গাজাকে ৪০ হাজার তাঁবু 'ইদের উপহার'! রাফাহ ধ্বংসের ভয়ঙ্কর ছক কষছে ইজরায়েল?

Israel-Hamas Conflict: যুদ্ধ, যন্ত্রণা আর মৃত্যুর অভিশাপ নিয়েই তবু ইদের প্রার্থনা সেরেছেন গাজাবাসী। আল আকসা মসজিদ-সহ একাধিক জায়গায় জমেছিল প্রার্থনাকারীদের ভিড়। গত বছরের ইদটাও এমন ছিল না গাজায়।

রমজানের শুরুটাও হয়েছিল যুদ্ধ আর মৃত্যু দিয়ে। রমজানের শেষ বা খুশির ইদ, কোনওটাই তেমন খুশির হওয়ার নয় আসলে গাজাবাসীর জন্য। দেখতে দেখতে যুদ্ধ পৌঁছে গিয়েছে ১৮৭ দিনে। যুদ্ধের দু'শো দিন কাটিয়ে দেওয়া এখন সময়ের অপেক্ষা কেবল। অবশ্য মৃত্যুমিছিলের শেষ নেই কোনও। প্রায় প্রতিদিনই ইজরায়েলের হামলায় মারা যাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। হামাস-ইজরায়েল সমঝোতা হয়নি রমজানের আগেও। সমঝোতা হল না ইদ আসার আগের মুহূর্তেও। ফলে যুদ্ধবিরতির স্বপ্নও অধরা রয়ে গেল গাজাবাসীর। তবে ইজরায়েল গাজাদের বাসিন্দাদের জন্য কিনেছে চল্লিশ হাজার তাঁবু। না, ইদের উপহার নয়। উড়িয়ে দেওয়া হবে দক্ষিণ গাজার গোটা রাফাহ শহরটাকেই। আর তার জন্যই বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে নেতানিয়াহু প্রশাসন।

গত বছর অক্টোবরের শুরুতে হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে ইজরায়েল। তবে সে যুদ্ধ যত না বেশি ছিল প্যালেস্টাইনের সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠন হামাসের বিরুদ্ধে, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল গাজার বিরুদ্ধে। এখনও পর্যন্ত ইজরায়েলের হামলায় কম করে হলেও ৩৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে সাড়ে ১৪ হাজার শুধু শিশুই। রয়েছে সাড়ে ৯ হাজার মহিলা। বিশ্বজোড়া দেশের বিরোধিতা, ইজরায়েলের আগ্রাসনের প্রতি নিন্দা, বিশ্ব আদালতে ইজরায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ, কোনও কিছুই ঠেকাতে পারেনি ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। যুদ্ধের প্রথম থেকে যে আমেরিকা প্রতিপদে ইজরায়েলের পাশে থেকেছে, তারাও শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়েছে শান্তির পক্ষে সওয়াল করতে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বারবার গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনলেও তাতে কান দেয়নি ইজরায়েল।

ইদের একদিন আগে, গত মঙ্গলবারও ইজরায়েলের বিমানহামলায় মৃত্যু হয়েছে ১৪ জন ফিলিস্তিনির। মধ্য গাজার নুসিরত ক্যাম্পকে নিশানা করে হামলাটি চালায় ইজরায়েলি সেনা। সেদিনের হামলায় নিহতদের মধ্যে অন্তত চারটি শিশু রয়েছে বলে খবর। এরই মধ্যে আবার গাজার গোটা রাফাহ শহরটিকেই উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা এঁটেছে ইজরায়েল। যে পরিকল্পনায় আপত্তি রয়েছে আমেরিকা-সহ একাধিক দেশের। বিশেষত ইদের সময় ইজরায়েল যে ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে আঁতকে উঠেছে গোটা বিশ্ব। মার্কিন সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন মঙ্গলবার ইজরায়েলের সিদ্ধান্তের কড়া নিন্দা করেন। এ নিয়ে ইজরায়েল আমেরিকাকে আগে থেকে কিছু জানানো হয়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি। ইজরায়েল সরকার ইচ্ছাকৃত ভাবেই আমেরিকাকে এড়িয়ে চলছে বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি।

