বইমেলার বিক্রিই বলে দেয় এখনও কতখানি বই পড়েন বাঙালি পাঠক
Preparation of Dey's Publication: যাঁরা বই ভালোবাসেন, তাঁরাই বইমেলায় আসেন, বই সংগ্রহ করেন। আমরা যতই বলি না কেন লোকে আর বই পড়ছে না, প্রত্যেকবার বইমেলা সেটা ভুল প্রমাণ করে দেয়।
বইমেলা আসন্ন প্রায়। বাঙালির প্রাণের এই বই-উৎসব নিয়ে সারা বছর পাঠকদের মনে গুঞ্জন। নতুন বইয়ের অপেক্ষা। অপেক্ষায় থাকেন লেখকরাও। তবে আজ, আমাদের বিষয়টা একটু অন্য। বইমেলার নেপথ্যে যাঁদের প্রস্তুতি সবার থেকে বেশি, তাঁরা বাংলা প্রকাশক। তাঁদের দৃষ্টিকোণ থেকে এবারে সেই প্রস্তুতির খানিকটা জেনে নেওয়ার পালা। ইনস্ক্রিপ্টের 'রবিবারের রোয়াকে' দে'জ-এর কর্ণধার শুভঙ্কর দে'র (অপু) সঙ্গে আলাপচারিতায় অভিরূপ মুখোপাধ্যায়।
প্রত্যেকবারের মতো এ'বারও, ২০২৪-এর বইমেলায়, দে'জ পাবলিশিং-এর কাছ থেকে আমরা অনেক অনেক নতুন বই পেতে চলেছি। সে'রকম অনেক নতুন বইয়ের মধ্যে আপনার মতে ইন্টারেস্টিং প্রজেক্ট কোনগুলো?
একজন প্রকাশক যখন বই বের করে, তখন তার কাছে সব বইগুলোই একইরকম গুরুত্বের, সন্তানের মতন। আর সব সন্তানই তার কাছে একইরকম স্নেহের এবং ভালোবাসার। আমি একটাকে খুব প্রিয় বলব, আরেকটাকে বলব না, এ'টা হতে পারে না। তবে হ্যাঁ, বলা যায়, তার মধ্যে কিছু বই অবশ্যই একটা ভালো লাগার জায়গা থেকে করা। এ'রকম বেশ কয়েকটা বই এ'বারে তৈরি হচ্ছে। যেমন, এ'বার 'সত্যজিতের রবীন্দ্রনাথ' নামে একটা বই হচ্ছে। সম্পাদনা করেছেন, সুগত বসু আর ঋদ্ধি গোস্বামী। সত্যজিৎ রবীন্দ্রনাথের যে'সব গল্প এবং উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র করেছেন, সেই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য গুলো থাকছে এ-বইয়ে। অর্থাৎ, 'তিন কন্যা'র তিনটে গল্প, 'চারুলতা' এবং 'ঘরে বাইরে'─এই চিত্রনাট্যগুলো থাকছে। তা ছাড়া তাঁর সাক্ষাৎকারের রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত অংশগুলিও আমরা এই বইয়ে রেখেছি। একসঙ্গে সত্যজিতের রবীন্দ্র-ভাবনা এবং রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তিনি কী কী কাজ করেছেন─দু'টোই থাকছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময় তিনি যে বিজ্ঞাপনগুলো করেছেন, সিনেমা মুক্তি পাওয়ার আগে একরকম, সিনেমা বেরোনোর সময় একরকম, আবার সিনেমার রজতজয়ন্তীতে আরেকরকম─সে'সব তাঁর স্ক্র্যাপবুকে ছিল। সেই পোস্টারগুলোও বইটিতে থাকছে। আমরা চিত্রনাট্য পড়ি, কিন্তু কী হয়, গল্পের সঙ্গে সবসময় সে'ভাবে মিলিয়ে দেখতে পারি না। যেহেতু হাতের কাছে গল্পটা থাকে না সবসময়, তাই চিত্রনাট্যর সঙ্গে আমরা মূল গল্পগুলোও রাখছি। শুরুতে থাকছে রবীন্দ্রনাথের গল্প, তারপরে সত্যজিৎ সে'টাকে যেভাবে চিত্রনাট্যের রূপ দিচ্ছেন, শেষে থাকছে সত্যজিৎ সেই সম্পর্কে যা বলছেন। তাঁর মন্তব্যগুলো। এভাবে বইটা সাজানো হচ্ছে।
বইটিতে সিনেমাগুলির স্টিল ছবিও কি থাকছে?
