হিন্দুত্ব আর গরিববন্ধু ইমেজ - উত্তরপ্রদেশ জয়ে যে দুই মন্ত্র সহায় হলো যোগীর

শেষ ১৯৮৫ সালে উত্তরপ্রদেশে পরপর দুইবার বিধানসভা নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী পদ প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন নারায়ণ দত্ত। কিন্তু পরপর দুবার নির্বাচিত হলে ও পাঁচ বছরের মুখ্যমন্ত্রীত্বের মেয়াদ শেষ করতে পারেননি কংগ্রেস নেতা নারায়ণ দত্ত তিওয়ারী। উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনের ইতিহাসে যোগী আদিত্যনাথই প্রথম যিনি পাঁচ বছরের মেয়াদ সম্পূর্ণ করে আবার আগামী পাঁচ বছরের জন্য লখনউর তখতে বসলেন।

কিন্তু ঠিক কী মন্ত্রে উত্তরপ্রদেশে এত বিতর্কের তাপ ঠাণ্ডা করে সফল হল বিজেপি? শেষ কয়েক বছরে যোগী রাজত্বে উত্তরপ্রদেশের কর্মকাণ্ড গোটা ভারতে বেঞ্চমার্ক হয়ে উঠেছিল। লখিমপুর থেকে হাথরস একের পর এক ধর্ষণে যোগী সরকারের নিষ্ক্রিয়তা সত্ত্বে ও উত্তরপ্রদেশের মানুষের ভরসা অর্জন করতে কোনও সমস্যাই হয়নি যোগীর। এমনকি গোটা দেশ যখন এন আর সি, সি এ এ আন্দোলন নিয়ে উত্তাল তখন ও আদিত্যনাথের পুলিশ প্রশাসনের তীব্র দমন নীতির শিকার হয়েছিলেন সাধারণ মানুষ। স্বয়ং যোগী আদিত্যনাথ ও উত্তরপ্রদেশের ভোটের আগে ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতির ট্রাম্প কার্ড টি খেলে বিপক্ষকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে হিন্দু মুসলিম দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়েরই ভোট- ব্যাঙ্কের ওপর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। সেই পরিস্থিতে দাঁড়িয়ে ও যোগী স্পষ্ট হিন্দু-মুসলিম বিভেদরেখা টানতে পিছপা হননি। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই ভোটের আগে আশি- কুড়ির ফর্মুলা বাতলে ছিলেন ‘যোগীজি’।  নানা সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্তদের উদ্দেশ্যে তির্যক মন্তব্যও শোনা গিয়েছে তাঁর মুখে।

সেসবের পরেও অন্য সব রাজনৈতিক দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা  উড়িয়ে দিয়ে বিজেপি উত্তরপ্রদেশ ভোটে পেয়েছে ২৬১ আসন। এমনকী ২০১৭ সালের থেকে ও ভোটের শতাংশ বেড়েছে বিজেপির। এর পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে। যোগীর আমলেই উত্তরপ্রদেশে আইন শৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছে অনেক। আগের উত্তরপ্রদেশের আন্ডার ওয়ার্ল্ডের ক্রাইম দুনিয়া থেকে অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে উত্তরপ্রদেশ। যার ফলে মহিলা ভোটারদের একটা অংশ প্রশ্নাতীত ভাবেই বিজেপির খাতায় গিয়েছে।

আবার যোগী মুখ্যমন্ত্রী হয়েই প্রশাসনকে কাজের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। আমলাদের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে যাতে কোনও রাজনৈতিক বাধা বা অসুবিধার সম্মুখীন না হতে হয় সে ব্যাপারে নিজের রাজ্যে প্রথম থেকেই সক্রিয় ছিলেন যোগী। উন্নয়ন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে যাতে আমলাদের সিদ্ধান্তই কার্যকর হয় সে ব্যাপারে ও সতর্ক থেকেছেন তিনি। উত্তরপ্রদেশ ভোটের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে আরেকটি টার্নিং পয়েন্ট হল অয্যোধ্যায় রামমন্দিরের বাস্তব রূপায়নের ক্ষেত্রে বিজেপির একনিষ্ঠ উদ্যোগ। ২০২০ সালে রাম মন্দির রায় বেরনোর পর করোনা পরিস্থিতিতে ও যেভাবে মোদী-যোগী রামমন্দিরের রাজকীয় শিলান্যাস করেছেন তাতে নিঃসন্দেহে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর মন জয় করতে যোগী আদিত্যনাথ বা বিজেপির কোনও সমস্যাই হয়নি।

