ফিদেল-মারাদোনা-কলকাতা-ফুটবল! আর্জেন্টিনার জয়ে আজও কেন জিতে যায় বাঙালি?
World Cup Final 2022: মেসির আর্জেন্টিনা এমবাপে-গ্রিজম্যান-জিরুর ফ্রান্সকে ফাইনালে হারাতে পারবে কিনা সেটা দেখার জন্যে রাত জাগবে বাঙালি। হ্যাঁ, চন্দনগরের একদা ফরাসি উপনিবেশের বাঙালিরাও।
সালটা ১৯৮৪। তখন নারকেলডাঙার ডা. বিধানচন্দ্র রায় মেমোরিয়াল হসপিটালে চিলড্রেনের (এখন পেডিয়াট্রিক ইন্সটিটিউট) হাউজস্টাফ আমি। মাস ছয়েক আগে বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটের মেডিকেল কলেজ মেন হোস্টেল থেকে বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে এখানকার হাউজস্টাফ কোয়ার্টারে এসে উঠেছি। ফুলবাগান মোড় তখন আমাদের চা খেতে যাওয়ার জায়গা। ওখানে বসেই সল্টলেক স্টেডিয়ামে চলা নেহরু কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের খেলা দেখতে যাওয়ার প্ল্যান হল।
ফুলবাগান মোড় থেকে হেঁটে সুভাষ সরোবরের পাশ দিয়ে সল্টলেক স্টেডিয়ামে পৌঁছতে মিনিট দশ-পনেরো লাগত। কয়েক বছর আগেই ফ্রান্সিকোলির উরুগুয়ে খেলে গেছে কলকাতায় প্রথম নেহরু কাপে। প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি তখন ভারতীয় ফুটবলের সর্বময় কর্তা হওয়ায় কলকাতা ছিল ফুটবলের পীঠস্থান।
ভারত-আর্জেন্টিনার খেলার দিন আমার ইমার্জেন্সিতে ডিউটি পড়ায় মাঠে যেতে পারিনি। ডিউটি দিতে দিতেই ফাঁকফোঁকরে হাসপাতালের ডক্টরস রুমের টিভিতে দেখি। ভারত আর্জেন্টিনার কাছে এক গোলে হেরে যায়। আর্জেন্টিনা দলটি তখন উঠতি প্রতিভায় ঠাসা। এই দলের চার পাঁচজন ফুটবলার দু'বছর পরে ১৯৮৬-তে মেক্সিকোয় অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলেছেন। গোলে নেরি পম্পিদো, ডিফেন্সে রিকার্ডো জিউস্তি, অস্কার গারে, মাঝমাঠে জর্জ বুরুচাগা এই নেহরু কাপের দল থেকে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পেয়েছিলেন।
এছাড়া আগুয়েরো, পনসে, গ্যারেকা, ক্যামিনোর নাম মনে পড়ছে। গ্যারেকাই আর্জেন্টিনার হয়ে জয়সূচক গোলটি করেছিলেন। বলাবাহুল্য আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে খেলা ভারতীয় দলটিও বেশ শক্তিশালী ছিল। গোলে অতনু ভট্টাচার্য, মাঝমাঠে প্রশান্ত ব্যানার্জিকে সাবলীলতার জন্য মনে আছে। কোচ চিরিচ মিলোভান নতুনদেরও সুযোগ দিয়েছিলেন। পুরো দলটা ছিল,
অতনু ভট্টাচার্য, বিকশ পাঁজি, প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, পারমিন্দর সিং, ভিক্টর অমলরাজ, আর্নল্ড রডরিগস, বাবু মানি, বিদেশ বোস, সাবির আলি, অরূপ দাস, কৃশাণু দে, বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য, নরেন্দ্র থাপা।