হ্যাঁ, প্রচুর স্টিল ছবি থাকছে। এবং তিনি রবীন্দ্রনাথের যা যা স্কেচ করেছেন, সেই ছবিগুলোও আমরা ব্যবহার করেছি সমস্ত বইতে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যাকে আমরা পুস্তানি বলি, একটা বই খোলা হলে যে প্রথম পাতাটা আসে, যেটা বইয়ের মধ্যে গণ্য হয় না, কিন্তু থাকে, সে'খানেও আমরা ওঁর স্কেচ ব্যবহার করেছি। বইয়ের দু'দিকে দু'টো পুস্তানি থাকে। শুরুতে একটা, শেষে একটা। একটা পুস্তানিতে রয়েছে তাঁর প্রকাশিত আঁকা। আরেকটায় রয়েছে তাঁর অপ্রকাশিত স্কেচ।
সত্যজিৎ-প্রসঙ্গে আমাদের কথা শুরু হলো বলেই বলছি, আপনাদের আরেকটি বই এই বইমেলাতেি আসছে, 'পূর্ণেন্দু পত্রীর সত্যজিৎ'। এই বইটা সম্পর্কে কিছু বলুন।
এই বইটা সম্পাদনা করছেন অয়ন দত্ত। তরুণ যুবক। ও পূর্ণেন্দু পত্রী নিয়ে অনেকগুলো কাজই করেছে। আমাদের 'কলকাতা সমগ্র' যে'টা হচ্ছে তার প্রথম খণ্ডটাও ও সম্পাদনা করেছে। দ্বিতীয় খণ্ডের কাজ চলছে। এর মাঝে ও যেটা করেছে, সত্যজিৎ-কে নিয়ে পূর্ণেন্দু পত্রীর সমস্ত লেখাপত্তর জোগাড় করেছে। এর বেশিরভাগ লেখাই আমরা কেউ এর আগে দেখিনি। প্রকাশিত হয়তো হয়েছে, কিন্তু খুব সহজলভ্য ছিল না। অলঙ্করণগুলোও ও জোগাড় করেছে। শুধু সত্যজিতের সিনেমা নিয়ে নয়, এই বইতে সত্যজিতের লেখা নিয়ে বা ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও পূর্ণেন্দু পত্রীর আলোচনা থাকছে। সত্যজিতের সিনেমা নিয়ে যেমন পূর্ণেন্দু পত্রীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা রয়েছে, আবার যেটা ভালো লাগছে না, তা স্পষ্ট বলেওছেন লেখক। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণে সত্যজিত-কে দেখছেন। এ'রকম প্রচুর বাংলা এবং ইংরেজি লেখা অয়ন যোগাড় করেছে। সব মিলে এই সংকলনের পৃষ্ঠাসংখ্যা প্রায় ৩২০-র ওপরে। বেশ বড় বই। বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং ছবি আমরা রেখেছি। সে'খানে পূর্ণেন্দু পত্রীও রয়েছেন, আবার সত্যিজিৎ রায়ও আছেন। পুস্তানিতে যে ছবিটা আমরা ব্যবহার করেছি, সে'টায়, সত্যজিতের পিছনে পূর্ণেন্দু পত্রী দাঁড়িয়ে। দু'জনে মিলে কোন একটা কাজ করছেন বা কিছু একটা বুঝাচ্ছেন একে অপরকে।
আমি আবারও রায়-পরিবারের কাছে ফিরে যাব। এ'বছর 'আবোলতাবোল'-এর শতবর্ষ চলছে। আর দে'জ থেকে বেরোচ্ছে শতবর্ষ সংস্করণ। এ'টা কেন ভাবলেন? কী থেকে এই ভাবনাটা এলো?
