নেপালি ছাত্রীর মৃত্যু, অপরাধীকে আড়াল, আক্রান্ত পড়ুয়ারাই! যা ঘটছে কেআইআইটি-তে
KIIT Nepali Student Death: প্রকৃতির মৃত্যুর পর একটি অডিও মেসেজ ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ে যেখানে একটি ছেলে এবং মেয়েকে কথা বলতে শোনা যায়। ছেলেটি অকথ্য গালিগালাজ করছে মেয়েটিকে, হুমকি দিচ্ছে। আর অঝোরে কাঁদছে মেয়েটি।
সোশ্যাল মিডিয়ায় দৃশ্যটি ভাসছে। হস্টেলের ঘরের দরজার উপরে, ফাঁকা জায়গা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, সিলিং ফ্যানে জড়ানো কাপড়। ভারে বোঝা যাচ্ছে, ঝুলে রয়েছে কেউ। ২০ বছর বয়সি নেপালি এক ছাত্রীর মৃত্যু (আত্মহত্যা) নিয়ে এখন তোলপাড় ওড়িশার কলিঙ্গ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেকনোলজি (কেআইআইটি)। তোলপাড় নাগরিকদের এক অংশ। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর বাসিন্দা প্রকৃতি লামসালের দেহ পাওয়া যায় রবিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি। সাধারণ মৃত্যু নয়, কোনও আত্মহত্যাই সাধারণ নয়ও। তবে প্রকৃতির মৃত্যুতে জড়িয়ে গিয়েছে অপরাধ এবং অপরাধীকে আড়াল করার সেই চিরাচরিত কৌশল। জড়িয়ে গিয়েছে ভারত নেপালের কূটনৈতিক সম্পর্কও।
প্রকৃতি লামসালের মৃত্যুর পর বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের নেপালি পড়ুয়ারা ক্যাম্পাসের মধ্যে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। বিক্ষোভের জন্য মার খাচ্ছেন। অভিযোগ, বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয় নেপালের ৫০০ পড়ুয়াকে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যেতে বলে বিবৃতি জারি করে। নেপাল দূতাবাস এবং প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির হস্তক্ষেপের পর পরিস্থিতি অন্য বাঁক নেয়। কেআইআইটি আদেশ প্রত্যাহার করে তবে, ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে যেতে থাকে যে এই ঘটনাটির নেপথ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ রয়েছে।
প্রকৃতি লামসাল ভুবনেশ্বরের কেআইআইটি-তে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন। তৃতীয় বর্ষের প্রকৃতি ছিলেন মুখচোরা স্বভাবের। পরিবারও জানিয়েছে, সহজে কোনও সমস্যা নিয়েই মুখ খুলতেন না তিনি। তবে কেন হঠাৎ নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত? জানা গিয়েছে, রবিবার কলেজ ফেস্ট ছিল। সেখান থেকে ঘরে ফিরেই এই ঘটনা। প্রকৃতির বাবা সুনীল লামসাল জানিয়েছেন, ফেস্ট থেকে ঘরে ফিরে মাকে ফোন করবেন বলেছিলেন প্রকৃতি। প্রকৃতির বাবা জানিয়েছেন, রবিবার দুপুর তিনটে বাজতে দশ নাগাদ মাকে ফোন করেছিলেন মেয়ে। তখন একেবারে স্বাভাবিক ছিলেন তিনি। প্রকৃতি জানিয়েছিলেন ফেস্টে যাচ্ছেন এবং নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে কিছুক্ষণ ফোন পারবেন না। তারপর রবিবার বিকেলবেলা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ফোন যায় পরিবারের কাছে।
আরও পড়ুন-আজ ‘অজাচার’, কাল মেয়েদের কটূক্তি! রণবীরদের সব ‘ডার্ক কমেডি’ আমাদের নজরে আসে?
