ভূমিকম্পে মৃত্যুর ঢল, আন্তর্জাতিক সাহায্যের জন্য চাতকের অপেক্ষায় আফগানিস্তান

এ-পর্যন্ত প্রায় ২৮০ জন মারা যাওয়ার খবর এসেছে, প্রচুর মানুষ আহত হয়েছেন। এখনও উদ্ধারকার্য চলছে। আফগানিস্তানের ৫০০ কিমি বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে মানুষ এই কম্পন অনুভব করেছেন। এমনকী, পাকিস্তান এবং ভারতে পর্যন্ত এই কম্পন টের পাওয়া...

আজ সকালে ভয়ংকর এক ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল আফগানিস্তান। এ-পর্যন্ত প্রায় ২৮০ জন মারা যাওয়ার খবর এসেছে, প্রচুর মানুষ আহত হয়েছেন। এখনও উদ্ধারকার্য চলছে। আফগানিস্তানের ৫০০ কিমি বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে মানুষ এই কম্পন অনুভব করেছেন। এমনকী, পাকিস্তান এবং ভারতে পর্যন্ত এই কম্পন টের পাওয়া গেছে।

প্রকৃতিকে মানুষ যতই নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করুক, প্রযুক্তি দিয়ে গড়ে তুলুক নিজস্ব দুর্গ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রত্যেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, এই চেষ্টার অসারতা। ভূমিকম্প বিশ্বের সবথেকে প্রাণঘাতী বিপর্যয়গুলির মধ্যে একটা। ভূগর্ভস্থ প্লেটগুলির পারস্পরিক সংঘাতে কেঁপে ওঠে জমি। বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার সিংহভাগ ভূমিকম্প প্লেটজনিত কারণেই হয়। বাড়ি ভাঙে, ভাঙে বহুতল, ফেটে যায় রাস্তা, গাছ পড়ে উল্টিয়ে— এককথায় পালিয়ে আশ্রয় নেওয়ার জায়গা নেই তেমন। বিদ্যুৎ, টেলিফোনের লাইন উপড়ে যায়। ভূমিকম্পের ধাক্কায় সমুদ্রে সুনামির সৃষ্টি হয়।

২০০৪-এর ২৬ ডিসেম্বরের সেই সুনামির বীভৎসা এখনও ভোলেনি মানুষ। এতে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যাণ্ড, ভারত প্রভৃতি দেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ভূমিকম্পের ফলে কখনও উচ্চভূমি সমুদ্রের জলে ডুবে যায়। আবার কখনও সমুদ্রের তলদেশের কোনও স্থান উঁচু হয়ে সমুদ্রে দ্বীপের সৃষ্টি করে। ভূমিকম্পের ঝাঁকুনিতে ভূপৃষ্ঠ আনুভূমিক পার্শ্বচাপের প্রভাবে কুঁচকে যায়, তাতে ভাঁজ পড়ে। পার্বত্য অঞ্চল থেকে ধস নেমে নদীর গতি রোধ করে। ফলে অনেক সময় হ্রদেরও সৃষ্টি হয়। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে মারা যায় বহু মানুষজন। রেলপথ, সড়কপথ, পাইপলাইন প্রভৃতি ভেঙে যায়। তাতে করে যাতায়াত ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন: হু হু করে পতন জনসংখ্যায়, কেন এই অবস্থা চিনের?

পাহাড়ি অঞ্চলে সবথেকে বড় আশঙ্কা থাকে বড় বড় বাঁধগুলিকে নিয়ে। এছাড়া কালভার্ট, সেতু প্রভৃতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্র থেকেই সাধারণত ছড়িয়ে পড়ে এই তরঙ্গ। আফগানিস্তানের খোস্ত শহর থকে সাতাশ মাইল দূরে পাকিস্তান বর্ডারের কাছে এই ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল বলে জানা গিয়েছে। আফগানের রাজধানী কাবুলের এক বাসিন্দা ইউরোপিয়ান মেডিটেরানিয়ান সিসমোলজিক্যাল সেন্টার-এর ওয়েবসাইটে ভূমিকম্পটিকে বেশ শক্তিশালী এবং দীর্ঘ ঝাঁকুনির ভূমিকম্প বলে ব্যাখ্যা করেছেন। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে বিধ্বস্ত কাবুলের নানান ছবি। আহতদের কাউকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, পূর্ব পাকতিকা অঞ্চলে মানুষের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে গিয়েছে, আতঙ্কিত মানুষের ঢল—ইত্যাদি নানাবিধ ছবি ছড়িয়ে গিয়েছে আন্তর্জালে। ইতিমধ্যে বাখতার নিউজ এজেন্সি নামে একটি সংস্থা জানিয়েছে হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়ারই সম্ভাবনা রয়েছে। ৬০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন এ-পর্যন্ত।

