নির্বাচন জিততে ম্যাজিক নয়, দরকার অধ্যাবসায়, যা শেখাচ্ছে গুজরাত মডেল

Gujarat Election : যেখানে মোদী ম্যাজিক কাজ করে না, সেখানে বিজেপি-বিরোধী দলগুলির প্রত্যয় রয়েছে

সদ্য সমাপ্ত গুজরাত ও হিমাচল প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরের দিন একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি খবরের কাগজের প্রথম পাতার হেডলাইনটির তর্জমা করলে দাঁড়ায় — গুজরাতে মোদীরথে ধুলিসাৎ কংগ্রেস। তথ্যগত এবং আক্ষরিকভাবেও এতে কোনও ভুল নেই। পশ্চিম ভারতের এই রাজ্যে গত ২৭ বছর ধরে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসতে পারেনি। ১৮২ আসনের বিধানসভায় কংগ্রেস মাত্র ১৭টি আসন পেয়েছে। সেখানে বিজেপি ১৫৬টি আসন পেয়ে রেকর্ড গড়েছে। এর আগে গুজরাতে কোনও দল একসঙ্গে এত আসন পায় নি। কংগ্রেস পেয়েছে ২৭ শতাংশ ভোট, আম আদমি পার্টি ১২.৯ শতাংশ আর বিজেপি একাই পেয়েছে ৫২.৫ শতাংশ।

গুজরাত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের রাজ্য। সেখানে বিজেপির জয়জয়কারে মিডিয়াতেও উলুধ্বনি উঠবে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। গুজরাতে মোদীই যে শেষ কথা, তা আমাদের অজানা নয়। ভোটের আগে সে রাজ্যের আম জনতা ও পার্টি কর্মীদের মুখে মোদীর নামই ছিল সর্বাগ্রে। আমাদের রাজ্যের ছেলে দেশের প্রধানমন্ত্রী, তিনিই সবার কল্যাণের জন্য কাজ করছেন, তিনিই বিশ্ব নেতা — এই ভক্তিভাব তো অস্বাভাবিক নয়। তো সেখানে মোদীরথ গড়গড়িয়ে এগোবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মোদীরথ বেশ টলমল ছিল এই রাজ্যেই। তখন মুখ্যমন্ত্রীত্ব ছেড়ে সবে বছর তিনেক দিল্লির দায়িত্ব নিয়েছিলেন মোদী। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন অমিত শাহকে। পাতিদারদের আন্দোলন, নেতৃত্বের অভাব — সব মিলিয়ে চাপেই ছিল বিজেপি। তার ফলও দেখা গিয়েছিল নির্বাচনে। ১২২ থেকে নেমে গিয়ে ৯৯ টি আসন জিতেছিল তারা। কংগ্রেস ছিল কাছাকাছি। ৭৭টি আসন জিতে।

আরও পড়ুন - মোদি মন্ত্র নাকি অন্য চাল? চব্বিশের রাস্তা কতটা মসৃণ করল গুজরাত মডেল?

সেই বছরই কংগ্রেস নেতা আহমেদ পটেল রাজ্যসভার নির্বাচন জিতেছিলেন অমিত শাহদের সমস্ত কৌশলকে পিছনে ফেলে দিয়ে। রাজ্যসভার নির্বাচনের ঠিক আগেই কংগ্রেসের ছয় জন বিধায়ক বিদ্রোহ করে ইস্তফা দিয়েছিলেন। অভিযোগ ছিল বিজেপির ইন্ধনেই এই ইস্তফা। তার পর নির্বাচনের দিন দু'জন বিদ্রোহী বিধায়ক তাদের ব্যালট পেপার অমিত শাহকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। এই অভিযোগের স্বীকৃতি দেয় নির্বাচন কমিশন। বাতিল হয় সেই দুটি ভোট। ৪৪টি ভোটের দরকার ছিল আহমেদ পটেলের। জিতে যান তিনি। বাকি দুটি আসনে অমিত শাহ ও স্মৃতি ইরানি জিতেছিলেন।