আমরা সম্পূর্ণ 'আবোলতাবোল' যে'টা পাই, সিগনেটের সংস্করণ, সেই বইটাতে অনেক কিছু পাল্টে দেওয়া হয়েছিল। যেমন প্রথমেই প্রচ্ছদ বদলে গিয়েছিল। মাঝখানে সুবর্ণরেখা পুরনো সংস্করণটা বের করেছিল, সে'টাও আর পাওয়া যায় না। শতবর্ষ সংস্করণে আমরা 'আবোলতাবোল' সম্পর্কে অনেকের লেখা রেখেছি। সুকুমার রায় সম্পর্কে অনেকের লেখা রেখেছি। এর মধ্যে লীলা মজুমদারের লেখা আছে, সুকুমার রায় সম্পর্কে সুখলতার রাও-এর লেখা আছে, প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা আছে। সেই লেখাগুলো বইয়ের একটা অংশ জুড়ে থাকছে। আর 'আবোলতাবোল' প্রকাশিত হয় সুকুমার রায়ের মৃত্যুর পরে। সুকুমারের বইটা নিয়ে নিজস্ব কিছু চিন্তাভাবনা ছিল। সেই অনুযায়ী বইটাকে সাজানোর চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন, বইটা খোলা যাবে একটা পাশ থেকে। মানে সাধারণত যে উপর নিচে লম্বাটে বই আমরা দেখি তেমনটা নয়।
আমি একটু ভিন্ন দিকে যাই। এ'বছর অনিমা ব্রহ্মের একটা বই আপনারা বার করছেন। ওঁকে আমরা লেখিকা হিসেবে নয়, অন্য পরিচয়ে জানতাম, কিন্তু সেই পরিচয়টাও আমরা অনেকে ভুলে গিয়েছি। আপনি যদি এ'বিষয়ে একটু বলেন।
এ'টা অনিমা ব্রহ্মের প্রথম বই। একসময়ের নামকরা ক্রীড়াবিদ। দৌড়ে জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছেন। তাঁর একটা সংগ্রামী জীবন আছে। খেলাধুলোর জগতের কিছু আভ্যন্তরীণ রাজনীতি থাকে। এইরকম রাজনীতির শিকার হয়েছিলেন অনিমা ব্রহ্ম। যার জন্য তার দৌড় থেমে যায়। তিনি তাঁর পুরো জীবনটাই এই বইটার মধ্যে তুলে ধরেছেন। এটা আত্মজীবনী। নাম, 'বাঘের বাচ্চা তুই'। এটা ওঁকে বলতেন, ওঁর কোচ। এই বলে, অনুপ্রাণিত করতেন। সে'টাকেই এই বইয়ের নাম হিসেবে বেছে নিয়েছেন অনিমা। লেখিকা এর আগে কোনও বই লেখেননি। এ'টাও অনুলিখন। তবে ওঁর বয়ানেই লেখা। যা যা ওঁর জীবনে ঘটেছে, দেখেছেন, সবটাই লিখেছেন আর কি!
একটি বই, 'কথায় কথায়'। সম্পাদনা করেছেন উৎপল কুমার বসু।
এই বইটা পুরনো বই। অনেকদিন আগে প্রকাশিত হয়েছিল। বিভিন্নজনের সাক্ষাৎকার, তার একটা সংকলন। এখানে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যেমন রয়েছেন, শঙ্খ ঘোষও রয়েছেন। এই সাক্ষাৎকারের সংকলনটা প্রথম সৃষ্টি প্রকাশন থেকে বেরিয়েছিল। সেই প্রকাশনাটা উঠে গিয়েছে। বইটি দীর্ঘদিন পাওয়া যায় না। কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বই। উৎপল কুমার বসু এই সাক্ষাৎকার গুলো সম্পাদনা করেছিলেন। কিছু কিছু জায়গায় সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটা নেননি। মানে, একটা অংশ মাত্র নিয়েছিলেন। তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিভিন্নজনের নেওয়া সাক্ষাৎকার সম্পাদনা করে বইটা তৈরি করেছিলেন।
এ'বছর গৌতম ঘোষের চিত্রনাট্যও বেরোচ্ছে দে'জ থেকে।
আমরা অনেকগুলো চিত্রনাট্য এর আগে করেছি। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত'র করেছি, ঋত্বিক ঘটক'এর করেছি। 'ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট' বিখ্যাত সিনেমা, কিন্তু আমরা জানি না তার চিত্রনাট্যটা কে লিখেছিলেন বা কার গল্প! গল্পটা হচ্ছে গীতিকার প্রণব রায়ের। তাঁর সেই চিত্রনাট্যটাও আমরা বের করেছি। এবং একই সঙ্গে সেই গল্পটাও রেখেছি। এ'রকম অনেকেরই চিত্রনাট্য আমরা করেছি। গৌতমদার সঙ্গে আমাদের এই চিত্রনাট্য নিয়ে কোভিডের আগে থেকে কথাবার্তা চলছিল। অনেকদিন ধরেই কথাবার্তা চলছে, কিন্তু প্রত্যেক বছরই আমাদের বইমেলাটা পেরিয়ে যায়, কাজটা আর হয়ে ওঠে না। এবারে অবশেষে কাজটা হয়েছে। আশা করছি, বইমেলায় বের করে ফেলতে পারব।
বইটির ক্ষেত্রে, তিনি নিজেই কি সম্পাদনার কাজ করেছেন?
