আকাশপথে 'বিপ্লব'? ভারতকে যে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছেন রতন টাটা

Air India with Vistara: এয়ার ইন্ডিয়ার সঙ্গে ভারতবাসীর সম্পর্ক অত্যন্ত পুরনো। এবার সেই সংস্থার হাত ধরেই নতুন দিগন্তের স্বপ্ন দেখছে দেশের আকাশপথ...

ট্রেন-ট্রাম বা বাস-অটো হোক, কিংবা লঞ্চ, জাহাজ, সাবমেরিন – পায়ের তলায় সর্ষে ফুটলে ভারতীয়দের ঘরে রোখা দায়। কাজের জন্য হোক বা নিছক ভ্রমণ, বেরিয়ে পড়লেই হল। এসবের পাশাপাশি জটায়ু-পুষ্পক রথের দেশে বিমানের গুরুত্বও অপরিসীম। মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেটির স্বপ্ন থাকে, একদিন প্লেনে চড়ব, মনের মতো জায়গায় ঘুরতে যাব। অপুর প্রথম রেলগাড়ি দেখার মতো। দীর্ঘদিন ধরে ভারতের আকাশ পথের অন্যতম প্রধান সহায়ক হয়ে উঠেছিল এয়ার ইন্ডিয়া সংস্থাটি। বেসরকারি হলেও, প্রায় শতবর্ষ পুরনো সংস্থাটি ভারতীয়দের ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে আজ। সেই বন্ধন আরও মজবুত করতে নতুন উদ্যোগ নিল এয়ার ইন্ডিয়া। মঙ্গলবার সিঙ্গাপুর এয়ার লাইন্সের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তাতে আরেক বিমান সংস্থা ভিস্তারার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে এয়ার ইন্ডিয়া। তার ফলে আকাশপথে এই সংস্থার পরিসর আরও বড়ো হল। যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি চুক্তি বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহল।

আরও পড়ুন : আকাশপথে হঠাৎ উধাও! আজও খোঁজ মেলেনি এই রহস্যময় বিমানের

ভিস্তারার পরিচয় কী? সঠিকভাবে দেখলে, এই বিমান সংস্থাটিও টাটাদেরই একটি উদ্যোগ ছিল। টাটা সন্স এবং সিঙ্গাপুর এয়ার লাইন্সের যৌথ উদ্যোগে তৈরি হয়েছে এই ভিস্তারা। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠা হলেও, ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে নিজের যাত্রা শুরু করে এটি। দেশের অভ্যন্তরীণ ও বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় বিমান পরিষেবা দেওয়ার কাজ করছিল ভিস্তারা। এখন এই সংস্থাটি টাটার এয়ার ইন্ডিয়ার সঙ্গে এক হয়ে গেলে বিমান পথের পরিসরটি আরও বাড়বে বলে আশাবাদী অনেকে। সিঙ্গাপুর এয়ার লাইন্সের পক্ষ থেকে সরকারিভাবে এই সংযুক্তির কথা জানানো হয়েছে। এছাড়াও এএনআই সূত্রে জানা গিয়েছে, নয়া এই বিমান সংস্থায় প্রায় ২০,৫৮৫ মিলিয়ন টাকা বিনিয়োগ করবে এসআইএ। সেইসঙ্গে মোট শেয়ারের ২৫.১ শতাংশও থাকবে তাদের হাতে। সিংহভাগটাই থাকবে টাটা গোষ্ঠীর হাতে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২৪ সালের মার্চের মধ্যেই এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে চায় দুই সংস্থাই।

কিন্তু কেন এমন উদ্যোগ? বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই মুহূর্তে যে কোনও সংস্থার ক্ষেত্রে সম্পদের সঠিক ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি। এয়ার ইন্ডিয়া ও ভিস্তারা, দু’টি সংস্থা মিলে গেলে টাটাদের পরিকাঠামোর পিছনে খরচ আগের থেকে কমানো যাবে। সেইসঙ্গে সঠিকভাবে পরিকল্পনা করে একটা বৃহৎ বাস্তুতন্ত্র তৈরির ক্ষেত্রেও একটা বড়ো ভূমিকা নিতে পারে এই চুক্তি। এর ফলে এয়ার ইন্ডিয়ায় বিমানের সংখ্যা বাড়তে পারে। চলতি বছরেই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও বিশেষজ্ঞ মহল সূত্রে জানা গিয়েছিল, বিপুল সংখ্যক বিমান কেনার বরাতও দিয়েছে এয়ার ইন্ডিয়া। এরপর ভিস্তারার সঙ্গে সংযুক্তিকরণ একপ্রকার ‘রাজা’ হিসেবেই নিয়ে আসবে এয়ার ইন্ডিয়াকে। ভ্যারতের অসামরিক বিমান পরিবহণের ইতিহাসে যা অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী ঘটনা।

আরও পড়ুন : অ্যান্টিলা ফেল! আম্বানির রাজপ্রাসাদকেও টেক্কা দেবে রতন টাটার এই বিলাসবহুল বাড়ি