কোচ- চিরিচ মিলোভান (যুগোস্লাভিয়া)
মনে আছে রিকার্ডো গ্যারেকার গোলে ভারত হেরে যায়। লম্বা চুলের গ্যারেকা পেনাল্টি বক্সে বুক দিয়ে বলটা ট্র্যাপ করে গোলে পাঠান ভলিতে। অতনুর কোনও সুযোগ ছিল না সেভ করার।
আরও পড়ুন- মেসিকে চূড়ান্ত অপমান করছিলেন মারাদোনা? কোন শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন
১৯৮৪ তে কলকাতায় অনুষ্ঠিত নেহরু কাপে মোট ৫টি দল এসেছিল। আর্জেন্টিনা, পোল্যান্ড, চিন, হাঙ্গেরির ভাসাস বুদাপেস্ট, রোমানিয়া যুবদলের সঙ্গে হোস্ট কান্ট্রি ভারত সেবার নেহরু কাপে অংশ নেয়। রাউন্ড রবিন প্রথায় প্রত্যেক দল প্রত্যেকের সঙ্গে খেলে। আর্জেন্টিনা চিনের কাছে হেরে ফাইনালে যেতে ব্যর্থ হয়। পয়েন্টে তিন নম্বরে থাকে। পোল্যান্ড শীর্ষস্থানে ও চিন দ্বিতীয় স্থানে থাকে। ফাইনাল পোল্যান্ড চিনকে ১-০ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। পয়েন্টে তিন নম্বরে থাকা আর্জেন্টিনা চার নম্বরে থাকা ভাসাস বুদাপেস্টকে হারিয়ে তৃতীয় স্থান পায়। ভারতের বিরুদ্ধে গোলকারী রিকার্ডো গ্যারেকা যুগ্মভাবে টপস্কোরার হয়েছিল টুর্নামেন্টে।
এই গ্যারেকাকে কিন্তু আর্জেন্টিনার ৮৬-র বিশ্বকাপ দলে আর দেখা যায়নি। বুরুচাগার যেমন হাউইয়ের গতিতে উত্থান হয়, গ্যারেকার সেটা হয়নি। দিয়েগো মারাদোনা, জর্জ ভালদানো, ব্রাউন, বাতিস্তা (বাতিস্তুতা নয়), রিকার্ডো জিউস্তি, জর্জ বুরুচাগা, নেরি পম্পিদো (গোল), অস্কার গারেদের আর্জেন্টিনা তখন দুনিয়া কাঁপানো দল। কার্লোস বিলার্দো তখন কোচ। ৭৮ বিশ্বকাপের ড্যানিয়েল পাসারেলাও দলে ছিলেন।
কীভাবে কোয়ার্টারফাইনালে মারাদোনা ইংল্যান্ডের রক্ষণভাগের পাঁচজনকে কাটিয়ে গোল করেছিলেন, তা আমাদের স্মৃতিতে এখনও জ্বলজ্বল করছে। তার আগে প্রথম গোলটিতে অবশ্য মারাদোনার বিখ্যাত হ্যান্ড অফ গডের ভূমিকা ছিল। পিটার শিলটনের মতো গোলকিপারও সেটার হদিশ পাননি। তখন অবশ্য ভিএআর প্রযুক্তি ছিল না।
ফাইনালে জার্মানির বিরুদ্ধে জয়সূচক গোলটি করে বুরুচাগা। সেই বুরুচাগা, দু'বছর আগে যে সল্টলেকের যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন মাতিয়ে গেছে। বলাবাহুল্য ফাইনাল পাসটি বাড়িয়েছিল দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা। মারাদোনা কিন্তু ৮৪-র নেহরু কাপে আর্জেন্টিনা দলের সদস্য ছিল না। সেই খামতি তিনি পূরণ করে দিয়েছিলেন পরিণত বয়সে কলকাতায় এসে সল্টলেক স্টেডিয়ামের খেলায়। ২০০৮-এ তিনি প্রথমবার