"নিজেই সাজিয়েছেন" বলতে গৌতমদা যেভাবে ছবি করেছেন, ক্রোনোলজিক্যালি যেভাবে চিত্রনাট্য লিখেছেন, সে'ভাবেই আমরা এই প্রথম খণ্ড থেকে সাজিয়েছি। মজার ব্যাপার হলো, যখন এই চিত্রনাট্যের পরিকল্পনা হয়, তখন আমি গৌতমদাকে বলেছিলাম, এ'তে আর একটা জিনিস আমরা সংযোজন করব। আপনি যে অমুক ছবিটা করতে গেলেন, কেন করতে গেলেন? কী ভাবনা কাজ করছিল? প্রত্যেকটা চিত্রনাট্যের আগে আপনার সেই ভাবনাটা আমরা রাখবো। প্রত্যেকটা চিত্রনাট্যের ক্ষেত্রে তিনি নিজস্ব ভাবনার জায়গাটা লিখে দিয়েছেন। প্রত্যেকটাই প্রায় দু'পাতা আড়াই পাতা করে। ওটাকেই এই বইটার ভূমিকা বলা যায়। প্রত্যেকটা চিত্রনাট্যের একটা করে ভূমিকা রয়েছে। বিষয়টা খুব ইন্টারেস্টিং। এবং সে'সময়ের প্রচুর ছবি, বুকলেট এ'সব তো রয়েইছে। যেমন, সত্যজিতের ক্ষেত্রে 'তিন কন্যা’, 'চারুলতা' এবং 'ঘরে বাইরে'─এই তিনটে বুকলেট আমরা বইয়ের সঙ্গে প্রথম ১০০ জন পাঠককে উপহার দিচ্ছি।
আরও পড়ুন: এখনও কাজ কিঞ্চিৎ বাকি
আচ্ছা, এবার কৌশিক সেনের একটি বই বেরোচ্ছে, 'সময়ের সাজঘরে'। এই বইটা সম্পর্কে একটু বলুন।
এ'টা মূলত গদ্যের বই। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তিনি যে লেখালেখি করেছিলেন, যা যা প্রকাশিত হয়েছিল, তারই একটা সংকলন।
'সময়' কথাটা কি এখানে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ? যেহেতু ওঁর লেখালেখি জুড়ে 'সময়'-এর একটা বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
অবশ্যই। অবশ্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ। থিয়েটার নিয়েও তাঁর যে লেখালেখি, সে'গুলো একটা সময়কে রিপ্রেজেন্ট করে। এর মধ্যেও সেই বিষয়টা রয়েছে। বইটিতে, কতগুলো বিষয় আমরা ভাগ করে রেখেছি। প্রথমে থিয়েটার নিয়ে কৌশিক সেনের নিজস্ব চিন্তাভাবনা। দ্বিতীয় অংশে রয়েছে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ওঁর কাটানো সময়পর্ব। সৌমিত্রকে নিয়ে ওঁর অনেকগুলো লেখা রয়েছে। তাই সে'গুলোর জন্য একটা আলাদা সেকশন আমরা রেখেছি। তারপরের বিভাগটা রাজনীতি এবং থিয়েটার সম্বন্ধিত লেখাগুলোকে নিয়ে। রাজনৈতিক যে দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি থিয়েটারকে দেখছেন বা তাঁর যে'সব লেখার মধ্যে অনেকটা রাজনীতি-থিয়েটার এসব মিশে যাচ্ছে, সে'গুলোকে একটা আলাদা ভাগ করা হচ্ছে।
দে'জ-এর 'কবিতাসংগ্রহ' এবং 'শ্রেষ্ঠ কবিতা' সবসময় একটা আলাদা আকর্ষণের দাবি রাখে। এ'বছর এমন একজনের কবিতাসংগ্রহ আমরা দেখতে পাব, যাঁর পরিচয় আমাদের কাছে তেমনভাবে কবি হিসেবে আসেনি। তিনি সলিল চৌধুরী। বিষয়টা বেশ আশ্চর্য লাগছে। এইটা কীভাবে হলো?
