ভারতের প্রথম সিকুয়্যালে নিজের স্টান্ট করেছিলেন নিজেই, কে এই নায়িকা?
India's First Ever Sequel: অনেকেই মনে করতে পারেন, পশ্চিমী দুনিয়ার কাছ থেকে ভারতীয়রা এই নতুন ঝোঁক শুরু হয়েছে। আদতে তা নয়। ফ্র্যাঞ্চাইজের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে ভারতীয় সিনেমার।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সিকুয়্যাল এবং ফ্র্যাঞ্চাইজের ব্যাপারটা জলভাত হয়ে গিয়েছে। দর্শক পছন্দও করছেন। আবার কমিক্সের ক্ষেত্রে, পশ্চিমী রূপকথার ক্ষেত্রে বা ভিডিও গেমের ক্ষেত্রে যে ধরনের স্বতন্ত্র জগৎ আমরা দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম, যেখানে এক নায়ক-স্থানীয় চরিত্রের দেখা হয়ে যেত আরেক নায়ক-স্থানীয় চরিত্রের সঙ্গে, এক গল্পের ভিতর ঢুকে পড়ত অন্য গল্পের অংশ, সেই ইউনিভার্স-এর ধারণাও ভারতীয় সিনেমায় বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। সিংহভাগ সিনেমাই হয় কোনও ছবির সিকুয়্যাল, নয় কোনও সিনেমাটিক ইউনিভার্সের অংশ। এমন কি যে'সব ছবি স্বতন্ত্র গল্প বলছে, তারাও সিকুয়্যালের রাস্তা খোলা রাখছে। দেখে অনেকেই মনে করতে পারেন, পশ্চিমী দুনিয়ার কাছ থেকে ভারতীয়রা এই নতুন ঝোঁক শুরু হয়েছে। আদতে তা নয়। ফ্র্যাঞ্চাইজের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে ভারতীয় সিনেমার। প্রথম যে ভারতীয় ছবির সিকুয়্যাল হয়, তার নাম 'হান্টারওয়ালি' (১৯৩৫)। সেই ছবিতে নায়িকার চরিত্রে ছিলেন নাদিয়া। প্রায় এক দশক পরে বেরোয় সেই ছবির সিকুয়্যাল। নাদিয়ার জনপ্রিয়তার পালে হাওয়া লাগে আরও একবার। অক্ষয় কুমারের বহু দশক আগে, নিজের সমস্ত স্টান্ট নিজেই করতেন অভিনেত্রী নাদিয়া।
তিনের দশকে, পরিচালক হোমি ওয়াদিয়া একগুচ্ছ ছবি করেন। এর বেশিরভাগই ছিল স্টান্ট নির্ভর। সে'সময় স্টান্টের জন্য আলাদা লোক ছিল না। নিজের অ্যাকশন সিকোয়েন্স নিজেই করতেন নায়ক-নায়িকারা। সিংহের সঙ্গে একই খাঁচায় কসরত দেখিয়ে 'দুঃসাহসী' উপাধি পেয়েছিলেন নাদিয়া। ওয়াদিয়া কৃত ছবির বেশিরভাগেই নাদিয়াকে দেখা যেত।
১৯৬১ সালে বিবাহ করেন 'দুঃসাহসী' নাদিয়া ও হোমি ওয়াদিয়া
১৯৮০ সালে গিরীশ কন্নাড়কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে হোমি ওয়াদিয়া বলেছিলেন, স্টান্ট ছবির স্বর্ণযুগ ছিল ১৯৩৫ থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত সময়কাল। এ'সময় পৌরাণিক ছবি বা ঐতিহাসিক ছবি ভালো লোক টানত। অ্যাকশন ছবিতে অস্ট্রেলিয়ান নায়িকাকে দেখে দর্শকেরা অভিভূত হতেন। নাদিয়ার পারিবারিক নাম 'মেরি'। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর পরিবার ভারতে চলে আসে। উদ্বাস্তু পরিবারের মেয়েটি তিনের দশকেই ছবির জগতে বেশ জনপ্রিয় অভিনেত্রী হয়ে উঠেছিলেন। এমন কোনও কসরত ছিল না, যা নাদিয়া পারতেন না। তাঁর ইংরেজি টানের হিন্দি দর্শকরা খুবই পছন্দ করতেন। যোদ্ধা বেশে তাঁর অভিনয় দর্শকদের উত্তেজিত করে তুলত। সে'সময়ের হিন্দি ছবিতে নাদিয়া একটা স্বতন্ত্র জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন। তৎকালীন হিন্দি ছবির নায়িকারা কোমলস্বভাব, স্নিগ্ধ-শান্ত রূপ ফুটিয়ে তোলার জন্য জনপ্রিয় হতেন। নাদিয়ার জনপ্রিয়তা ছিল ঠিক তার বিপরীত বিন্দুতে।
চারের দশকে অ্যাকশন ফিল্মের বাজার পড়ে গেল। নাদিয়া তখন বিকল্প সন্ধানে ব্যস্ত। এমন সময় ওয়াদিয়ার মাথায় আসে সিকুয়্যালের ভাবনা। 'হান্টারওয়ালি'র একটা সিকুয়্যাল করলে কেমন হয়? তৈরি হল 'হান্টারওয়ালি কি বেটি'। ১৯৪২-এর এই ছবি নাদিয়া এবং হোমি ওয়াদিয়ার জীবনের মাইলস্টোন হয়ে উঠল। ছবিতে আগের অভিনেতারাই রইলেন। এর আগে ওয়াদিয়ার ব্যবসা খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না। তাঁর ভাই জেবিএইচ ওয়াদিয়ার সঙ্গে অংশীদারীত্বও একরকম চুকে গিয়েছিল। দু'ভাই অনেক যত্নে গড়ে তুলেছিলেন 'ওয়াদিয়া মুভিস্টোন স্টুডিও'। সেই স্টুডিও বহু জিনিসপত্র ভি শান্তারামকে মাত্র দু লাখ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁরা। একরকম ভেবেই নিয়েছিলেন আর ছবি করা হয়ে উঠবে না তাঁদের।
আরও পড়ুন : দেশের প্রথম মহিলা সিনেমাওয়ালা, স্পর্ধার নাম ফতমা বেগম
বিকল্প পথের সন্ধান করছিলেন হোমি ওয়াদিয়া ও নাদিয়া─উভয়েই। নাদিয়া হেয়ার ড্রেসিং-এর প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেছিলেন। এই সময় ওয়াদিয়ার মাথায় সিকুয়্যালের চিন্তাটা আসে। 'হান্টারওয়ালি' তাঁদের প্রথম জনপ্রিয় ছবি। এবং হোমি যা ভেবেছিলেন, তাই হল। 'হান্টারওয়ালি কি বেটি'ও প্রচণ্ড জনপ্রিয় হল। ভাগ্য ফিরল হোমি-নাদিয়া জুটির। এরপরে আরও খান দশেক সফল ছবিতে অভিনয় করেছিলেন নাদিয়া। পরের দশকে ছবির জগৎ অনেকখানিই বদলে গেল। নতুন নতুন স্টুডিওরা নতুন জনপ্রিয় ছবির দায়িত্ব নিল। ওয়াদিয়ারা ঠিকই বুঝেছিলেন। তাঁদের সময় যে'সব বৈশিষ্ট্যের জন্য ছবি দেখতে মানুষের ঢল নামত, যা ছিল তাঁদের ছবির স্বতন্ত্রতা, নতুন সময়ে সেই বৈশিষ্ট্যগুলিকেই আর পছন্দ করছিলেন না দর্শক। ফলে তাঁরা ছবিনির্মাণের থেকে সরে গেলেন ধীরে ধীরে। ভারতীয় সিনেমায় এমন বহু জিনিস তাঁরা নিয়ে এসেছিলেন, যা এর আগে ছিল না। তাঁরাই প্রথম ভারতের প্রথম সিকুয়্যাল উপহার দেন দর্শকদের।