আরও পড়ুন: হামলার বিরাম নেই, রক্ত আর খিদে দিয়েই রমজান শুরু গাজায়

রমজানের আগেও হামাসের সঙ্গে একাধিক বার বৈঠকে বসেছে ইজরায়েল। তবে ইজরায়েলের দেওয়া শর্তে একমত হতে পারেনি ফিলিস্তিনি জঙ্গিগোষ্ঠী হামাস। বিফলে গিয়েছে একের পর এক আলোচনা, বৈঠক। মঙ্গলবারও হামাসের তরফে জানানো হয়, ইজরায়েলের সাম্প্রতিক প্রস্তাবেও হামাসের কোনও দাবিপূরণ হয়নি। তা সত্ত্বেও তারা ইজরায়েলের প্রস্তাব পুনরায় খতিয়ে দেখে মধ্যস্থতাকারীদের জানাবে। দীর্ঘদিন ধরেই কাতার ও মিশর হামাস ও ইজরায়েলের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে আসছে। তবে এখনও পর্যন্ত হয়নি। হামাস আর ইজরায়েলের এই দ্বন্দ্বসংঘাতের মাঝে মারা গিয়েছে শুধু অগণিত গাজাবাসী। প্রায় রোজই নানা ভাবে গাজার উপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল।

এদিকে ইজরায়েল গাজায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা না করা পর্যন্ত তাদের সঙ্গে সমস্ত বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থগিত রাখার কথা ঘোষণা করেছে তুর্কি। আঙ্কারার তরফে সম্প্রতি জানানো হয়েছে, গাজা সঙ্গে ইজরায়েলের যুদ্ধপরিস্থিতিতে অন্তত ৫৪ ধরনের জরুরি জিনিসপত্র ইজরায়েলে রফতানি করা বন্ধ রাখছে তুর্কি। তার মধ্যে যেমন রয়েছে বিমানের জ্বালানি, তেমনই রয়েছে সিমেন্ট, অ্যালুমিনিয়াম, ইস্পাতের মতো জিনিসপত্র। তুর্কির প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়েপ এরদোগানকে একাধিক বার ইজরায়েলের সমালোচনা করেছে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধের প্রসঙ্গে। সম্প্রতি গাজায় সাহায্য় পাঠাতে চাইলে তুর্কির সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে ইজরায়েল। তাতেই ক্ষুব্ধ হন এরদোগান। তার পরিপ্রেক্ষিতেই ইজরায়েলের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে তুর্কি।

যুদ্ধের প্রথম ধাপে গাজাবাসীকে ভাতে মারার সমস্ত ব্যবস্থাই করেছিল ইজরায়েল। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল তাদের খাবার, জল ও বিদ্যুতের সমস্ত সরবরাহ। তার পর যুদ্ধ যত এগিয়েছে, তত মৃত্যুমিছিল বেড়েছে গাজায়। কার্যত গণকবরে পরিণত হয়েছে গাজার প্রতিটি অংশ। ধর্মস্থান, স্কুল, হাসপাতাল, এমনকী শরণার্থী শিবিরগুলিকে নিশানা করেও একের পর এক হামলা চালিয়ে গিয়েছ ইজরায়েল। সেই ভাবেই এখন ইজরায়েলকে বিভিন্ন জরুরি সরবরাহ বন্ধ করে চাপে রাখতে চাইছে তুর্কি। তুর্কি সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, ইজরায়েল গাজায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা না করা পর্যন্ত এবং গাজায় পর্যাপ্ত পরিমাণে সব ধরনের সহায়তার অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত, তারা তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকবে।