সলিল চৌধুরীর কবিতা এর আগে বেরিয়ে ছিল। 'কবিতাসংগ্রহ' বেরোয়নি। কবিতার ছোট বই বেরিয়েছিল। পরবর্তীকালে ওই বইটাকে রেখেই তিনি কিছু কবিতা বাদ দিয়ে নতুন একটা বই করলেন। সে'টার নাম 'এক গুচ্ছ চাবি'। এ'টা পাঠকের কাছে খুবই পরিচিত। আর আমরা করলাম 'কবিতাসমগ্র'। প্রথম যে বইটা বেরিয়েছিল, সেই বইটা আমরা পাই। 'একগুচ্ছ চাবি'র কবিতাগুলো পাই এবং বেশ কিছু পাণ্ডুলিপি পাই। যেখানে ওঁর অনেকগুলো প্রকাশিত কবিতা ছিল। কিছু কবিতা প্রকাশিত। আবার কিছু কবিতা তিনি পাল্টেছেন। প্রথমে যে কবিতার বইটা বেরিয়েছিল, সেই কবিতা থেকে যখন কবিতাগুলি তিনি 'এক গুচ্ছ চাবি'তে আনছেন তখন কবিতার নাম পাল্টে দিচ্ছেন। কবিতার ভিতরে শব্দ পাল্টে দিচ্ছেন। কবিতার লাইন পাল্টে দিচ্ছেন। অনেকগুলো কবিতা তিনি এরকম করেছেন। আমরা যা পেয়েছি তার প্রায় সবটাই আমরা নিয়েছি। কী পাল্টেছিলেন, পাল্টে কী করেছিলেন─সে'গুলো সবই আমরা উল্লেখ করে রাখছি। কবিতার বিবর্তন হয়েছে কীভাবে─সে'টা ধরে রাখার চেষ্টা আর কি! আমরা বেশ কিছু পাণ্ডুলিপির ছবিও দিচ্ছি এ'র মধ্যে। কাটাকুটিগুলোও থাকছে। এ'রকম ভাবেই ওই কবিতার সংকলনটা তৈরি করার পরিকল্পনা করেছি আমরা। বইটি সম্পাদনা করছেন, প্রিয়দর্শী চক্রবর্তী।
আমি যা তালিকা দেখছি, তাতে প্রত্যেকবারের মতোই এবারেও প্রচুর বই বেরোচ্ছে দে'জ থেকে, কিন্তু আমরা এবার বইয়ের বিষয় থেকে একটু অন্যত্র যাব। এই সময় তো অন্যান্য প্রকাশনারও বই বেরোয়। বইমেলার সময় প্রচুর চাপ থাকে। যাঁরা বই বাঁধাই করেন, তাঁদের উপরও কাজের প্রচুর চাপ। এ'টা আপনারা কীভাবে সামলান? মানে, আপনাদের কি নিজস্ব বাঁধাই শিল্পী আছেন? নাকি বইপাড়ায় যাঁরা বাঁধাই করেন, তাঁদেরকে দিয়েই কাজ হয়?
না, আমাদের নিজস্ব বাঁধাই শিল্পী নেই। শুরু থেকেই আমাদের বই বাঁধাই করতেন, সে'রকম কয়েকজন কারিগরের কাছেই আমাদের বই বাঁধাই হয়।
আরও পড়ুন: যে বই প্রকাশনার অলঙ্কার, বাজারে তারই কাটতি বেশি
তাঁরা কি বংশপরম্পরায় এই কাজ করছেন?
