চাঁদ এখন শ্মশান! কেন চাঁদের মাটিতে মানবভস্ম, ডিএনএ পাঠানোর এমন ধূম জানেন?

Space Funeral: যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে মাঝআকাশেই ফেটে যায় পেরেগ্রিন ল্যান্ডার। যার ফলে সমস্ত ডিএনএ ও দেহাশ্ম ছড়িয়ে পড়ল মহাকাশেই। আর চাঁদে পৌঁছনো হল না তাদের।

চাঁদের মাটিতে নীল আর্মস্ট্রংরা আদৌ গিয়েছিলেন কিনা, তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। ফের চাঁদে মানুষ পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে নাসা। তার জন্য ইতিমধ্যেই প্রাথমিক পর্যায়ের পরীক্ষা সেরে ফেলেছে ওই মার্কিন গবেষণা সংস্থা। তবে জীবিত অবস্থায় মানুষ চাঁদে যেতে পারুক বা নাই পারুক, পৌঁছে যাবে ছাই। তেমন উদ্দেশ্য নিয়েই নামিদামী মানুষের দেহাশ্ম নিয়ে মহাকাশে উড়ে গিয়েছিল মার্কিন একটি ল্যান্ডার। তারপর?

ব্যাপারটা কল্পবিজ্ঞানের গল্পের মতো ঠাহর হলেও, এ কথা কিন্তু একশো শতাংশ সত্যি। পেরেগ্রিন ল্যান্ডার নামে একটি মার্কিন সংস্থা সেই গুরুভার মাথায় তুলে নিয়েছিল। কিছুদিন আগেই প্রখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক আর্থার সি. ক্লার্ক-সহ আরও বিখ্যাত বেশ কয়েক জনের দেহাংশ নিয়ে রওনা হয়েছিল চাঁদের উদ্দেশে। শুধু দেহাংশই নয়, ওই সংস্থার মাধ্যমে চাইলে নিজেদের স্মৃতিও চাঁদে পাঠাতে পারেন আগ্রহীরা। তবে যা খুশি পাঠালেই তো হল না। চাঁদে ক্যুরিয়ার করতে চাওয়া জিনিসটির দৈর্ঘ্য় নাকি হতে দুই থেকে আড়াই ইঞ্চির মধ্যে। তবে এই সব শর্ত মেনেই এন্তার দেহাশ্ম ও ডিএনএ পাড়ি দিয়েছিস চাঁদের উদ্দেশ্যে।

চাঁদে জমি কেনার ঘটনা তো আর নতুন কিছু নয়। প্রায়শই মানুষ কোটি কোটি টাকা খরচ করে চাঁদের মাটিতে জমি কিনতে উদ্যোগী হন। বলিউড তারকা শাহরুখ খানই তো প্রতি জন্মদিনে এক খণ্ড করে জমি উপহার পান এক ভক্তের কাছে। ফলে চাঁদ মোটামুটি এখন যেন মানুষের আয়ত্বের মধ্যেই। তবে এবার মানুষ সমাধি কিনতে চাইছেন চাঁদের মাটিতে। আস্ত মানুষ সেখানে পৌঁছে যেতে পারলে, মানুষের শেষ চিহ্নটুকু কেন নয়! সেই ভাবনা থেকেই কেউ কেউ নিজেদের শেষটুকু পৌঁছে দিতে চাইছেন ওই চাঁদের মাটিতে।

আরও পড়ুন: বলিউড বাদশার জন্য পেড়ে এনেছেন চাঁদও! কে শাহরুখের এই ‘জাবরা’ ফ্যান?