সে সব এখন অতীত। নরেন্দ্র মোদী দিল্লির মসনদে বসার পরে গুজরাত বিজেপি দলেরই তিন জন মুখ্যমন্ত্রীকে দেখেছে। কিন্তু এই কয়েক বছরে নিজেদের বাগান যথাযথভাবে সাজিয়ে নিয়েছেন মোদী-শাহেরা। পাতিদার নেতা হার্দিক পটেলকে নিজেদের দলে টেনে নিয়েছেন। তার আগেই ওবিসি নেতা অল্পেশ ঠাকোরকে নিজেদের দলে জায়গা দিয়েছেন (দু'জনই ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে যথেষ্ট বেগ দিয়েছিলেন। কংগ্রেস থেকেই তারা বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন)। অন্যদিকে আম আদমি পার্টির 'গুণগান' করে বিরোধী পরিসরে কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বীকে জায়গা করে দিয়েছেন গুজরাটে। কংগ্রেস মাথাই তুলতে পারেনি আর।

এই পরিস্থিতিতে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির রথকে রুখত পারত কে? যাঁরা আম আদমি পার্টিকে অনেক নম্বর দিয়ে রেখেছিলেন, তাঁরা বুঝে গেছেন নিশ্চয়ই বিজেপি ২০১৭ সালে পাওয়া ৪৯.৪৪ শতাংশ ভোটকে কীভাবে ৫২ শতাংশে নিয়ে গেছে। আর কংগ্রেস প্রায় ৪৩ শতাংশ থেকে নেমে ২৭ শতাংশে চলে গেছে। আম আদমি পার্টি ০.৬২ শতাংশ থেকে নিজেদের ভোটের ভাগ প্রায় ১৩ শতাংশে নিয়ে গেছে।

যেখানে মোদী আছেন, সেখানে ভোটের মুখেই মোরবিতে ঝুলন্ত ব্রিজ ভেঙে ১৩৫ জনের মৃত্যু হলেও সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করে বিজেপি প্রার্থীকে হারিয়ে দেন না। সব মাফ করে দেন।

এ তো গেল গুজরাতে মোদীরথের কথা। কিন্তু সেই রথের চাকা কেন হিমাচল প্রদেশে বসে গেল? সেই রথ কেন দিল্লি পুরসভার রাস্তায় চলে না? সে রাজ্য়ও বিজেপির শীর্ষ নেতা, জাতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ডার রাজ্য। সেখানে বিজেপি কেন আবার সরকারে ফিরতে পারল না? দিল্লি পুরসভার দখল কীভাবে আম আদমি পার্টির হাতে চলে গেল?

আসলে মোদীরথ, মোদী-ম্যাজিক একটি মিথের মতো। সেই ম্যাজিক সেখানেই কাজ করে যেখানে বিরোধীরা অত্যন্ত দুর্বল। বিরোধী শিবির যেখানে নিজেদের উপরেই বিশ্বাস করে না। যেখানে লড়াইয়ের পরিস্থিতিই তৈরি করে না। মানুষের ইস্যুগুলোর উপর নজর দেয় না। সেই সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য চেষ্টা করে না। আর শাসক দলের অন্দরের ঝামেলাকে নিজেদের কাজে লাগানোর চেষ্টা করে না।

হিমাচলে বয়স্কদের পেনশন ব্য়বস্থা চালু করার দাবি ছিল। কাজের অভাবের অভিযোগ ছিল। কৃষক আন্দোলনের প্রভাব সামান্য হলেও সে রাজ্যের ভোটারদের প্রভাবিত করেছিল। সঙ্গে ছিল বিজেপির গোষ্ঠীকোন্দল। সেখানে নরেন্দ্র মোদীর ডবল-ইঞ্জিন সরকার বা ৩৭০ ধারা বিলোপ বা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার কোনও প্রতিশ্রুতি বা বক্তব্যই কাজে লাগেনি। স্থানীয় কংগ্রস নেতৃত্বই দলকে নির্বাচনের ময়দানে নিয়ে গেছেন। জিতেছেন। শুধুমাত্র প্রিয়াঙ্কা গান্ধী কিছুদিন প্রচার করেছেন। প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বীরভদ্র সিংহের স্ত্রী প্রতিভা সিংহের নেতৃত্বে রাজ্যে লড়েছে কংগ্রেস। রেওয়াজ মেনে পাঁচ বছর অন্তর যেভাবে সরকার বদল করেন হিমাচলীরা, সেভাবেই কংগ্রেস এবার ক্ষমতায় এসেছে।

শুধু এখানেই নয়। দিল্লিতেও আম আদমি পার্টির সরকার যেভাবে স্থানীয় স্তরে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন এনেছে, ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়িয়েছে, বিদ্যুৎ বিল মকুবের মতো জনমোহিনী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে দিল্লিবাসী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের হাতেই দিল্লির সরকারের মতো পুরসভার দায়িত্বও তুলে দিয়েছেন। সেখানেও জনগণের দরবারে আপের নেতাদের উপর তোলা দুর্নীতির অভিযোগ ধোপে টেঁকেনি।

