মফসস্‌লের উস্কোখুস্কো চরিত্ররা, বানি হতে চেয়ে, নয়না হয়ে গেল যারা...

Yeh Jawaani Hai Deewani: আমরা কি আসলে সবাই ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি দেখে বানি হতে চেয়েছিলাম, আর অনেকগুলো বসন্ত পার করে আজ মেনে নিয়েছি আসলে বানি হওয়া যায় না?

মুম্বইয়ের বর্ষার সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়ার রোদের যদি তুলনা করতে বলি, কলোনিয়াল হ্যাংওভারে ভোগা বাঙালি হয়তো খুব স্বাভাবিকভাবেই দ্বিতীয়টা পছন্দ করবে। আবার, গাজরের হালুয়া থেকে আমরা এগিয়ে রাখব ব্লুবেরি চিজ কেক-কেই। প্যারিস দেখতে পাওয়ার সঙ্গে হয়তো হেরে যাবে ময়দানের সূর্যোদয়!

২০১৩ সালে মুক্তি পাওয়া একটা ছবি। আমাদের হঠাৎ পাওয়া কিছু স্বপ্ন। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সরকারি চাকরি পেতেই হবে-র সামাজিক নিয়মের মাঝে হঠাৎ চলে আসা বানি নামের একটা ছেলে এবং "বড় হয়ে কী হতে চাস?" এই প্রশ্নের উত্তরে এক নয়া সংযোজন। হাতে ক্যামেরা, কাঁধে ট্রাইপড, গায়ে কালো হুডি, পিঠে ব্যাকপ্যাক। ছুটে চলা পৃথিবীর মানচিত্র বরাবর। থুড়ি! জীবনের মানচিত্র বরাবর।

তখনও সিনেমাকে 'বই' বলতাম। মফসসলের ছেলেদের রবিবারের ছায়াছবি যেমন ছিল আর কী! প্রথমে সাদাকালো টিভিতে উত্তম, সুচিত্রা, সন্তু মুখার্জি! অরণ্যের দিনরাত্রির মেমোরি গেমে পাওয়া 'হেলেন অফ ট্রয়' আসলে যে কে, সেটা জানতেও স্কুলের মাস্টার মশাইয়ের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল আমাদের।

একটু বড় হওয়ার পর ছাদে উঠে গিয়ে টিভি অ্যান্টেনাটা ভালো করে নেড়েচেড়ে নিয়ে আসা প্রসেনজিৎ, চিরঞ্জিত, তাপস পাল, ঋতুপর্ণাকে পেয়ে যারপরনাই আনন্দিত বোধ করেছিলাম আমরা। মাঝে মধ্যেই লোডশেডিং ব্রেক, তারপর পড়তে বসাবার আগে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে ফেলা প্যানোরোমা টিভির 'বই'-কে। সিনেমাহলেও যারা একসময় বই দেখতে যেত, সেই নব্বই দশকের লাস্ট ব্যাচ ২০১২-১৩ তে এসে শিখল বই নয়, ওটাকে সিনেমা বলতে হয়। ফিল্ম বললে আর একটু শুনতে ভালো লাগে। নেহাত যদি বাংলাতেই বলতে চাও, তবে ছবি বলতে পারো।

সদ্য দেব-শুভশ্রী জুটি এসে হাউসফুল দিচ্ছে। দমদমের চেতনা হলের দোতলা থেকে ঝাঁপ দিচ্ছে পাড়ার টুকাই, লোকাল ট্রেনে মেয়েদের দেখে 'কবে তুমি নাম ধরে ডাকবে' গেয়ে থাপ্পড় খাচ্ছে সুকান্ত পল্লীর পলাশ মণ্ডল। কোচিং থেকে বেরিয়ে সোজা মেলার মাঠ। তারপর টিফিনের পয়সা জমিয়ে মেয়েরা কিনছে দেব-পায়েলের আইলাভইউ সিনেমার ছবি। স্কুল ফিরতি পথে মুখে কুলের আঁটি ঘুরোতে ঘুরোতে পেন দিয়ে শাহরুখের সিনেমার গোঁফ আঁকছে লাস্ট বেঞ্চের ছেলেটা।

আরও পড়ুন-সিনেমার ভাঙাগড়া ও এক ছবিওয়ালার মন

ঠিক এরকম একটা মফসসলে একদিন ইয়াব্বড় মোবাইল টাওয়ার বসল,বিশ্বাসদের বাড়ির ছাদে বন্ধ হলো ঘুড়ি ওড়ানো। সদ্য হাতে পাওয়া টু-জি ইন্টারনেটকে কাজে লাগিয়ে কেউ কেউ ডাউনলোড করে ফেলল হল-প্রিন্ট সিনেমা। তখন চাহিদা কমতে শুরু করেছিল সিডি ক্যাসেটের দোকানে। ধুলো জমছিল এসটিডি বুথেও। সেই মোবাইল সন্ধিক্ষণে কলেজ গেটের বাইরে প্রেমিকা পেনড্রাইভ হাতে দিয়ে বলেছিল, "সিনেমাটা দেখিস। ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি। নিজের জীবনকে খুঁজে পাবি।"