গত বছরেই চাঁদে পা রেখেছে ভারত। চাঁদ জয়ের নিরিখে ভারত চতুর্থ হলেও চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পা রেখেছে ভারতই প্রথম। আর তার পরেই চাঁদ নিয়ে পড়ে গিয়েছে হুড়োহুড়ি। ৫০ বছর পর ফের চাঁদের মাটিতে ফিরতে চাইছে নাসা। ইতিমধ্যেই তারা সেরে ফেলেছে আর্টেমিস ওয়ান মিশনটি। চাঁদে মানুষ পাঠানোর আগে এ ছিল পরীক্ষামূলক একটি মিশন। চাঁদের চারপাশ প্রদক্ষিই করার জন্য ওরিয়ন ক্যাপসুলটিকে মহাকাশে পাঠিয়েছিল তারা। মহাকাশে প্রায় ২৬ দিন প্রদক্ষিণ করাক পর পৃথিবীতে ফিরে এসেছে সেই ওরিয়ন। তবে মানুষ ছাড়াও চাঁদে মানুষের স্মৃতি পৌঁছে দেওয়ার রাস্তা রয়েছে। পেনসিসলভেনিয়ার সংস্থা অ্যাস্ট্রোবিক, যারা চাঁদে মালপত্তর বহন করে। সেই উদ্দেশেই গত ৪ তারিখ যাত্রা করেছিল অ্যাস্ট্রোবিক। নাসার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে অনেক কিছুই চাঁদে পৌঁছে দিয়ে আসার কথা ছিল অ্যাস্ট্রোবিকের। প্রায় ৬টি দেশ ও সেখানকার বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক দলের তরফে বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতি ছিল তালিকায়। শুধু যন্ত্রপাতিই নয়, ছিল দেহাশ্মও।

তবে পেরেগ্রিন একা নয়। সাবঅরবিটাল ও আর্থ অরবিটাল ফ্লাইটে বিভিন্ন সময়ে এই কাজটি করা হয়েছে। দুটি মাত্র মার্কিন সংস্থা এই পরিষেবা দিত এতদিন। তার মধ্যে একটি সেলেস্টিস ও দ্বিতীয়টি এলিসিয়াম স্পেস। তবে প্রথম বেসরকারি বাণিজ্যিক ভাবে চাঁদে মালপত্তর পৌঁছে দেওয়া সংস্থা কিন্তু পেরেগ্রিনই। 'সেলেস্টিস' ও 'এলিসিয়াম স্পেস'-এর মাধ্যমে চাঁদে জিনিসপত্র পৌঁছনোর ক্ষেত্রে শুধু দৈর্ঘ্যই নয়, আরও বেশ কিছু শর্ত ছিল।

US Private Moon Lander Fails But Carries Out Most Significant Space Funeral With DNA Of ‘Top Personalities’

 

নতুন বছরের শুরুতেই রওনা হয়েছিল অ্যাস্ট্রোবিকের পেরেগ্রিন ল্যান্ডার। কিন্তু সেই যাত্রা সম্পূর্ণ হল না শেষপর্যন্ত। শুরুটা হয়েছিল ঠিকঠাক ভাবেই। তবে পরে প্রপেলান্টে ফুটো ধরা পড়ে। যার দরুণ মাঝআকাশে ফেটে গিয়েছিল ওই মহাকাশযানের ট্যাঙ্কারটি। শেষপর্যন্ত আর চাঁদে পৌঁছনো হয়নি পেরেগ্রিনের। গত বৃহস্পতিবার প্রশান্ত মহাসাগরের উপর ভেঙে পড়ে সেটি। জানা গিয়েছে, প্রায় কুড়িটিরও বেশি পেলোড বহন করছিল পেরেগ্রিন ল্যান্ডারটি। যার মধ্যে নাসা থেকে পাঠানো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরিক্ষার কিছু জিনিস যেমন ছিল, তার সঙ্গে ছিল বেশ কিছু মানব ডিএনএ ও মৃত মানুষের দেহাশ্ম। ডিএনএ নমুনাগুলির ডেটা একটি স্টোরেজ ডিস্কে ভরে চাঁদে পাঠানোর কথা ছিল। সেই ছোট্ট নিকেল ডিস্কে প্রায় ৬০ মিলিয়নেক বেশি ছবি, তথ্য রাখা ছিল। আগামী কয়েক হাজার বছর ধরে চন্দ্রপৃষ্ঠে সুরক্ষিত রাখার কথা ছিল সেটিকে। এর আগেও এমন বেশ কিছু ডিস্ক চাঁদের মাটিতে সুরক্ষিত রাখা হয়েছে। ইজরায়েল নির্মিত বেয়ারশিট ল্যান্ডারটি ২০১৯ সালে ধ্বংস হয়ে যায়। এগুলিকে লুনার লাইব্রেরি বলা হয়।