আজ থেকে নয়, ভারতবাসীর সঙ্গে এয়ার ইন্ডিয়া ও টাটার সম্পর্ক অনেক পুরনো। স্টিল ফ্যাক্টরি থেকে বিমান সংস্থা, গবেষণা কেন্দ্র, হাসপাতাল, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্র – সমস্ত জায়গায় টাটা গোষ্ঠীর অবদান অবশ্যই স্মরণীয়। সেই সোনার ইতিহাসের তালিকায় যোগ করে নেবে এয়ার ইন্ডিয়াও। ইতিহাস বলে, ১৯৩২ সালে এই বিমান সংস্থার জয়যাত্রা শুরু হয়। হিসেব কষলে দেখা যাবে, নয় নয় করে নব্বই বছর হয়ে গিয়েছে। এয়ার মেল সার্ভিস দেওয়ার জন্য প্রথম এর উড়ান শুরু হয়। তখন অবশ্য এর নাম ছিল টাটা এয়ার লাইন্স। ঠিক ছয় বছর পরই ভারতবাসীকে আকাশপথে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নেয় এই সংস্থা। যাত্রীবাহী বিমান হিসেবে প্রথম উড়ান ছিল মুম্বই থেকে ত্রিবান্দ্রামে (বর্তমানে তিরুবনন্তপুরম)। এমনকী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও রয়্যাল এয়ারফোর্সকে সাহায্যও করে এই সংস্থা। বিশ্বযুদ্ধের পরই ১৯৪৬ সালে হয় নাম পরিবর্তন। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে এর আত্মপ্রকাশ, নাম বদলে হয়ে যায় ‘এয়ার ইন্ডিয়া’। সেই ব্র্যান্ড আজও চলিতেছে সমানে সমানে।

স্বাধীনতার পর অবশ্য পরিস্থিতি বদলে যায়। টাটা গোষ্ঠীর থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার একটা বড়ো অংশ কিনে নেয় ভারত সরকার। প্রাইভেট লিমিটেডের তকমা উঠে যায়। কিন্তু রঙটা একই থাকে। সেই লাল স্ট্রাইপ, হলুদে আঁকা সূর্যের কিরণ, আর লাল পাগড়ি, লাল কুর্তা পরিহিত ‘মহারাজা’। এয়ার ইন্ডিয়ার ব্র্যান্ড লোগোও ভারতের শিল্প ও বিমান পরিষেবার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। ‘অতিথি দেব ভবঃ’ এই মন্ত্রই যেন ফুটে উঠছে সেখানে। সেইসঙ্গে আছে এয়ার ইন্ডিয়ার পরিষেবা, যার জন্য মানুষের মনেও একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে এই সংস্থার। বেসরকারি হলেও, টাটা গোষ্ঠী যেন ভারতের আপন সঙ্গী।

আরও পড়ুন : প্রেমে পড়েছিলেন তিনিও! কেন সারাজীবন বিয়ে করলেন না রতন টাটা?

বেসরকারিকরণ – এই মুহূর্তে ভারতের অর্থনৈতিক, শিল্প ও রাজনীতির মানচিত্রে অন্যতম বড়ো শব্দ। দিনের পর দিন বিরোধীদের অন্যতম হাতিয়ার এই শব্দটি। সরকারি, রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলি বেসরকারি গোষ্ঠীর হাতে বেচে দেওয়ায় বিভিন্ন বিপদের হাতছানিও দেখছে সেখানকার কর্মীরা। এতদিনের কাজের পরিবেশ কি বদলে যাবে? কর্পোরেট আবহে ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত থাকবে তো? ইদানিং পৃথিবীজুড়ে বড়ো বড়ো সংস্থাগুলি রাতারাতি নিজেদের কর্মী ছাঁটাই করছে। সেই ভয়ও রয়েছে মধ্যবিত্ত চাকুরীজীবীর মধ্যে। কিন্তু ৬৮ বছর পর যখন এয়ার ইন্ডিয়া ভারত সরকারের হাত থেকে ফের টাটা গোষ্ঠীর কাছে গেল, এই বিতর্কের সুর সেভাবে শোনাই যায়নি। কারণ? বিশ্বাসযোগ্যতা। এত বছরের রাজত্বকালে সেই জায়গাটি তৈরি করেছে জামশেদজি টাটার প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটি। তাই ‘মহারাজা’কে নিয়ে দেশবাসী সেই সময় আপ্লুত হয়েছিল।

তাই এয়ার ইন্ডিয়া ও ভিস্তারার সংযুক্তিকে একটু অন্য চোখেই দেখছে দেশ। ভারতের বৃহত্তম বিমান সংস্থা হওয়ার দৌড়ে অনেকখানিই এগিয়ে গেল টাটা গোষ্ঠী। সরকারি সংস্থা বেসরকারি হাতে গেলেও টাটাদের প্রতি বিশ্বাসে এতটুকু চিড় ধরেনি মানুষের। কর্মীরাও খুশি। আর ভিস্তারার সঙ্গে সংযুক্তি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়ে গেলে কর্মীসংখ্যাও বাড়বে। তৈরি হবে নতুন পরিকাঠামো। সব মিলিয়ে ভারতের বিমান ব্যবস্থা একটা নতুন উড়ানের দিকে তাকিয়ে।

More Articles