দীর্ঘদিন ধরেই দুর্ভীক্ষের শিকার গাজা। গাজার প্রায় সবক'টি সীমান্ত এমনভাবে বন্ধ করেছে ইজরায়েল, যাতে একটি মাছিও না গলতে পারে। ফলে কোনও দেশ থেকেই কোনও সহায়তা এসে পৌঁছচ্ছে না গাজার কাছে। এখনও পর্যন্ত ইজরায়েলি হামলায় গাজায় জখমের সংখ্যা ৭৫ হাজার পেরিয়ে ৭৬ হাজার ছুঁই ছুঁই। অথচ সামান্যতম মেডিক্যাল সাহায্য়টুকুর পরিকাঠামো নেই ইজরায়েলে। একে একে প্রাণ বাঁচাতে পিছিয়ে গিয়েছে মেডিক্যাল সাহায্য প্রদানকারী সবকটি মানবাধিকার গ্রুপ। খাদ্যকষ্ট, জলকষ্ট, চিকিৎসার অভাব, সব কিছুকে সঙ্গী করেই প্রতিদিন মরছেন গাজার বাসিন্দারা।

এর মধ্যেই রাফাহ শহর উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা এঁটেছে ইজরায়েল। হামাসের একটিও ঘাঁটির অস্তিত্ব যাতে গাজায় না থেকে যেতে পারে, তার জন্যই এই পদক্ষেপ। ইতিমধ্যেই সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে রাফাহ-র বাসিন্দাদের জন্য চল্লিশ হাজার তাবু কিনেছে ইজরায়েল। সেই সব অস্থায়ী তাঁবু সম্ভবত হাতে তুলে দেওয়া হবে রাফাহর বাসিন্দাদের? যাতে তারা নিরাপদ জায়গায় সরে যান। শোনা গিয়েছে, ইতিমধ্যেই রাফাহ ফাঁকা করার প্রক্রিয়াও নাকি শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে কোথায় যাবেন তারা। গোটা গাজায় নিরাপদ জায়গা বলে কিছুই বেঁচে নেই আর আসলে।

আরও পড়ুন: হামাস-ইজরায়েল আলোচনা বিফলে! রমজানেও শান্তি ফিরবে গাজায়?

রমজান শেষ হয়ে ইদের দিনে পৌঁছেছেন গাজার বাসিন্দারা। বুধবারই ইদ, না বৃহস্পতিবার, এ নিয়ে গোটা বিশ্ব জুড়েই নানা জল্পনা চলছে। তবে সেই সব চিন্তাভাবনার জায়গাতেই নেই গাজার মানুষ। যুদ্ধ, যন্ত্রণা আর মৃত্যুর অভিশাপ নিয়েই তবু ইদের প্রার্থনা সেরেছেন তাঁরা। আল আকসা মসজিদ-সহ একাধিক জায়গায় জমেছিল প্রার্থনাকারীদের ভিড়। গত বছরের ইদটাও এমন ছিল না গাজায়। তবে সে সব আজও অন্য কোনও জগৎ বলে মনে হয় গাজাবাসীর। মাথার উপর ঘাই মারছে মৃত্যুর চিহ্নবাহী ইজরায়েলি যুদ্ধবিমান। যে কোনও মুহূর্তে ইজরায়েলি বোমায় ইতিহাসে মিশে যেতে পারে আস্ত একটা শহর। ইতিমধ্যেই বিশ্বনেতাদের তরফে এসেছে ইদের বার্তা। যদিও আমেরিকা জানিয়েছে, তাদের সঙ্গে চূড়ান্ত কথাবার্তা না বলে এমন মারণ পদক্ষেপ করবে না ইজরায়েল। রাফাহ শহর উড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ইজরায়েলের মারাত্মক ভুল বলেও বর্ণনা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তবে বন্ধু-দেশের সাবধানবাণী কি ঠেকাতে পারবে আদৌ ইজরায়েলকে। নাকি এই ইদই হতে চলেছে রাফাহ শহরের শেষ ইদ। ভয়ঙ্কর এই প্রশ্নের সামনে আপাতত দাঁড়িয়ে গোটা বিশ্ব।

More Articles