তবে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে মাঝআকাশেই ফেটে যায় পেরেগ্রিন ল্যান্ডার। যার ফলে সমস্ত ডিএনএ ও দেহাশ্ম ছড়িয়ে পড়ল মহাকাশেই। আর চাঁদে পৌঁছনো হল না তাদের। বেশ কিছু বিখ্যাত ব্যক্তির দেহাশ্ম ও ডিএনএ ছিল সেই ল্যান্ডারে। ছিল আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন, জন এফ কেনেডি-র মতো ব্যক্তিত্বের ডিএনএ। প্রায় ৬৯ জনের দেহাশ্ম ছিল ওই মহাকাশযানে, যাঁদের প্রত্যেকের গন্তব্য ছিল চাঁদে। ওই ল্যান্ডারটির তিনটি ইঞ্জিনই পুড়ে গিয়েছে দুর্ঘটনায়।

তবে এই পেরেগ্রিন ছিল নাসার বাণিজ্যিক লুনার পেলোড সার্ভিসেস প্রোগ্রামের আওতায় প্রথম মিশন। চাঁদে বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাস্ট্রোবেটিকের মতো বেসরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে জুটি বাঁধছে নাসা। ২০২৫ সালের শেষের দিকেই মানুষ নিয়ে চাঁদের উদ্দেশে রওনা হবে নাসা। ইতিমধ্যেই সেই আর্টেমিস মিশনের পরিকল্পনা সারা। বিজ্ঞানীদের আশা, পরবর্তী শতাব্দীতে চাঁদ মানুষের নিত্যগন্তব্য হয়ে উঠবে।

আরও পড়ুন: মোবাইলের চেয়েও সস্তা চাঁদের জমি! সত্যিই কি চাঁদের মালিক হতে পারেন আপনি?

আর সেই শুরুটা কি তবে শুরু হচ্ছে শ্মশান দিয়েই! যেভাবে বিখ্যাত মানুষদের ডিএনএ ও দেহাশ্ম চাঁদে পাঠানোর ধূম উঠেছে. তাতে তেমনটাই মনে হচ্ছে। বছর কুড়ি আগে লুনার প্রসপেক্টর প্রোব-এ করে চাঁদে ইউজিন শুমাখারের দেহাশ্ম পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। তবে নাভোজা সম্প্রদায়ের মানুষজন তা নিয়ে প্রবল বিরোধিতা করেন। তাঁদের কাছে চাঁদ খুবই পবিত্র জায়গায়। তাকে স্মারকস্থান বা সমাধিক্ষেত্র বানিয়ে তোলা মোটেই যথাযথ কাজ নয় বলেই দাবি তাঁদের। যদিও নাসার দাবি, পেরেগ্রিনের উপর তাদের সরাসরি কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই।

তবে কি বেসরকারিকরণের মুখে এখন চাঁদও। ক্রমেই চাঁদ হয়ে উঠবে পৃথিবীর বর্ধিত শ্মশান? কারণ চাঁদে দেহাংশ বা ডিএনএ পাঠাতে গেলে কিন্তু বিপুল খরচ করতে হতে পারে। কম করে হলেও সেই ব্যায় ১৩ হাজার ডলারের মতো তো হবেই। যদিও আমেরিকার মাটি থেকে বাণিজ্যিক পেলোড লঞ্চ করতে হলে আমেরিকার অনুমোদন প্রয়োজন। তবে তা সুরক্ষা, জাতীয় নিরাপত্তা ও বিদেশনীতির প্রয়োজনে। পেরিগ্রিনই প্রথম বাণিজ্যিক লুনার বারিয়াল সংস্থা। ইন্দোনেশিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মতো বেশ কয়েকটি দেশে মহাকাশ আইন থাকলেও, আমেরিকায় তেমনটা নেই। আর সেই আইনের ফাঁকই চাঁদ বিকিয়ে যাবে না তো? উঠেছে প্রশ্ন। অ্যাপোলো মহাকাশচারীরা অনেকেই চাঁদে আনুষ্ঠানিক স্মৃতিচিহ্ন রেখে এসেছেন। কেউ কেউ রেখে এসেছেন ফলক কিংবা ব্যক্তিত স্মৃতিচিহ্ন। পরবর্তীকালে চাঁদজয়ী মানুষজন কি অসুবিধায় পড়বে না এই দেহাশ্ম চাঁদে পাঠানোর ঘনঘটায়! তবে ভবিষ্য়তে যা-ই হোক না কেন, এই ঘটনা মানুষের সামনে খুলে দিয়েছে 'অমর' হওয়ার নতুন রাস্তা, মৃত্য়ুর পরেও চাঁদের মাটি ছোঁয়ার অভিনব সুযোগ।

 

More Articles