প্রকৃতিকে দিনের পর দিন হেনস্থা করার অভিযোগ উঠেছে নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে। প্রকৃতি লামসালের পরিবার এবং বন্ধুদের অভিযোগ, লখনউয়ের বাসিন্দা কেআইআইটি-র ২১ বছরের বিটেক পড়ুয়া অদ্বীক শ্রীবাস্তব শারীরিক এবং মানসিকভাবে হেনস্থা করেছিলেন প্রকৃতিকে। এই অদ্বীকের ছিলেন প্রকৃতির প্রাক্তন প্রেমিক।
প্রকৃতির বাবার এক বন্ধু জানিয়েছেন, প্রকৃতি আর তাঁর মেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তাঁর মেয়ে কানাডায় থাকেন। তবে প্রকৃতি তাঁকে এই হেনস্থার কথা জানিয়েছিলেন। চুপচাপ স্বভাবের প্রকৃতি ঘটনাগুলি আর কাউকে না বলার জন্য অনুরোধও করেন। আরও জানা গেছে, প্রাক্তন প্রেমিক অদ্বীক বারেবারে হেনস্থা করতে থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দফতরেও যোগাযোগ করেছিলেন প্রকৃতি। প্রকৃতির মৃত্যুর পর একটি অডিও মেসেজ ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ে যেখানে একটি ছেলে এবং মেয়েকে কথা বলতে শোনা যায়। ছেলেটি অকথ্য গালিগালাজ করছে মেয়েটিকে এবং তাকে হুমকি দিচ্ছে। আর অঝোরে কাঁদছে মেয়েটি। দাবি করা হচ্ছে, এই মেয়ের গলাটি প্রকৃতির আর ছেলেটি অভিযুক্ত অদ্বীক। ওই অডিওতেও এই দুই নাম ধরে ডাকার উল্লেখ আছে বলে দাবি।
কেআইআইটি-র রেজিস্ট্রার জ্ঞান রঞ্জন মোহান্তি জানিয়েছেন, প্রকৃতি লামসাল অভিযুক্ত অদ্বীকের বিরুদ্ধে 'দুর্ব্যবহার' করার জন্য অভিযোগ দায়ের করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দফতরে। প্রকৃতির দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা দুইজনকেই ডেকে পাঠান, তাদের কাউন্সেলিং করান এবং অভিযুক্তকে সতর্কও করেন বলে দাবি।
এখন কেআইআইটি বলছে, প্রকৃতি লামসালের মৃত্যুর নেপথ্যে অন্য একটি ছাত্রের সঙ্গে 'ব্যক্তিগত সমস্যা'-ই দায়ী! উল্লেখ্য, সোমবারই অদ্বীককে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। প্রকৃতি লামসালের খুড়তুতো দাদা সিদ্ধান্ত সিগদেলের দায়ের করা অভিযোগে, তিনি অভিযুক্ত অদ্বীকে বিরুদ্ধে ব্ল্যাকমেল করার অভিযোগ এনেছেন, যে কারণেই প্রকৃতি চরম পদক্ষেপ করতে বাধ্য হন বলে দাবি তাঁর।
আরও পড়ুন- মোদির নিজ রাজ্য এত উন্নত হলে কেন আমেরিকায় পালাচ্ছেন গুজরাতিরা?
পুলিশ প্রকৃতির মৃত্যুতে দু'টি মামলা দায়ের করেছে। একটি তাঁর পরিবারের অভিযোগের পরে, প্রকৃতির আত্মহত্যা ও ব্ল্যাকমেল বিষয়ে এবং অন্যটি সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচারির ভিডিওর ভিত্তিতে যেখানে দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কর্মী এবং অন্যান্য কর্মীরা এই ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভরত পড়ুয়াদের গালিগালাজ ও মারধর করছেন। অদ্বীক ছাড়া প্রকৃতির মৃত্যু এবং বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে হিংসার ঘটনায় ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। যাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা রয়েছেন- ডিরেক্টর জেনারেল (এইচআর) শিবানন্দ মিশ্র, ডিরেক্টর (প্রশাসন) প্রতাপ কুমার চমুপতি এবং হস্টেলের ডিরেক্টর সুধীর কুমার রথ। পুলিশ রমাকান্ত নায়ক এবং যোগেন্দ্র বেহেরা নামে দুই নিরাপত্তারক্ষীকেও গ্রেফতার করেছে নেপালের পড়ুয়াদের বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্য করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই উর্ধ্বতন কর্মকর্তার একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। ওই ভিডিও ক্লিপটিতে দেখা যাওয়া দুই মহিলা প্রকাশ্যে ক্ষমাও চেয়েছেন। কেআইআইটি-ও ক্ষমা চেয়েছে। নেপালি পড়ুয়াদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসতে এবং আবার পড়াশোনা শুরু করার আহ্বানও জানিয়েছে। তবে পড়ুয়ারা এই ঘটনায় যথেষ্ট ভয়ের মধ্যে আছেন। কাঠমান্ডুর ভারতীয় দূতাবাস ভারতে নেপালি পড়ুয়াদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছে।
@MEAIndia@PM_nepal_@DrSJaishankar@PMOIndia@MofaNepal@IndiaInNepal@EONIndia pic.twitter.com/zPsRL0wNm8
— Jayanti Nath (@JayantiNath6) February 18, 2025
ওড়িশা সরকার প্রকৃতি লামসালের মৃত্যু এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিক্ষোভ পরিচালনার বিষয়ে তদন্তের জন্য অতিরিক্ত মুখ্য সচিবের (স্বরাষ্ট্র) নেতৃত্বে একটি উচ্চ-স্তরের প্যানেলও গঠন করেছে। এই ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং কমিটির ফলাফলের ভিত্তিতে যথাযথ আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সেই রাজ্যের সরকার জানিয়েছে। সরকারের অভিযোগ, কেআইআইটি কর্তৃপক্ষ প্রকৃতির মৃত্যু এবং নেপালি পড়ুয়াদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের বিষয়ে রাজ্য সরকারকে অবহিত করেনি। অদ্বীকের বিরুদ্ধে অভিযোগের পরেও কেন বিশ্ববিদ্যালয় সতর্ক হয়নি? কেন প্রকৃতির মৃত্যুর পর উলটে নেপালি পড়ুয়াদেরই নিশানা করা হলো, প্যানেল সেই প্রশ্নের উত্তর পাবে তো? না কি অজস্র মৃত্যু ও হেনস্থার মতোই ধামাচাপা পড়ে যাবে প্রকৃতির মৃত্যুও?