তিব্বতে নয়, এ দেশেও রয়েছে অন্য মানস! গেলেই আয়ু দ্বিগুণ?
Manas National Park: এই পুজোটা যদি একটু অন্যরকম ভাবে কাটাতে চান, তাহলে আপনার পছন্দের ঠিকানা কিন্তু হতেই পারে অসমের এই জঙ্গল। বর্ষার পর পর সবুজে সেজে ওঠা জঙ্গল আর পশুপাখির মেলা দেখতে দেখতে মনেও পড়বে না শহরের ক্যাকাফোনির...
কেউ ভালোবাসেন পুজোয় শোরগোল, রোল-ফুচকা-চুরমুরকে সঙ্গী করে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে টহল। আবার কেউ ভালোবাসেন, লোকারণ্য থেকে দূরে নির্জন অবসর। কেউ কলকাতার পুজো ছেড়ে যেতে চোখে জল, কারও আবার পুজোর শহরে প্রাণ হাঁসফাঁস। আর এর মধ্যে আপনি যদি পড়েন দ্বিতীয় দলে, তাহলে তো পুজো মানেই আপনার পায়ের তলায় সর্ষে। পাহাড়, সমুদ্রের হাতছানি তো অনেক হল। কেমন হবে এই পুজোটা যদি আপনার কাটে গহন অরণ্যে।
আরও পড়ুন: শহরের ক্যাকাফোনি থেকে দিন তিনেকের মুক্তি, পুজো কাটান এবার ‘ঘুটঘুটানন্দজি’-র ডেরায়
হাতের কাছে জঙ্গল মানেই ডুয়ার্স, বড়জোর কাজিরাঙা, যারা ভাবেন তাঁদের বলে বলে দশ গোল দেবে এই জঙ্গল। কাজিরাঙার একেবারে পাশেই কিন্তু কাজিরাঙার থেকে রঙে-রূপে একেবারে আলাদা এই জঙ্গল। মানস বলতেই বেশিরভাগ মানুষ বোঝেন সরোবরের কথা। কিন্তু এর বাইরেও আরও এক মানস রয়েছে। অসমের বরপেটার এক আশ্চর্য জঙ্গল মানস।
বেশিরভাগ জঙ্গলই জন্তুজানোয়ারের দিক থেকে পর্যটকদের হতাশ করে। দু-একটা হরিণ দেখেই মন ভরাতে হয়। মানস তেমন নয়। জঙ্গলের সদর দরজার ধারপাশটা চা-বাগানে ঘেরা। সেখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি টুরিস্ট লজ। সেখানেও দিব্যি গুছিয়ে বসতে পারেন। সকাল বেলা ঘুম ভাঙাবে ময়ূরের তীব্র ডাক, পাখির কলকাকুলি। সেই সব কিছু সঙ্গী করে সারাদিনের খাবারদাবারের সরঞ্জাম জোগার করে বেরিয়ে পড়া জঙ্গলের উদ্দেশ্যে। আপাতত সারাদিনের ঠিকানা আপনার ওটাই।
জঙ্গলে ঢুকতে না ঢুকতে চোখে পড়বে বনমুরগির ঝাঁক। এদিক ওদিক থেকে আপনাকে স্বাগত জানাবে চিতল হরিণের ঝাঁক। গাছের ডালে বসে একটানা ডেকে চলেছে ময়ূরটা। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা দিয়ে ছুটছে জিপ। ভোরের সূর্য অভ্যর্থনা জানাচ্ছে আপনাকে। একটু দূরে উঁচু গাছের ডালে উদাস চোখে বসে রয়েছে নীলকণ্ঠ পাখির ঝাঁক। কোথাও জঙ্গল ঘন, তো কোথাও ঘাসের বন।
আরেকটু এগোলেই উঁকি দিয়ে যাবে কেপলাঙ্গুরের ঝাঁক। কোথাও মার্চপাস্ট করছে বাইসনের পাল। এসব দেখতেই দেখতেই জঙ্গলের ভিতরে কোনও একটি বনদফতরের ওয়াচটাওয়ারে সেরে নেওয়া দুপুরের খাওয়াদাওয়া। জঙ্গলের ভিতরের জোনে প্রবেশ করার জন্য আপনাকে নিতে হবে একজন সশস্ত্র রক্ষী। জঙ্গলের ভিতরে ভিতরে ছোট ছোট নদী। আশপাশে নানাবিধ ফুলের ঝোপ, নানাবিধ গাছ, জঙ্গুলে গন্ধে ম ম করে ওঠে গোটা বন।