আমাদের এবড়োখেবড়ো মফসসলের রাস্তা আর বামফ্রন্টের দেওয়াল লিখনের বড় হওয়ায় জীবন মানে তো বাঁচতে গেলে লড়া, আর লড়াই করে বাঁচাই জানতাম! সেখানে সিনেমায় জীবন দেখতে পাওয়া যাবে ভেবে অবাক লেগেছিল বৈকি। এদিকে কলেজে তখন চুল ঝাঁকানো ছেলের দল বাড়ছে। গিটার হাতে আমরা গেয়ে নিচ্ছি ফুটপাথ ঘেঁষা বেলুন গাড়ি, হলুদ পাখির গান। তারই মধ্যে ঢুকে পড়ল কবীরা-বানি নামের একটা ছেলে। চিরাচরিত সমাজের কাছে যার নাম নির্দ্বিধায় ব্যাডবয় হতে পারে। বিয়ে যে এত 'তাম ঝাম কে সাথ' হতে পারে সেটাও অজানা ছিল এই সিনেমাটি দেখার আগে। ডেস্টিনেশন ওয়েডিং আবার কী? বড়লোকি বিয়ে মানে তো মেরেকেটে ড্রিমল্যান্ড রিসর্ট। বিনোদের ফুচকার স্টল। বাটি আইসক্রিম!

দামী মোবাইল আসেনি তখনও পাড়ায়, হাতে পাইনি থ্রি-জি কানেকশন। দক্ষিণ কলকাতার বাবুদের মতো ইংরেজি সিনেমা দেখবারও তেমন অভ্যেস নেই। আমাদের কাছে তো সিনেমার নায়ক মানে চুরুট খাবে, সানগ্লাস পরবে, ট্যাক্সি থেকে নামবে, ভালো গান গাইবে, সব পরীক্ষায় প্রথম হবে, 'তেরে নাম'-এর মতো চুল কাটবে। খুব বেশি হলে দাদার কীর্তির কেদারের মতো কেউ একজন হতে পারে। আগন্তুকের উৎপল দত্ত যদিও খানিকটা বোহেমিয়ান চরিত্রের উদাহরণ ছিলেন আমাদের মগজে, তবু ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানির বানি তার থেকে ভীষণ আলাদা। আমাদের চেনা নায়কের থেকে তো একেবারেই। লাস্ট বেঞ্চে বসা, পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়া, মাঝরাতে বাড়ি ফেরা, বিভিন্ন মেয়েদের সঙ্গে রাতযাপন; এই দর্শনকেও যে ভারতীয় দর্শকের মনে (মূলত নাইন্টিজের লাস্ট ব্যাচকে) রোম্যান্টিসাইজ করানো যায় সেটা কিন্তু ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি দেখার আগে আমাদের জানা ছিল না। প্রেমিকার মনে জায়গা করে নিতে ছেঁড়া পাতায় মাঝে মধ্যে সুনীল-শক্তি এদিক ওদিক করে লিখে দেওয়া, মাধ্যমিকে বেশি নম্বর পেয়ে খুব বেশি হলে একটা গিটার!

কিন্তু ক্যামেরা? মানে ডিএসএলআর তাই বলে!

কাঁধে চাপিয়ে শিকাগো ইউনিভার্সিটি। আমেরিকার অলিগলি। ট্র্যাভেল জার্নালিজম! বাঙালির মধ্যবিত্ত জীবনের 'দি-পু-দা'র শেষটাই যারা একদিন পৌঁছতে পারত না, তাদের কাছে এই ব্যাপারগুলো একপ্রকার স্বপ্নের মতো ছিল সেদিন। ছিল না সোশ্যাল মিডিয়া, তাই ট্র্যাভেল ভ্লগ, রিলস; এগুলো আসেনি হাতে। তারপর বানির সেই স্বপ্নের ডায়েরিটা, যেখানে পৃথিবীর মানচিত্রের অলিগলি আঁকা ছিল। ভেনিস, লন্ডন!

-ইয়ে বুক ক্যায়া হ্যায় বানি?
- মেরা সপনা।

আমরাও কি সেই স্বপ্নের মাঝেই ঢুকে পড়লাম? বোধ হয়। ক্লাস টুয়েলভ পাশ করে ঠিক করলাম ট্র্যাভেল জার্নালিস্ট হব। ঘুরে দেখব পৃথিবীর কানাগলি। অজানা-অচেনা মানুষের গল্প শুনব। ভাস্কো- দা-গামাকে হঠাৎ মনে পড়ল। বাইশ বছরে চাকরি, ছাব্বিশে বিয়ে, তিরিশে বাচ্চা আর ষাট বছরে রিটায়ারমেন্ট! এই একঘেয়ে জীবনে বাঁচব না। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, স্কুল চাকুরের লোভনীয় চাকরি ছাড়ব। ক্যামেরা হাতে বলব, 'দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ মাই স্টুডিও'! তাই সিনেমার শেষ দৃশ্যে যখন বানি নয়নার কাছে ফিরে আসে, ছেড়ে আসে গোটা জীবন ধরে স্বপ্ন দেখা প্যারিসের টিভি-শো সঞ্চালনার প্রস্তাব, তখন ব্যাপারটা মেনে নিতে পারি না। বানিকে একজন হেরে যাওয়া মানুষ মনে হয়। গল্প হলেও সত্যির শেষ দৃশ্যের রবি ঘোষ কিংবা পলাতকের অনুপ কুমারের মতো যাকে দেখতে চেয়েছিলাম আমরা, সে নয়নার ভালোবাসার কাছে ধরা দেয় বলে রাগ হয়। শেষটা ঠিক বানিসুলভ মনে হয় না।