কলকাতায় আসেন। যদিও একটি দু'টি শট মেরেই তিনি উঠে যান। মন্ত্রীরা তাঁকে 'মিস্টার মারাদোনা' বলে ডেকে কৃতার্থ হয়েছিলেন। জ্যোতি বসুর সঙ্গে সাক্ষাতে চে গুয়েভারা ও ফিদেল কাস্ত্রোর প্রসঙ্গ ওঠে। প্রসঙ্গত, মারাদোনার ব্যক্তিগত বন্ধু ছিল ফিদেল কাস্ত্রো। জ্যোতি বসু কলকাতায় ফিদেল কাস্ত্রোকে সম্বর্ধনা জানিয়েছিলেন শুনে তিনি খুব খুশি হন।একথাও বলেছিলেন, কাস্ত্রোর বন্ধুরা পরস্পর পরস্পরের বন্ধুও বটে।
এরপর ২০১৭-য় তিনি একটি স্কুল ও একটি সংস্থার তরফে ফের একবার কলকাতায় আসেন। নিজের একটি মূর্তির আবরণ উন্মোচন করেন এ যাত্রায়। সল্টলেক স্টেডিয়ামে বল নিয়ে কেরামতি দেখিয়েছিলেন কিছুক্ষণ। উপস্থিত ছিলেন মারাদোনাপ্রেমী সৌরভ গাঙ্গুলিও। মন্ত্রী সুজিত বসু মারাদোনার হাত দিয়ে জনকল্যাণমূলক কিছু কাজ করান। তবে মদন মিত্রর মারাদোনায় মেসিভ্রম বা মেসিতে মারাদোনাভ্রম কেন হল এই ক'বছরেই, তা দেবা ন জানন্তি কুতঃ মনুষ্যা।
আরও পড়ুন- মারাদোনার ভূত তাড়া করছে ক্রোয়েশিয়াকে! অবিশ্বাস্য অ্যালভারেজকে দেখে যা বলছে বিশ্ব
আসলে বাঙালির আর্জেন্টিনাপ্রেমের হদিশ পেতেই এত কথা বলতে হচ্ছে। ৭৮-এর বিশ্বকাপ ফুটবলই বাঙালির প্রথম টিভিতে বিশ্বকাপদর্শন। ৭৪-এর দর্শন অসম্ভব ছিল, কেননা কলকাতা দূরদর্শনের জন্মই ১৯৭৫এ। ৭৮-এ সিজার লুই মেনোত্তির কোচিংয়ে ড্যানিয়েল পাসারেলা, উবাল্ডো ফিল্লোল, লুকে, ক্যাম্পেস, বার্তোনিদের আর্জেন্টিনার ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে জয় দেখা দিয়ে বাঙালির আর্জেন্টিনাপ্রেম শুরু। ৮৪-র নেহরু কাপ হয়ে ৮৬-র বিশ্বকাপজয় বাঙালির মনে সাড়া ফেলেছিল। ৯০-এ রানার্স আপ হওয়াটাও কম কৃতিত্বের ছিল না। কে ভুলতে পারে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে তাঁর অবিস্মরণীয় ফাইনাল পাস ক্যানিজিয়াকে?
সিজার লুই মেনোত্তি , কার্লোস বিলার্দো হয়ে এখন লিওনেল স্কালোনির হাতে আর্জেন্টিনা। স্কালোনি কোচ হলেও মেনোত্তি এখন আর্জেন্টিনা ফুটবল সংস্থার ডিরেক্টর। সব কিছুর উপরই তাঁর তীক্ষ্ণ নজর। মেসির আর্জেন্টিনা এমবাপে-গ্রিজম্যান-জিরুর ফ্রান্সকে ফাইনালে হারাতে পারবে কিনা সেটা দেখার জন্যে রাত জাগবে বাঙালি। হ্যাঁ, চন্দনগরের একদা ফরাসি উপনিবেশের বাঙালিরাও। পাঁচবারের বার মেসির হাতে বিশ্বকাপ ওঠে কিনা সেটাই দেখার। সোনার বুট কার ভাগ্যে জোটে সেটাও দেখতে হবে। বাঙালি এখন মানসিকভাবে আর্জেন্টাইন, রবীন্দ্রনাথের ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ও মেসি-আলভারেজ-ফার্নান্ডেজের লা আলবিসেলেস্তেময়।