শুধু হিমাচল বা দিল্লি নয়, মোদী ম্যাজিক পঞ্জাবেও কাজে আসেনি। কৃষক আন্দোলনে নাজেহাল বিজেপি কিছুই করে উঠতে পারেনি সে রাজ্যে। কৃষি বিল প্রত্যাহার করেও কাজ হয়নি। মোদী ম্যাজিক পশ্চিমবঙ্গেও কাজ দেয়নি। নিজেদের ভুলগুলি শুধরে, ভোটকুশলীদের সাহায্য নিয়ে সংগঠনকে আঁটোসাঁটো করে এবং মানুষের কাছে জনগণের ইস্যুকে সামনে রেখে বাংলার মেয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিতেছিলেন মোদী-শাহদের বিরুদ্ধে। মোদী ম্যাজিক বিহার বা ওড়িশাতেও কাজ করে না। তেলেঙ্গানাতেও না। ঝাড়খন্ডেও কাজ করেনি। কর্ণাটক বাদ দিলে বাকি দক্ষিণী রাজ্যগুলিতে আঞ্চলিক দলগুলি মোদী-ঝড়ে উড়ে যায় না। যেখানে বিজেপি-কংগ্রেস দ্বৈরথ হয়, সেই মধ্যপ্রদেশেও কংগ্রেসের জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে ভাঙিয়ে এনে সরকার গড়তে হয় বিজেপিকে। ছত্তিশগড়ে বিজেপি ক্ষমতায় ফিরতে পারে না।

আরও পড়ুন - গুজরাত ভোটে তিনিই ‘চাণক্য’, অমিত শাহর ছোট্ট চালে যে ভাবে কিস্তিমাত ‘ব্র্যান্ড মোদি’-র

লক্ষ্য করে দেখবেন যেখানে মোদী ম্যাজিক কাজ করে না, সেখানে বিজেপি-বিরোধী দলগুলির প্রত্যয় রয়েছে। তা নবীন পট্টনায়কের বিজেডি হোক বা চন্দ্রশেখর রাওয়ের তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি বা অন্ধ্রের জগন্মোহন রেড্ডির ওয়াইএসআর কংগ্রেসের হোক।

যেখানে মোদী-ম্যাজিক কাজ করে সেই উত্তরপ্রদেশে মায়াবতীকে খুঁজেই পাওয়া যায় না। অখিলেশ হাতড়ে বেড়াচ্ছেন নিজের জায়গা।

আর এই হিসেবে, জাতীয় স্তরে মোদীরথের বাড়বাড়ন্তও সহজেই বোঝা যায়। রাহুল গান্ধী পারেননি। আর কোনও নেতাও মোদীর মুখোমুখি নিজেকে তুলে ধরতে পারছেন না। সঙ্গে লোকসভা নির্বাচন এলেই বিজেপির সাংগঠনিক তৎপরতা কীভাবে বেড়ে যায়, তা ২০১৪ এবং ২০১৯-এ আমরা দেখেছি। ২০২৪-এর প্রস্তুতিও তুঙ্গে। সে তুলনায় বিরোধী দলগুলির মোদীর বিরুদ্ধে নিজেদের শক্তিশালী হিসেবে তুলে ধরার মনোভাবে ঘাটতি রয়েছে। সেই ঘাটতি জাতীয় স্তরে বিরোধীরা মেটাতে পারলে মোদীরথের চাকা মাটিতে বসতে বাধ্য। কারণ ইস্যু রয়েছে, অসন্তোষ রয়েছে, শাসক-বিরোধী মনোভাবও জনগণের একাংশের মধ্যে রয়েছে। যেভাবে গুজরাতে আপের মধ্যে বিজেপি-বিরোধী শক্তিকে খুঁজেছেন গুজরাতিদের একাংশ, সেভাবেই জাতীয় স্তরেও শক্তিশালী বিরোধীদের খুঁজে নেবেন ভোটাররা। সেই ক্ষেত্র প্রস্তুত তো করতে হবে!

যাঁরা ভাবছেন, অরবিন্দ কেজরিওয়াল বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোদীর বা বিজেপির যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবেন জাতীয় স্তরে, তাঁদের জন্য লেখা থাকবে অন্য কোনও কিস্তিতে।

More Articles