তবে জীবনকে সেদিন দেখতে পেয়েছিলাম বটে। লাল পেনড্রাইভে পাইরেটেড ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি দেখে বেশ কয়েকটা রাত ঘুমোতে পারিনি। আড়াইশো টাকার ১ জিবি ইন্টারনেট খরচ করে খুঁজে চলেছিলাম প্রাগ, প্যারিস, নাপোলি, শিকাগো, আমস্টারডাম কীভাবে যেতে হয়। কত দাম হয় একটা ব্লুবেরি চিজ কেকের! যেসব নাম আমরা স্কুলের ভূগোল বইতে পড়িনি সেখানকার আঞ্চলিক ভূগোল জেনে নিচ্ছিলাম ওই কিঞ্চিৎ ইন্টারনেটে। তৈরি হচ্ছিল বানির মতো একটা স্ক্র্যাপ বুক, যার মলাটের গায়ে লিখে ফেলছিলাম, "ম্যায় উড়না চাহতা হুঁ। দৌড়না চাহতা হুঁ। গিরনা ভি চাহতা হুঁ। বস রুকনা নেহি চাহতা।"

আরও পড়ুন- জার্নালিজম পড়ে বিয়েবাড়ির ক্যামেরাম্যান!

এরপর অনেকগুলো বছর কেটে গিয়েছে। সারদা, রোজ ভ্যালিতে টাকা জমিয়ে যেসব বাবা মায়েরা ভেবেছিলেন ছেলে-মেয়েকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন, সর্বস্বান্ত হওয়ার পর তারা ব্যর্থতার পথে হেঁটে কেউ আজ রং মিস্ত্রি, কেউ গ্র্যাজুয়েট চা-ওয়ালা। আমরা হাতে পেয়েছি সস্তা ইন্টারনেট। মোবাইল স্ক্রিনে তুক্কা লাগিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার রোদ, স্পেনের লা-টম্যাটিনা ফেস্ট, জোহানেসবার্গের ক্রিকেট দেখে ফেলছি অনায়াসে। সেদিনের ট্র্যাভেল জার্নালিস্ট হতে চাওয়া মেয়েটি হয়ে গেছে কলেজের প্রফেসর, ছেলেটি রেস্তোরঁর ম্যানেজার। ধুলো জমেছে সেই স্ক্র্যাপবুকের গায়ে আজ। "ম্যায় রুকনা নেহি চাহতা হুঁ" বলতে এখন ভয় লাগে তাদের।

এই তো ক'দিন আগেই কলকাতার বহু প্রেক্ষাগৃহে নতুন করে রিলিজ করেছিল ছবিটি। হল ভরেছিল খানিক। বন্ধ হয়ে যাওয়া রমা, মিত্রা, রূপবাণীর চত্বরে গজিয়ে ওঠা মাল্টিপ্লেক্সে আমরা যারা একদিন সিনেমাকে বই বলতাম, তারাও গিয়েছিলাম। আর দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, তবে কি বানি হওয়া শুধুই স্বপ্ন? আর নয়নাই বাস্তব?

আমরা কি আসলে সবাই ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি দেখে বানি হতে চেয়েছিলাম, আর অনেকগুলো বসন্ত পার করে আজ মেনে নিয়েছি আসলে বানি হওয়া যায় না? হতে দেয় না আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, বাস্তবতা। বাইশে চাকরি পেয়ে ছাব্বিশে বিয়ের কথা ভাবতে হয় কারণ মা-বাবার বয়স হয়ে যায়। তিরিশে বাচ্চা নিয়ে নিতে হয় হাজারটা কারণে। আর বাকি জীবনটা কেটে যায় মৃত্যুর অপেক্ষায়? রে কবীরা গাইতে গাইতে চোখের কোণ ভিজে যায়। বড় হয়ে যাই। ইনস্টাগ্রামে পাওয়া দেশ-বিদেশের রিল পুরনো বন্ধুদের পাঠিয়ে আমরা বাঁচিয়ে রাখি ভূগোল বইতে পড়া নীলনদকে, বানিকে। কিন্তু রিল থেকে জীবন যখন রিয়েল হয়, তখন সান ফ্রান্সিসকোর মাটন বার্গারের চেয়ে বাড়িতে বানানো মাটন বিরিয়ানি প্রিয় মনে হয়। আমরা বড় হয়ে যাই, বানি হতে হতে, আচমকাই নয়না হয়ে যাই। 

More Articles