আবার যোগী সফলভাবেই উত্তরপ্রদেশে উন্নয়নের বুলডোজার চালিয়েছেন। অযোধ্যাকে আন্তর্জাতিক মানের তীর্থস্থান হিসেবে গড়ে তুলতে কোনো বাধাই মানেননি তিনি। রাস্তা চওড়া করতে ভক্তকুলের দোকান সরিয়ে দিয়েছেন। করোনার সময়ে উত্তরপ্রদেশ সরকারের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে , অক্সিজেনের অভাবে রোগীর নাভি শ্বাস উঠেছে। সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতে লাশের পর লাশ কাপড়ে মুড়ে গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হয়েছে। করোনায় গণচিতা জ্বলার দৃশ্য় দেশে একমাত্র উত্তরপ্রদেশেই দেখা গিয়েছে। হাথরসে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। 

আবার করোনার সময়েই প্রতিটি পরিবারকে বিনাপয়সার আনাজ, খাদ্যশস্য, ভোজ্যতেল দিয়েছে যোগীর সরকার। বিরোধীদের অভিযোগ ছিল ভোট মিটে গেলেই বিনামুল্যের রেশন পরিষেবা বন্ধ করে দেবে সরকার। কিন্তু বাস্তবে উত্তরপ্রদেশে এখন ও ফ্রি রেশন চালু রয়েছে যা নিঃসন্দেহে উত্তরপ্রদেশের মত একটি রাজ্যের আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা শ্রেণির ভোটকে বিজেপির দিকে নিয়ে গিয়েছে। তবে এসব পেরিয়ে আসলে জিতেছে কড়াপাকের হিন্দুত্ব। বাবরির পরিবর্ত হিসেবে রামমন্দির পাওয়াকে যোগীর সাফল্য, হিন্দুত্বের জয় হিসেবে দেখেছে একটা বড় অংশ। পাশাপাশি সকলের জন্য পাকাবাড়ি, সব বাড়িতে পাকা শৌচালয় তৈরির উদ্যোগ যোগীকে দিয়েছে ডিভিডেন্ট। আর সেই কারণেই অখিলেশকে তারা বিকল্প হিসেবে ভাবেননি। বিজয়ীর বরমাল্য গিয়েছে আদিত্যনাথের গলায়। সব হিসেব উল্টে দিয়েছেন যোগী। এই জয় সামান্য নয় কারণ আগেও বলেছি, এই প্রথম জন্য উত্তরপ্রদেশে কোনো মুখ্যমন্ত্রী পরপর দুবার ক্ষমতায় এলেন, শুধু তাই নয়, উত্তরপ্রদেশে বিজেপির ভোট শতাংশও বাড়ল ২০১৭ সালের তুলনায়।

সর্বোপরি ভোট ভাগাভাগির যে অঙ্ক উত্তরপ্রদেশে হয়েছে তার থেকে ও বিপুল ফায়দা তুলেছে বিজেপি। দলিত নেত্রী মায়াবতীর বিজেপিকে নীরব সমর্থন, বিজেপির বিরুদ্ধে সব জায়গায় প্রার্থী না দেওয়া বিজেপিকে উত্তরপ্রদেশ ভোটে বাড়তি অক্সিজেন দিয়েছে। আবার এইবারের ভোটে দেখা গিয়েছে শুধুমাত্র উচ্চবর্ণীয় হিন্দু নয় দলিত বা অন্যান্য হিন্দুদের ভোট ও বিজেপির খাতায় গিয়েছে। আদিত্যনাথের স্পষ্ট মেরুকরণের নীতি থাকলে ও কার্যক্ষেত্রে উত্তরপ্রদেশের মুসলিম জনসংখ্যা ও বিজেপির ওপরেই ভরসা রেখেছে।

করোনা পরিস্থিতিতে বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতির দায় ও সরাসরি আদিত্যনাথের সরকারের উপর বর্তায়নি। তাই এই বিপুল জনাদেশ নিয়ে উত্তরপ্রদেশের মসনদ দখলকে যোগী বলেছেন এই জয় উন্নয়ন সুশাসন রাষ্ট্রবাদ, বিকাশ এবং সুরক্ষার জয়। নিন্দুকের কুৎসায় বুলডোজার চালিয়ে তাই উত্তরপ্রদেশ যোগীরই।    

More Articles