রাশিয়ার আগ্রাসনের মাশুল, যুদ্ধ-খাতে ২ ট্রিলিয়ন খরচ করছে বিশ্ব!

All we are saying, give peace a chance

৪০ বছর আগে বিশ্ব শান্তি কামনা করে বিখ্যাত গানটি লিখেছিলেন জন লেনন এবং পল ম্যাকারূটনি। তখন একদিকে ঠান্ডা যুদ্ধের আতঙ্ক, অন্যদিকে ভিয়েতনামে বর্ষিত হচ্ছে আমেরিকান নেপাম বোমা। যুদ্ধ চলছে শান্তির খোঁজে, লড়াইতে প্রাণ হারাচ্ছে দুই পক্ষ, জিতছে লকহিড মার্টিন, জিতছে দাও কেমিক্যাল, হারছে মানবতা।

৪০ বছর পরেও ছবিটা এক ফোঁটা পাল্টালোনা। ২৪  ফেব্রুয়ারির আগে পৃথিবী এমন একটা সময় কাটাচ্ছিল যা আমাদের আধুনিক মানব সভ্যতায় বিরল। ঐতিহাসিকদের মতে, তা ছিল শান্তির যুগ। যদিও ঠিক কোন মাপকাঠিতে শান্তির যুগ বলছিলেন তারা জানা নেই, তবে হ্যাঁ, পরমাণু যুদ্ধের আতঙ্ক নিয়ে আমাদের বাঁচতে হচ্ছিলনা, এই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল, এই আশঙ্কায় প্রহর গুনতে হতোনা আমাদের। কিন্তু সেই ঐতিহাসিকরা হয়তো মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার অশান্তির অধ্যায়গুলো হয়েতো স্মরণ করে উঠতে পারেননি বা গত দুই দশক ধরে কোটি কোটি বাস্তুহারা স্মরণার্থীদের কথা তাদের মনে পড়েনি। এই ভুলে যাওয়া কি ডলারের ক্ষমতার সাথে সমানুপতিক?

আপাত দৃষ্টিতে যাকে "শান্তির যুগ" বলা হচ্ছিল তার অবসান ঘটালেন পুতিন দায়িত্ব নিয়ে। একটি স্বাধীন, গনতান্ত্রিক, সার্বভৌম দেশকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে (১৯৯৪ বুদাপেস্ট মেমোরান্ডাম) আক্রমণ করলেন, এবং তার এই আক্রমণে বলাই বাহুল্য, পৃথিবীর ভবিষ্যত এবং বিশ্ব রাজনীতির সমস্ত সমীকরণ পাল্টে দিলেন বরাবরের মত। পাকাপাকি ভাবে পরমাণু বোমাবিহীন পৃথিবীর স্বপ্ন শেষ হল, শেষ হল বিশ্বশান্তির আশা, অন্তত আগামী কয়েক দশকের জন্যে। ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ সিদ্ধান্ত নিল, তারা তাদের প্রতিরক্ষা খাতে আরো বেশি করে অর্থ বরাদ্দ করবে। বলাই বাহুল্য, বিশ্বের বাকি শক্তিশালী অর্থনীতি গুলোও পিছিয়ে থাকবেনা। এমন কি, আমেরিকা, যাদের প্রতিরক্ষা খাতের বরাদ্দ অর্থ বাকি সব দেশের চেয়ে অনেক অনেক বেশি (৭৭৮ বিলিয়ন), তারাও বলছে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা। আরো ফুলে ফেঁপে উঠতে চলেছে যুদ্ধ শিল্প, এবং সেই সাথে যুদ্ধ শিল্প, এবং যুদ্ধাস্ত্র প্রস্তুতকারী সব সংস্থার (প্রথম পাঁচটির মধ্যে চারটেই আমেরিকান) মুনাফা লাভের আরো শক্তপোক্ত ব্যবস্থা হতে চলেছে।

এবার একটু বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ফিরে যাওয়া যাক। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরেই ইউক্রেন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু সেই স্বাধীনতা আসে এক চরম মূল্যের বিনিময়ে, এবং যে মুল্য নির্ধারণ করে দেন বিশ্ব রাজনীতির দাদারা।

ইউক্রেনের মাটিতে সেই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রায় দু হাজার পরমাণু অস্ত্র মজুত ছিল, স্বাধীনতা পাওয়ার পর ইউক্রেন হয়ে ওঠে তৃতীয় বৃহৎ পরমাণু শক্তিধর দেশ। আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন, সবাই ইউক্রেনকে বাধ্য করে সেই সব অস্ত্র প্রত্যাহার করতে, বদলে তাদের দেওয়া হয় নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি। আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন কি সুন্দর ভাবে সেই প্রতিশ্রুতি পালন করছে রাশিয়া। আজ ইউক্রেনের হাতে সেই অস্ত্র ভাণ্ডার থাকলে এই দিন আসত কি?