হ্যাঁ, বলা যায় একরকম বংশপরম্পরাতেই কাজ করছেন তাঁরা। তবে, চাপ তো পড়ে অবশ্যই। আর, বইমেলাটা এগিয়ে আসার জন্য যেটা বেশি সমস্যা হয়েছে, যে স্কুল সিজন এবং বইমেলা সিজন─দু'টো একসঙ্গে পড়ে গেছে। এ'টা একটা বিরাট চাপ। বাঁধাই শিল্পীরাও পেরে উঠছেন না। রোজ দু'পক্ষের টানা-হ্যাঁচড়ায় তাঁরা ক্লান্ত। তখন ঝগড়া করতে হয়─ স্কুলবই তো সিজনে, তারপরে তো সেই আমার কাছেই আসতে হবে! তখন দেখব তুমি কী করো!─ এইসব মান-অভিমানের পালা।
বেশ মধুর দাম্পত্যের মতো ব্যাপার! আমার যেটা শেষ প্রশ্ন। বইমেলায় অন্যান্য প্রকাশনারও বই বেরোচ্ছে। বিশেষ কী বই, কোন লেখকের বই বেরোচ্ছে─এ'টা তো জানা একটি প্রকাশনার দায়িত্ব! দে'জ-এর পক্ষ থেকে সেই কাজটি কে করে?
শোনো, বাংলা বই যাঁরা প্রকাশ করেন, তাঁদের প্রায় ৯০%-এরই বই দে'জের ঘরে থাকে।
সেটা তো বইমেলার পরে, নাকি?
বইমেলার সময়ও। 'এইটা আজকে বেরিয়েছে।' বলে দু'কপি রেখে গেল─এ হামেশাই হচ্ছে। অন্য প্রকাশকরাই খবর দেন দে'জকে। সত্যিই খুব ভালো কাজ হচ্ছে। নতুন যাঁরা এসেছেন, তাঁদের কয়েকজন তো খুবই ভালো কাজ করছেন। এবং তাঁদের বৈচিত্র্য আছে। নতুন ধরনের ভাবনা আছে। এক্সপেরিমেন্ট করছেন। বইকে নিয়ে যত্নের ছাপ রয়েছে। যাঁরা নতুন আসছেন, তাঁদের বেশ কিছু বইপত্র আমি পার্সোনালি কিনি বইমেলা থেকে। আমার ভালো লাগে। আমি পড়তে চাই। বইমেলার শেষ দু'দিন হলো আমার বই কেনার দিন। সে'টা পুরনো বই হোক, নতুন বই হোক বা পত্রিকা হোক।
এরকম একটা ধারণা আছে যে, বইমেলায় বই দেখো। তারপর কলেজস্ট্রিটে এসে বইটা নিও। কারণ কলেজস্ট্রিটে ডিসকাউন্ট বেশি।
না, আমাকে দেখলে মোটামুটি সবাই চিনতে পারে যে দে'জ থেকে এসেছে, তখন ডিসকাউন্ট করে দেয় আর কি! (হাসি) ওই চেনা বামুনের পৈতে লাগে না─সেই ব্যাপার।
এবারের বইমেলায় পাঠকদের আপনি কী বলবেন?
পাঠকদের একটাই কথা বলার, সে'টা হচ্ছে, যাঁরা বই ভালোবাসেন, তাঁরাই বইমেলায় আসেন, বই সংগ্রহ করেন। আমরা যতই বলি না কেন লোকে আর বই পড়ছে না, প্রত্যেকবার বইমেলা সেটা ভুল প্রমাণ করে দেয়। বই কীভাবে বিক্রি হচ্ছে! এবং বিক্রি যখন হচ্ছে তখন নিশ্চয়ই তাঁরা পড়ছেন। শখে বই কিনে নিয়ে গিয়ে ঘর সাজান─এ'রকম হয়তো দু'একজন থাকতে পারে। সাধারণত মানুষ পড়ার জন্যই বই কেনে। দিনশেষে বই বিক্রির অংকটাই সে'কথা বলে দেয়। একটা কথা আমার মনে হয় যে, আমরা তো একটা সময় বই উপহার দিতাম। জন্মদিনে, বিয়েতে, পৈতের অনুষ্ঠানে! সে'টা প্রায় একেবারেই মুছে গিয়েছিল। ইদানিং, আবার বই উপহার দেওয়ার চলটা এ'সব অনুষ্ঠানগুলোতে একটু একটু করে হলেও ফিরে আসছে। এ'টা আমরা নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে যদি করি। তাহলে আমার মনে হয়, প্রকাশক লাভবান হবেন, লেখকও লাভবান হবেন, পাঠকও লাভবান হবেন। সে'টা নির্ভর করছে, যাঁকে উপহার দিচ্ছি, তাঁর বই ভালো লাগে কিনা─তার উপর। তাহলে যিনি উপহার পাচ্ছেন, তিনিও লাভবান হবেন।
অনেক অনেক ধন্যবাদ অপুদা।