বগতুই গণহত্যা কাণ্ডের তদন্ত ঠিক কোনদিকে এগোয় সেটুকুই দেখার!

More Articles