এই আশঙ্কার জায়গা থেকেই বিশ্বের অনেক দেশই এখন তাদের প্রতিরক্ষা খাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে চলেছে। সেই দেশ গুলির তালিকা দেখে নেওয়ার আগে ২০২০ সালের একটি রিপোর্টে চোখ বোলানো প্রয়োজন। Stockholm International Peace Research Institute এর সেই রিপোর্ট বলছে, ২০২০ সালেই গোটা বিশ্বের সম্মিলিত প্রতিরক্ষা বাজেট ছিল প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার। যার মধ্যে সিংহভাগ হল আমেরিকা, চিন, ব্রিটেন, ভারত এবং রাশিয়ার, এবং এর মধ্যে আমেরিকাই শুধু খরচ করেছে ৭৭৮ বিলিয়ন ডলার। ‍‍‍‍‍‍‍‍‍২৫২ বিলিয়ন (২০২০ অর্থবর্ষের শেষ হিসেব) খরচ করে দ্বিতীয় স্থানে আছে চিন। ভারত ও পিছিয়ে নেই। জিডিপির প্রায় তিন শতাংশ খরচ করেছে আমাদের দেশ।

রাশিয়ার এই আক্রমণে এই খরচ আরো দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পেতে চলেছে।

জার্মানির কথায় আশা যাক। জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শুলস ঘোষণা করেছেন, যে আগামী অর্থবর্ষে তারা ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ করতে চলেছেন। জার্মানীর ওপর অনেকদিন ধরেই চাপ ছিল ( মূলত আমেরিকার) প্রতিরক্ষা খাতে জিডিপির অন্তত দুই শতাংশ খরচ করার। জার্মান চ্যান্সেলর এখন সেই দাবিকে আর অগ্রাহ্য করার জায়গায় নেই। "এটা এখন স্পষ্ট যে আমাদের দেশের সুরক্ষা বৃদ্ধি করতে, স্বাধীনতা এবং গনতন্ত্র রক্ষা করতে আরও অনেক বেশি অর্থ বরাদ্দ করতে হবে প্রতিরক্ষা খাতে", বলছেন তিনি।

সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী মাগদালেনা অ্যান্ডরসন মার্চের এক তারিখ ঘোষণা করেছেন যে তারাও প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াবেন। টেলিভিশন বার্তায় নিজের দেশবাসীদের তিনি জানিয়েছেন, "সুইডেনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করার সময় এসেছে। আমরা হয়তো আক্রান্ত নই এই মুহূর্তে, কিন্তু সার্বিক ভাবে যুদ্ধের আশঙ্কা বৃদ্ধি পেয়েছে।" এই প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন যে সুইডেন ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানের পর নিজেদের প্রতিরক্ষা বাজেটে কাটছাঁট করে।

রোমানিয়ার রাষ্ট্রপতি ক্লউস ইয়োহানিস জানিয়েছেন, তার দেশ প্রতিরক্ষা খাতে জিডিপির ২ শতাংশের জায়গায় আড়াই শতাংশ খরচ করবে।

সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানাচ্ছে, পোল্যান্ড প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াবে, সেটা তাদের জিডিপির তিন শতাংশ অবধি হতে পারে। এতদিন পর্যন্ত ন্যাটোর শর্ত অনুযায়ী ২ শতাংশ ছিল তাদের বাজেট। কিন্তু রাশিয়ার পশ্চিম সীমান্তের এই দেশ কোনো রকম ভাবেই আর ঝুঁকি নিতে রাজি নয়।

এই মুহূর্তে রাশিয়ার সবথেকে বড় ভরসার জায়গা চিন। বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিশালী সেনাবাহিনী চিনের। প্রতিরক্ষা বাজেট 7.1 শতাংশ বৃদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়েছে ২২৯ বিলিয়ন ( ২০২২ অর্থবর্ষের বরাদ্দ), যা ভারতের প্রায় তিন গুণ। তবে এখানেই থেমে থাকতে চায়না তারা। মনে করা হচ্ছে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খুব শীঘ্রই আরো বেশি অর্থ বরাদ্দ হবে।

ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেট্টে ফ্রেডেরিক্সন জানিয়েছেন তাঁরাও এই খাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়াবেন। ২০৩৩ সালের মধ্যে তাদের বাজেট জিডিপির ২ শতাংশ ছোঁবে।

তালিকাটা এখানেই শেষ হচ্ছেনা। শুরুতেই লিখেছি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র তাদের ম্যামথ ৭৭৮ বিলিয়ন ডলার বাজেটে আর সন্তুষ্ট নয়। সেই খাতে তাদের অর্থ বরাদ্দ আগামী দিনে আরও বৃদ্ধি পেতে চলেছে। ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং কানাডাও চুপ করে বসে থাকতে রাজি নয়। অর্থ বরাদ্দ বাড়বে তাদেরও।

