বয়স পেরিয়েছে দু'শো বছর, আজও বাংলা-নরওয়ের অজানা কাহিনি ধরা দেয় শ্রীরামপুরের এই গির্জায়

St. Olav's Church Serampore : যে ইতিহাস গোটা ভারতে আর কোথাও নেই! এভাবেই অনন্য হয়ে উঠেছে শ্রীরামপুরের সেন্ট ওলাভ চার্চ।

এখানে গঙ্গার একদিকে ব্যারাকপুর। নদী পেরিয়ে ওপাড়ে গেলেই এক অন্য শহর, অন্য ইতিহাস। অলিতে গলিতে ছড়িয়ে আছে অজস্র অমণিমুক্তো। নীল আকাশ আর সবুজ গাছপালার মধ্যে এখনও উঁকি দেয় পুরনো ধাঁচের বাড়ি, প্রাচীন স্থাপত্য, আর তার আনাচে কানাচে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ায় অজস্র না বলা, না জানা ইতিহাস। কলকাতার মতো ইংরেজদের উপনিবেশ ছিল না প্রথম থেকে। মহানগরীর মতো চাকচিক্য, তার ঐতিহ্যও হয়তো নেই। কিন্তু গঙ্গাপারের হুগলীর শ্রীরামপুর তার নিজস্ব কাহিনি নিয়ে আজও প্রবলভাবে বেঁচে আছে। বেঁচে আছে তার মফস্বলের রোদ, আর কয়েশো বছরের পুরনো কাহিনি। খোদ কলকাতার থেকে যা অনেকটা আলাদা, স্বতন্ত্র। যে ঐতিহ্যের ভাগীদার আর কেউ হবে না।

তবে আজকের এই লেখা সমসগ্র শ্রীরামপুরকে নিয়ে নয়। সেটা অন্য কোনও সময় ছুঁয়ে দেখা যাবে। আজকের কাহিনিতে আসার আগে একবার প্রাচীন শ্রীপুর বা শ্রীরামপুরকে ছুঁয়ে দেখা যাক। একটা সময় ‘শ্রীপুর’ নামেই নাকি ডাকা হতো এই জায়গাটিকে। খোদ ‘আইন-ই-আকবরি’তেও নাকি এই শ্রীপুরের উল্লেখ আছে। বলা হয়, রাজা মান সিং নাকি এখানে নিজের তাঁবু খাটিয়েছিলেন। কিন্তু জায়গার নাম শ্রীরামপুর হল কী করে, তা নিয়ে রয়েছে নানা দ্বন্দ্ব, নানা অভিমত। প্রচলিত মত, পলাশীর যুদ্ধের আগেই এখানে একটি রামসীতার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন তৎকালীন রাজা মনোহরচন্দ্র রায়। পরে সেখান থেকেই নাকি শ্রীপুর বদলে গিয়ে হয়ে যায় শ্রীরামপুর।

Olav 1

এই শ্রীরামপুরের অলিতে গলিতে ঘুরতে ঘুরতে নজরে আসবে একটি বিশাল স্থাপত্য। সুন্দর, লম্বা সাধা চূড়া আকাশ স্পর্শ করেছে। সেখান থেকে রোদের পরত নেমে এসেছে খোলা পোর্টিকোর গায়ে। সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে জোড়া থাম। এসব পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেই প্রার্থনাকক্ষ স্বাগত জানাবে। থামের ওপর কড়িকাঠ, আর সেখান থেকে ঝুলছে ঝাড়লণ্ঠন। সব মিলিয়ে এক শান্তির পরিবেশ। যার প্রতিটা ইটে গেঁথে আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য আর শ্রীরামপুরের কাহিনি। শুধু কি তাই? ২০০ বছরেরও বেশি পুরনো এই স্থাপত্যের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক অজানা কাহিনি। যেখানে রয়েছে বাংলা আর নরওয়ের মেলবন্ধন। জড়িয়ে রয়েছে ভাইকিংদের ইতিহাস। যে ইতিহাস গোটা ভারতে আর কোথাও নেই! এভাবেই অনন্য হয়ে উঠেছে শ্রীরামপুরের সেন্ট ওলাভ চার্চ।