আপনার যদি পাখি দেখার নেশা থাকে, তাহলে এ জঙ্গল আপনার জন্য আদর্শ। ইতিউতি চোখ মেললেই দেখা মিলবে স্কারলেট মিনিভেট, ব্ল্যাক রেডস্টার্ট, ইয়োলো আয়েড ব্যবলারের ছড়াছড়ি। দেখা মিলবে ব্লু থ্রোটেড বারবেট, এশিয়ান ফেয়ারি ব্লুবার্ড-সহ অজস্র পাখির। তবে এই জঙ্গলের মূল আকর্ষণ বেঙ্গল ফ্লোরিকান, যা মানস ছাড়া ভারতবর্ষের খুব কম জঙ্গলেই দেখতে পাওয়া যায়। তাছাড়া সিলভার ব্রেস্টেড ব্রডবিলের জন্যও এ জঙ্গল বিশেষ বিখ্যাত। মাথার উপর হঠাৎ করেই হেলিকপ্টারের মতো শব্দ শুনে চমকে উঠে দেখবেন ইয়াব্বড় ঠোঁটওলা ধনেশ পাখি লুফে খাচ্ছে ফল। এছাড়া নানাবিধ ছোটবড় পাখি তো রয়েইছে। গাছের কোটরে তক্ষকের ঝাঁকও কিছু কম অবাক করা নয়।
তবে মানসের জঙ্গলের মূল আকর্ষণ হাতি। হলফ করে বলা যেতে পারে, মানসে যে পরিমাণ হাতির দেখা আপনি পাবেন, তা অন্য কোনও জঙ্গলে পাওয়া দুষ্কর। একসঙ্গে একশো দুশো হাতির পাল রাস্তা পেরোলে কেমন লাগে, তা জানতে চাইলে একবার ঢুঁ মারতেই হবে এই জঙ্গলে। তাছাড়া মিলবে গন্ডারেরও দেখা। কপাল ভালো থাকলে মুলাকাত হয়ে যেতে পারে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার ও চিতাবাঘের সঙ্গে।
জঙ্গলের বাইরে থাকার ব্যবস্থা তো রয়েইছে। তবে একটু অন্য রকম অ্যাডভেঞ্চারের শখ থাকলে রাত্রিবাস করতে পারেন মাথানগুড়ির ফরেস্ট বাংলোতেও। পাশ দিয়েই বয়ে গিয়েছে মানসনদী। রাতে সে নদীতে জল খেতে আসে বন্যপ্রাণীরা। আর পূর্নিমা রাত হলে তো কথাই নেই। সে-ও এক দেখার মতো দৃশ্য। যা উপভোগ করতে পারবেন বাংলোর বারান্দায় বসেই।
জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এগোতে এগোতে পৌঁছে যাবেন ভুটানের একদম কাছে। মধ্যিখানে নদী বেঁধে রেখেছে অস্পষ্ট বিভাজন রেখা। সেটুকু বাদ দিলে এ জঙ্গল, এ নদী, এ পাহাড়, সবটাই তো এক। কোথাও কোনও তফাৎ নেই। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে হালকা ঠান্ডা এসে ছুঁয়ে দেবে শরীর। সারাদিনের রোদে তপ্ত শরীর শিরশির করে উঠবে সেই হাওয়ায়। মানসের জঙ্গলে রয়েছে হাতি সাফারির ব্যবস্থা। খুব বেশি পথ নয়, তবে সেই অভিজ্ঞতা যে অনোন্য, তা সওয়ারি মাত্রেই কেবল জানেন।
কলকাতা থেকে মানসে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সহজতম রাস্তা রেলপথ। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে উঠে সোজা বরপেটা রোড স্টেশনে নামা। তারপর জঙ্গলের কাছাকাছি হোটেলে পৌঁছতে রয়েছে জিপ বা গাড়ির ব্যবস্থা। যেতে পারেন বিমানপথেও। গুয়াহাটি বিমানবন্দরে নেমে ট্রেন ধরেও পৌঁছতে পারেন বরপেটা স্টেশনে। থাকার জন্য রয়েছে অসংখ্য হোটেল, হোমস্টে। কপাল ভালো থাকলে পেয়ে যেতে পারেন ফরেস্ট বাংলোর বুকিংও।
আরও পড়ুন: দেদার জঙ্গল সাফাই! দুশ্চিন্তা কানহা, বান্ধবগড়ের মতো জঙ্গলের অস্তিত্ব নিয়েও
এই পুজোটা যদি একটু অন্যরকম ভাবে কাটাতে চান, তাহলে আপনার পছন্দের ঠিকানা কিন্তু হতেই পারে অসমের এই জঙ্গল। বর্ষার পর পর সবুজে সেজে ওঠা জঙ্গল আর পশুপাখির মেলা দেখতে দেখতে শহরের ক্যাকাফোনির কথা মনেও পড়বে না, তার গ্যারান্টি জঙ্গলের। তবে জঙ্গলের পথে অচেনা পশুপাখির খোঁজ পেতে একজন গাইড নিতে ভুলবেন না যেন। ভুলবেন না কয়েকটা দিন বুকের হাপরে ভালো করে টাটকা অক্সিজেন ভরে নিতে।