সরকারের পক্ষ থেকে বিলাল করিমি জানিয়েছেন, 'দুর্ভাগ্যবশত, গত রাতে প্রচণ্ড ভূমিকম্প হয়েছে পাকতিকার চারটে জেলায়। এতে শয়ে শয়ে লোক মারা গিয়েছেন, আহত হয়েছেন। আমাদের দেশের বহু নাগরিকের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে গিয়েছে। আমরা সমস্ত সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের কাছে আবেদন করছি আপনারা ঘটনাস্থলে পৌঁছন, পীড়িতদের সাহায্য করুন। যাতে মানুষ একটু আরাম পায়। আমরা দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে পারি।'

পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদেও জোর ঝাঁকুনি টের পেয়েছেন বাসিন্দারা। যদিও ক্ষয়ক্ষতি কিছুই সেখানে হয়নি। বিবিসি উর্দু জানিয়েছে পাকিস্তানের নাগরিকদের কোনওরকম দুর্ভোগই পোহাতে হয়নি। অপরদিকে আমেরিকার জিওলজিক্যাল সার্ভে জানিয়েছে, রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের পরিমাপ ছিল ৬.১। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫১ কিমি গভীরে ছিল এর কেন্দ্র। ভূমিকম্পে আফগানিস্তানে এত বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, কারণ বেশিরভাগ মানুষই সেসময় ঘুমিয়েছিলেন। সচেতন হওয়ার অবকাশটুকুও তাঁরা পাননি।

এছাড়া আফগানিস্তানে ভূমিকম্পের প্রভাব একটু বেশিই। বিশেষত, গ্রামাঞ্চলের বাড়িগুলি খুব যত্ন নিয়ে নির্মাণ করা হয় না, ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলি নড়বড়ে হয়ে থাকে। ফলে, ভূমিকম্পের সময় সেগুলি ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা থাকে ষোলো আনাই। টেকটনিক প্লেট ইউরেশিয়ান প্লেটটিকে এখনও ঠেলে চলেছে উত্তরে। তার ওপর আফগানিস্তানে এমনিতেই ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার মধ্যে পড়ে। অনেকগুলি ফল্ট লাইনের (ভূচ্যুতি) ওপরে অবস্থিত এই দেশটি। চমন ফল্ট, হরি রুদ ফল্ট, সেন্ট্রাল বাদাকশান ফল্ট এবং দারওয়াজ ফল্টের মতো বিখ্যাত ফল্ট র‍য়েছে এই অঞ্চলে। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের কো-অর্ডিনেশন অফ হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্স–এর রিপোর্ট বলছে আফগানিস্তানে গত এক দশকে ভূমিকম্পের কারণে মারা গিয়েছে ৭০০০-এরও বেশি মানুষ। প্রতি বছরই গড়ে ৫৬০ জন মানুষ ভূমিকম্পে প্রাণ হারান এই অঞ্চলে।

ইন্টেরিয়র মিনিস্ট্রি অফিসিয়াল সালাহুদ্দিন আয়ুবি জানান, 'খোস্তে মারা গিয়েছেন ২৫ জন, আরও ৯০ জনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।' একদম প্রান্তিক ও পাহাড়ি গ্রামাঞ্চলগুলিতে হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলেই আশঙ্কা তাঁর। সমস্ত খবর পেতে এখনও বেশ খানিকক্ষণ সময় লাগবে। সরকারের তরফ থেকে উদ্ধারকার্য শুরু হয়েছে জোর কদমে। হেলিকপ্টারে করে দ্রুত আহতদের নিকটবর্তী হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ওষুধপত্র, খাবারদাবার ইত্যাদি মানুষের কাছে পৌঁছনোর ব্যবস্থাও করা হচ্ছে হেলিকপ্টারের সাহায্যেই।

এমনিতেই আফগানিস্থানের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। দুই দশক লড়াইয়ের পর গত বছর আগস্টে মার্কিন সেনা তুলে নেওয়া হয় আফগানিস্তান থেকে। সেই সময়েই তালিবানেরা দখল নেয় আফগানিস্তানের। এই ঘটনায় বহু দেশের সরকার আফগানিস্তানের ব্যাঙ্কিং সেক্টরের ওপর নানা বিধিনিষেধ বসিয়ে রেখেছে। উন্নতির খাতে আসা কোটি কোটি টাকার সাহায্য আপাতত বন্ধ। যদিও হিউম্যানিটারিয়ান এইড অর্থাৎ মানবিক সাহায্য আসা এখনও জারি রয়েছে, জারি রয়েছে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের নানা কার্যকলাপও। আফগানের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র জানিয়েছেন যে কোনও ধরনের আন্তর্জাতিক সাহায্য তাঁরা গ্রহণ করতে প্রস্তুত। ২০১৫ সালেও এমনই একটি ভূমিকম্পে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের প্রচুর লোকজন মারা গিয়েছিলেন।

 

More Articles