ব্রিটিশ ভারতের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্তি হওয়ার আগে এক অন্য কাহিনির সাক্ষী থেকেছিল শ্রীরামপুর। তখনও অবশ্য নাম বদলে যায়। শ্রীরামপুর হয়ে যায় ফ্রেডরিকগঞ্জ। মূলত দিনেমার বা ডেনমার্কের বণিকরা এখানে এসে বসতি স্থাপন করেন। তারপর ধীরে ধীরে সেটাই হয়ে ওঠে তাঁদের আবাসস্থল। আঠেরোশো শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রায় ১৮৪৫ সাল পর্যন্ত এখানে থাকেন তাঁরা। তৈরি হয় একের পর এক স্থাপত্য। আর সেখানেই জুড়ে থাকে ডেনমার্কের চিহ্ন। ফ্রেডরিকগঞ্জ নামটিও দেওয়া হয়েছিল তৎকালীন ডেনমার্কের রাজা পঞ্চম ফ্রেডরিকের নাম অনুসারে।

Olav 3

সালটা আনুমানিক ১৭৭৬। তৎকালীন ফ্রেডরিকগঞ্জের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ করা হয় কর্নেল ওলি বি-কে। অনেকে তাঁকে কর্নেল ওলাভও বলতেন। এসেই শ্রীরাম্পুরের খোলনলচে বদলানোর উদ্যোগ নিলেন। ভাবলেন, তৈরি করবেন একটি বিশাল গির্জা। যেটা শ্রীরামপুরকে সবার থেকে আলাদা করবে। ১৮০০ সালে শুরু হয় সেই গির্জা তৈরির কাজ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই কাজ সম্পূর্ণ দেখে যেতে পারেননি কর্নেল ওলি বি। তার আগেই মারা যান তিনি। পরে ১৮০৬ সালে এই গির্জার কাজ শেষ হয়। ডেনমার্কের রাজা সপ্তম ক্রিশ্চিয়ানের মনোগ্রামও বসে।

কিন্তু নাম? কর্নেল ওলি বি-র স্বপ্ন ছিল এই গির্জা। তাঁর নামেই রাখা হোক এই গির্জার নাম! কিন্তু সেটা তো করা একটু মুশকিল। তখনই চলে এল নরওয়ের গল্প। চলে এল স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ইতিহাস। নরওয়ের রাজা দ্বিতীয় ওলাভ হ্যারার্ল্ডসন ছিলেন শেষ ভাইকিং রাজা। ততদিনে পোপ তৃতীয় আলেকজান্ডারের হাত ধরে তিনি সেন্ট তকমা পেয়েছেন। খ্রিস্টান জগতেও তাঁর নাম বিখ্যাত। নরওয়ের সেই ভাইকিং রাজা ওলাভের নামের সঙ্গে মিল আছে ফ্রেডরিকগঞ্জের প্রয়াত গভর্নর ওলি বি-র। ব্যস, সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। নরওয়ের সেই ভাইকিং রাজা ওলাভকে উদ্দেশ্য করে গির্জাটির নাম রাখা হল ‘সেন্ট ওলাভ’স চার্চ’ বা সেন্ট ওলাভের গির্জা।

Olav 2

উল্লেখ্য, ইতিহাসবিদদের একাংশ বলেন, শ্রীরামপুরের এই ঐতিহাসিক গির্জাটি ভারতের একমাত্র চার্চ, যা স্ক্যান্ডিনেভিয়া নরওয়ের কোনও ভাইকিং রাজাকে উদ্দেশ্য করে বানানো হয়েছে। এদিক থেকে অনন্য সেন্ট ওলাভের গির্জা। চার্চের চূড়ায় থাকা ঘড়িটি নাকি গঙ্গাপারের ব্যারাকপুর থেকেও দেখা যায়। মাঝখানে অনেকগুলো বছর যত্নের অভাবে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে যাচ্ছিল এই গির্জাটি। কিন্তু কয়েক বছর আগে এটির সংস্কার করা হয়। এখন আবার নতুন ভাবে সামনে এসেছে এই গির্জা। সামনে এসেছে শ্রীরামপুরের ২০০ বছরেরও বেশি সময়ের এক ঐতিহ্য।

তথ্যসূত্র : হারিয়ে যাওয়া সময়ের গল্প বলে শ্রীরামপুরের গির্জারা, বঙ্গদর্শন
পুরনো কলকাতার গল্প ফেসবুক গ্রুপ, সাইদুল রহমানের লেখা

More Articles