ভারতীয়দের হাতে হাতে শাওমির মোবাইল, তার বিরুদ্ধেই বিস্ফোরক অভিযোগ!

অর্থনৈতিক যুদ্ধ পৃথিবীর কাছে নতুন কিছু নয়। ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ আছে, যেখানে যুদ্ধের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে অর্থনীতি। কিন্তু বিশ্বায়ন-পরবর্তী যুগ এই অর্থনৈতিক যুদ্ধের ব্যবহার দেখেছে আরও ব্যাপক হারে, আরও বিস্তারিতভাবে। শুধু রাশিয়াই যে এই যুদ্ধ পদ্ধতির আঁচ পেয়েছে, তা নয়। এই যুদ্ধ প্রায় সারা বছরই বিশ্বের কোনও না কোনও প্রান্তে চলছে, সেই যুদ্ধে শামিল ভারত এবং চিন ও। শাওমি-র ৫৫৫১.২৭ কোটি টাকা ইডি-র বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া সেই যুদ্ধেরই একটি ছোট্ট অংশ। কিন্তু হঠাৎ সেই সংস্থার এত টাকা বাজেয়াপ্ত হলই বা কেন?

এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের অভিযোগ, শাওমি ভারতের বৈদেশিক লেনদেন-সংক্রান্ত সমস্ত নিয়মের উল্লঙ্ঘন করেছে। টুইট করে তারা জানিয়েছেন যে, অবৈধভাবে বিদেশে অর্থ পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে এই সংস্থার বিরুদ্ধে এবং সেই কারণেই বৈদেশিক লেনদেন ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৯৯ অনুসারে তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে ৫৫৫১.২৭ কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

ইডি জানাচ্ছে, তারা ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকেই শাওমি-র ওপর নজরদারি চালাচ্ছে এবং তারা সেই সময় থেকেই জানতে পারে শাওমি রয়্যালটির ছদ্মবেশে তিনটি বিদেশি সংস্থাকে বিশাল অঙ্কের টাকা পাঠাচ্ছে। তদন্তে ইডি জানতে পেরেছে যে, চিনে সংস্থার মূল দপ্তর থেকেই তারা এই আদেশ পেয়েছে এবং দিনের পর দিন বেআইনিভাবে টাকা দেশের বাইরে পাঠাতে থেকেছে। শুধু তাই নয়, ব্যাঙ্কের কাছেও তারা ভুল নথি দিয়ে এসেছে এতদিন ধরে।

আরও পড়ুন: পাকিস্তানের মানববোমা আসলে কোন রহস্যময়ী নারী! ভয়ে কাঁপবে চিনও

সীমান্তে উত্তাপ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এমনিতেই ভারত সরকার চিনা সংস্থাগুলোর ওপর চাপ দিয়ে আসছে, যাতে তারা নিজেদের দেশে তৈরি কাঁচামালের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে
দেশি কোম্পানির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে কাজ করে। সীমান্তে অশান্তি কমার লক্ষণ কোনওভাবেই দেখা যাচ্ছে না, সুতরাং এই স্থিতাবস্থাও এই মুহূর্তে জারি থাকবে। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন, চিনের আগ্রাসনের উত্তরে ভারত পঞ্চাশটিরও বেশি চিনা অ্যাপ ভারতে নিষিদ্ধ করেছে।

যদিও শাওমি ইন্ডিয়া এই সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছে যে, আর্থিক লেনদেন যাই-ই হয়েছে, সবই লাইসেন্সড প্রযুক্তি এবং আইপি-র জন্যে রয়্যালটি প্রদান করার জন্য। কোনও আর্থিক লেনদেন অবৈধ নয়, এবং তারা সরকারের সঙ্গে সবরকমের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত, যাতে স্বচ্ছতা বজায় থাকে।

ডিসেম্বরে আয়কর দপ্তর শাওমি এবং ওপ্পো-র অফিসে হানা দেয়। তাদের দাবি, নির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে এবং অনিয়মের প্রচুর অভিযোগ তাদের কাছে থাকায় এই হানা।

এই ঘটনা সামনে আসতেই রাজনৈতিক চাপানউতোর শুরু হয়ে গেছে। তৃণমূলের নদিয়ার সাংসদ মহুয়া মৈত্র টুইট করে লিখেছিলেন যে, এই শাওমি-র থেকেই বর্তমান সরকার দশ কোটি টাকা অনুদান নেয় পিএম কেয়ার ফান্ডের জন্য এবং সেই সময়ে যখন বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, তখন সমস্ত প্রশ্নকে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল। 

উল্লেখ্য, ২০২০ সালে গালওয়ানে চিন-ভারত সংঘর্ষের পরে ভারত সরকারের প্রাথমিক অর্থনৈতিক পদক্ষেপগুলির মধ‍্যে একটি ছিল চিনা অ্যাপ ব্যান করা। তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০০০-এর ৬৯এ ধারা প্রয়োগ করে ২০২২ পর্যন্ত সর্বমোট ২৭৩টি অ্যাপ ব্যান করেছে ভারত। প্রথমবারের চিনা অ্যাপ ব্যানের প্রভাব সরাসরি পড়েছিল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থের প্রসঙ্গ তুলে সেবার ৫৯টি অ্যাপ ব্যান করেছিল ভারত। যার মধ্যে ছিল টিকটক বা পাবজি-র মতো জনপ্রিয় অ্যাপ। ভারতের বিদেশনীতির নিরিখে এই পদক্ষেপ বেশ জ‍রুরি ছিল বলেই সেসময় মনে করেছিলেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ। কিন্তু এই ঘটনায় কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল চিন। তারপর ব্যান হওয়া অ্যাপগুলো ক্লোন হয়ে ফিরে আসছে, এমন অভিযোগ উঠতে থাকে। তখন আবার অ্যাপ নিষিদ্ধ করার পথে হাঁটে সরকার। এভাবে ধাপে ধাপে অ্যাপ নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়ায় চিনকে বার্তা দিতে থাকে ভারত। সেই সময় রাজনৈতিক মহলের একাংশের দাবি ছিল, ভারতে বিপুল বাণিজ্যিক ক্ষেত্র রয়েছে চিনের, যা আদতে গুপ্তচরবৃত্তি এবং ভারতীয় পণ্যবাজারে ধস নামানোর হাতিয়ার। সেই নিরিখে চিনের এই জনপ্রিয় মোবাইল কোম্পানির সঙ্গে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার এই টক্কর তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন অনেকে।

এটাই দেখার যে, শাওমি-ইডি সংঘাত ভারত এবং চিনের সম্পর্কতে কীরকম প্রভাব ফেলে। 

More Articles