নদীর মাঝে আজও জেগে ২১২ বছরে গির্জা! পর্যটকদের কেন টানে ভারতের এই বিস্ময়?

Mysterious Floating Church of Karnataka: আগে তো এমন ছিল না, হঠাৎ ১৯৬০ সালের পর থেকে কী এমন ঘটল যাতে প্রতি বছর তলিয়ে যায় এই গির্জা?

বর্ষাকালে, যদি বেঙ্গালুরু থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে কর্ণাটকের হাসান জেলার শেট্টিহাল্লিতে যান, চোখ কপালে উঠবে, মুখ হাঁ হয়ে যাবে। বেশ কিছুক্ষণ লাগবে ধাতস্থ হতে যে, যা দেখছেন চোখের সামনে, তা কি সত্য? হেমাবতী নদীর জলে ভেসে যাচ্ছে আস্ত এক গির্জা! ভেসে যাচ্ছে নাকি ডুবে যাচ্ছে তাও বুঝতে সময় লাগবে ঢের। ভাসমান এই গির্জার বয়স ২১২ বছর! আর এই ডুবন্ত গির্জার কাহিনি আজকের নয়, সেই ১৯৬০ সাল থেকেই শেট্টিহাল্লি রোজারি গির্জাটি প্রতি বছর জুলাই এবং অক্টোবরের মধ্যিখানের সময় জুড়ে জলে ডুবে যায়। বর্ষাকালে এই সুবিশাল গির্জার মাত্র এক-তৃতীয়াংশই জলের উপর ভেসে থাকতে দেখা যায়।

ভাসমান বা ডুবন্ত গির্জা নামেও পরিচিত এই রোজারি চার্চ। আগে তো এমন ছিল না, হঠাৎ ১৯৬০ সালের পর থেকে কী এমন ঘটল যাতে প্রতি বছর তলিয়ে যায় এই গির্জা? ১৯৬০ সালে হেমাবতী বাঁধ এবং জলাধার নির্মাণের পরে পালটে যায় গোটা এলাকারই ভবিষ্যৎ। নদীর গতিপথ বদলে যাওয়াতে এই গির্জাটিও পরিত্যক্ত হয় এবং আশেপাশের ২৮ টি গ্রাম জলের তলায় চলে যায়।

আরও পড়ুন- বয়স পেরিয়েছে দু’শো বছর, আজও বাংলা-নরওয়ের অজানা কাহিনি ধরা দেয় শ্রীরামপুরের এই গির্জায়

১৮১০ সালে ফরাসি ধর্মপ্রচারক জিন-অ্যান্টোইন ডুবইস (জানুয়ারি ১৭৬৫ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৪৮) এই গির্জাটি নির্মাণ করেন। গথিক স্থাপত্যের এই গির্জাটি প্রাথমিকভাবে ছিল একতলা ভবন। ১৮৬০ সালে এই গির্জার সংস্কার করা হয়, তখন গির্জাটির এলাকা সম্প্রসারণ করা হয় এবং গির্জাটিকে সাজানোর জন্য প্রচুর আলংকারিক বস্তু বাইরে থেকে আমদানি করা হয়।

সেই সময় গুড় এবং ডিম- এই দু'টি বিষয় বাড়ি নির্মাণে ব্যবহার করা হতো। ভারতজুড়ে বহু ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভের পাশাপাশি বাড়িগুলিতে সিমেন্টের সঙ্গে গুড় ছিল দুর্দান্ত বাঁধুনি। ডিম ব্যবহার করা হতো দেওয়ালকে চকচকে ও মসৃণ করতে। তামিলনাড়ুর চেট্টিনাড় স্থাপত্যেও ডিমের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়, রাজমিস্ত্রিরা দেওয়াল আয়নার মতো ঝকঝকে করতে ডিম ব্যবহার করেছিলেন।

আরও পড়ুন- হাড় হিম হয়ে যাবে প্রবেশ করলেই! মানুষের ৩০ হাজার হাড় দিয়ে গির্জা তৈরির নেপথ্যে যে রহস্য…

বিগত ১২ থেকে ১৮ শতকের মধ্যে ইউরোপে যে ধরনের গথিক স্থাপত্য দেখা যেত, এই গির্জাটি ছিল এক্কেবারে সেরকমই দেখতে। গির্জার ধ্বংসাবশেষে এখনও সেই গথিক ছাপ সুস্পষ্ট। কিন্তু বাইরে থেকে আমদানি করা সুদৃশ্য কাঁচের দরজা, জানালা এবং প্রত্নবস্তু সবই হারিয়ে গিয়েছে। কাঠামোর পুরো ছাদটি গুহা হয়ে গেছে। জল, বৃষ্টির চাপ সহ্য করতে করতে এখনও টিকে রয়েছে মূল কাঠামো এবং বেদিটি।

চাঙ্গারাভাল্লি, শেট্টিহাল্লি এবং মদনাকোপ্পলুর স্থানীয়দের পাশাপাশি সাক্লেশপুর এবং আলুরের ধনী ব্রিটিশ এস্টেট মালিকদের উপাসনাস্থল ছিল ডুবইসের এই গির্জা। ডুবইস ভারতে এসেছিলেন এই এলাকার স্থানীয়দের খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত করতেই। শেট্টিহাল্লি গির্জা স্থাপন তাঁর সেই ধর্মবদল প্রকল্পেরই একটি অংশ ছিল। পরবর্তী জীবনে ডুবইস অবশ্য নিরামিষ খাবার, স্থানীয় পোশাক এবং ভাষা সহ হিন্দু জীবনধারা গ্রহণ করে নেন। ফলস্বরূপ, শেট্টিহাল্লি রোজারি গির্জা ধর্ম নির্বিশেষে দরিদ্র এবং অভাবী মানুষদের সাহায্য করার একটি জায়গা হয়ে ওঠে। ১৮২৩ সালের জানুয়ারিতে ডুবইস ভারত ছেড়ে ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কথিত আছে, বিএল রাইস, রেভ. এফ কিটেল এবং হারম্যান মোগলিং সহ অনেক খ্রিস্টান পণ্ডিতই নিজেদের গবেষণার সময় এই বিখ্যাত চার্চে থেকেছিলেন। এখন অবশ্য শেট্টিহাল্লি রোজারি গির্জা এক জনপ্রিয় পর্যটনস্থল। ভেতরে গিয়ে নয়, ডুবন্ত এই ঐতিহ্যকে বাঁধের উপর সেতু থেকে দেখতে আসেন দেশ বিদেশের পর্যটকরা।

More Articles