ঘুরে ফিরে আবারো আমরা সেই দিন গুলোয় ফিরে গেলাম যেখানে বিশ্ব রাজনীতির সমস্ত সমীকরণ নির্ধারণ করবে মিলিটারি শক্তি। ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ আরো বেশি করে আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে, ফিরে আসবে ঠান্ডা যুদ্ধের আবহ, তফাত একটাই থাকবে, তা হল আমেরিকার প্রতিপক্ষ আর আগের মত শক্তিশালী নয়, তার অর্থনীতি আগের চেয়ে অনেকটাই দুর্বল। শুধু তাই নয়,  সেই দেশ এই মুহূর্তে আর্থিক নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত। আমেরিকা এবং ন্যাটো পূর্ব ইউরোপ সীমান্তকে আরো সুরক্ষিত করতে চাইবে, এবং রাশিয়াও চুপ করে থাকবেনা। পশ্চিমী দেশ গুলির সাথে সম্পর্ক একেবারে ছিন্ন করে এখন স্বাভাবিকভাবেই তারা চিনের মুখাপেক্ষী হবে। সম্ভাবনা থাকছে উত্তর কোরিয়া চিন রাশিয়া অক্ষ আরো মজবুত হওয়ার। অন্যদিকে ভারতও ভোটাভুটি থেকে বিরত থেকে এবং তেল কিনে রাশিয়ার সাথে নিজের ঐতিহাসিক মিত্রতা বজায় রেখেছে। কিন্তু ভারত চিন সম্পর্কে কি নীতি নেবে রাশিয়া? আরো তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের দিনই পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মস্কো সফর। ঠিক তার পরেই পশ্চিমের দেশগুলিকে চূড়ান্ত আক্রমণ করেন তিনি এবং অভিযোগ করেন দ্বিচারিতার। সুতরাং উপমহাদেশের রাজনৈতিক পটচিত্রও যথেষ্ট জটিল হয়ে পড়ল।

চোখ থাকবে চিন তাইওয়ানের সম্পর্কের ওপরেও। ইউক্রেনের ক্ষেত্রে আমেরিকা যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে না পড়লেও রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন যে তাইওয়ান আক্রান্ত হলে তারা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বেন এবং তাইওয়ানকে রক্ষা করবেন। মধ্য প্রাচ্যেও সংঘাতের ক্ষেত্রগুলির জট ছাড়ানো সম্ভব হচ্ছেনা। ইরাক এবং ইরানের সম্পর্কের আরও অবনতি হয়েছে।

যতদিন যাবে, প্রত্যেকটি দেশ, এমনকি সমাজতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ দেশ গুলিও এই আবহে বাধ্য হবে প্রতিরক্ষা খাতে নিজেদের বরাদ্দ বাড়াতে। স্বাভাবিক ভাবেই অন্যান্য খাতে, যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা বা সামাজিক প্রকল্পের বরাদ্দ কমাতে তারা বাধ্য হবে। লাভবান হবে লকহিড মার্টিন, বোয়িং, রেথিওন, বিএই সিস্টেমের মত সংস্থা, ফুলে ফেঁপে উঠবে তাদের মুনাফা।

এই মুহূর্তে বিশ্বে যুদ্ধের কারণে কোটি কোটি শরণার্থী বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়ে আছেন। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পর সেই তালিকায় যোগ হয়েছেন আপাতত আরো ত্রিশ লক্ষ মানুষ। চূড়ান্ত কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন তারা, তাদের এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যত একেবারেই অন্ধকারে।

ভাবুন তো, কেমন হত যদি গোটা পৃথিবীর সম্মিলিত মিলিটারি বাজেট মানব কল্যাণে ব্যবহৃত হত?  দুই ট্রিলিয়ন ডলার এতটাই অর্থ যে তাতে বিশ্বের দারিদ্র্য দূর করা, পৃথিবীর খাদ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করা, বিশ্ব উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে লড়াই করা, সব সমস্যার সমাধান সম্ভব। হ্যাঁ, খুবই অবাস্তব এই ভাবনা। কিন্তু রাষ্ট্রনেতারা কবে বুঝবেন যে জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে বিশ্বের সমস্ত দেশকে একসাথে কাজ করতে হবে, অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী সব দেশকে আরো অনেক অর্থ খরচ করতে হবে। কিন্তু ২০২২ সালে পৃথিবীর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে যেখানে জলবায়ু বা মহাকাশ বিজ্ঞানের জন্যে গবেষণায় নয়, অর্থ বরাদ্দ বাড়বে শুধু প্রতিরক্ষা খাতে।

তবে আমরা কি আমাদের শেষের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলাম? বিশ্বশান্তির স্বপ্ন কি আরো অলীক হয়ে পড়লো? উত্তর জানা নেই, তবে এই আশায় থাকলাম, যে আবারো কোনো একদিন কেউ গেয়ে উঠবেন,

"Imagine there's no countries
It isn't hard to do
Nothing to kill or die for
And no religion, too

Imagine all the people
Livin' life in peace"




More Articles