ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক তহবিলে কোটি কোটি টাকা! কত পেল বিজেপি?

Electoral Bonds Scam: ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলির তহবিলে ঢুকেছে। আর তার সিংহভাগ ঢুকেছে বিজেপির তহবিলে।

লোকসভা ভোটের আর বেশি দেরি নেই। খুব শিগগিরই ঘোষণা হতে চলেছে ২০২৪ লোকসভা ভোটের নির্ঘণ্ট। আর ঠিক এ সময়েই ইলেক্টোরাল বন্ডকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। ভোটের ঠিক আগে আগেই ফাঁস হয়ে গেল মোদি সরকারের ইলেক্টোরাল বন্ড দুর্নীতি। তার প্রভাব কতটা পড়বে ভোটবাক্সে? ২০১৮ সালে বিজেপি সরকারের হাত ধরে আত্মপ্রকাশ করেছিল এই ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্প। যেখানে আর্থিক সহায়তাকারীদের নাম-পরিচয় ও কে কতটা আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন, সে সমস্তই গোপন থাকবে বলে দাবি করেছিল বিজেপি সরকার।

ইলেক্টোরাল বন্ড যে বড়সড় দুর্নীতির একটি দরজা, এমন অভিযোগ অনেকেই করেছিলেন। এতদিনে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে সবটাই। জানা গিয়েছে, এই ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্প থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছে বিজেপি সরকারই। ঠিক কত টাকা গিয়েছে বিজেপির তহবিলে? এখনও পর্যন্ত যা দেখা গিয়েছে, ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলির তহবিলে ঢুকেছে। আর তার সিংহভাগ যে বিজেপির ফান্ডে ঢুকেছে, তা নিয়ে তো সংশয় থাকার কথা নয়।

আরও পড়ুন: ইলেক্টোরাল বন্ড: দুর্নীতির বিরুদ্ধে ন্যায়ের বিলম্বিত জয়

হিসেব বলছে, গত আর্থিক বছর পর্যন্ত ১২,০০০ কোটি টাকারও বেশি সমস্ত রাজনৈতিক দলের কাছে গিয়েছে। ২০১৮ সালে ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্পের শুরু হয়। নির্বাচন কমিশন ও অ্য়াসোসিয়েশন ফর ডেমক্র্যাটিক রিফর্মস থেকে প্রাপ্ত তথ্য় অনুযায়ী, তার অন্তত ৫৫ শতাংশ পেয়েছে বিজেপি। হিসেব করলে সেই অঙ্কটা দাঁড়ায় ৬,৫৬৬ কোটি টাকা। এডিআরের তথ্য বলছে, ২০১৮ সালের মার্চ মাস থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত যে পরিসংখ্য়ান মিলেছে সেই অনুসারে সব মিলিয়ে ১৬,৫১৮.১১ কোটি টাকা গিয়েছিল এই ইলেক্টোরাল বন্ড বিক্রির মাধ্য়মে। পরিসংখ্যান বলছে, গত কয়েক বছরে বিজেপির আয় হু হু করে বেড়েছে। আর উল্টোদিকে আয় পড়ছে কংগ্রেসের। তাদের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ইলেকট্রিক বিল পর্যন্ত মেটাতে পারছে না তারা। প্রায় ২১০ কোটি টাকা আয়কর বকেয়া রয়েছে তাদের। আর এদিকে ক্রমশ ফুলেফেঁপে উঠছে বিজেপির কোষাগার। ২০১৮-১৯ সালে বিজেপির আয় একেবারে দ্বিগুণ হয়ে ২৪১০ কোটি হয়ে গিয়েছিল। সেসময় কংগ্রেসের আয় কিছুটা বেড়েছিল অবশ্য। কংগ্রেসের আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৯১৮ কোটি টাকায়, যেখানে আগে সেই অঙ্কটা ছিল ১৯৯ কোটি টাকা।

গত আর্থিক বছর অর্থাৎ ২০২২-২০২৩ সালে বিজেপির মোট আয় দাঁড়ায় ২৩৬০ কোটি টাকায়। তথ্য় বলছে, তার মধ্যে ১৩০০ কোটি টাকা এসেছে এই ইলেক্টোরাল বন্ড থেকে। অর্থাৎ মোট আয়ের অর্ধেকেরও বেশি এসেছে এই প্রকল্পের মাধ্যমেই। সবচেয়ে বেশি অনুদান পেয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। অনুদান হিসেবে মোট ৭২০ কোটি টাকা পেয়েছে বিজেপি। অনুদানে সেই সব দাতাদের নাম রয়েছে যাঁরা ২০ হাজার টাকার বেশি অনুদান দিয়েছেন। ২০২১-২২ অর্থ বর্ষের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে বিজেপি ১৭.১ শতাংশ অনুদান বেশি পেয়েছে। কংগ্রেস ২০২২-২৩ সালে মোট ৭৯.৯ কোটি টাকা অনুদান পায়। ২১-২২ সালের তুলনায় যা ১৬.৩ শতাংশ কম। ২১-২২ সালে কংগ্রেস ৯৫.৪ কোটি টাকা অনুদান পেয়েছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ২০২২-২৩ সালে করা অনুদান সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছিল। নির্বাচন কমিশনকে বিজেপি জানায় তারা অনুদান পেয়েছে ৭১৯.৮ কোটি টাকা। গেরুয়া শিবির ২০২১-২২ সালে ৬১৪.৫ কোটি টাকা অনুদান পেয়েছিল। ডেন্ট ইলেক্টোরাল ট্রাস্ট বিজেপিকে ২৫৪.৭ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছিল (মোট অনুদানের ৩৫ শতাংশ)। এটি ছাড়াও এনগিগার্টি ইলেক্টোরাল ট্রাস্ট দলকে ৮ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে।

Electoral Bonds BJP took home lion's share of Rs 16,000 crore political funding

আগেও রাজনৈতিক দলগুলোর আর্থিক অনুদানের জায়গা ছিল। বড়বড় সংস্থা, শিল্পপতিরা ফান্ড করতেন রাজনৈতিক দলগুলিকে। তবে ২০১৮ সাল থেকে সেই অনুদানের ধারণাটাই বদলে গিয়েছে। আগে ধরাবাঁধা নিয়ম ছিল রাজনৈতিক দলগুলিকে আর্থিক অনুদানের। সেই সীমা উঠিয়ে দিয়েছে বিজেপি সরকার এই প্রকল্পের মাধ্যমে। ফলে যে যত খুশি আর্থিক অনুদান দিতে পারে এই বন্ডের মাধ্যমে। স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার কাছে সরাসরি জমা পড়ে এই টাকা। আগে কোনও বিদেশি বা তার সাবসিডারি সংস্থা তাদের নেট লাভের ৭.৫ শতাংশ পর্যন্ত অনুদান দিতে পারত। সেই নিয়মও উঠে গিয়েছে এই বন্ড প্রকল্পে। ফলে আর্থিক অনুদানের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার বিশেষ জায়গা হয়ে উঠেছে এই ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্প। আর সেই সুযোগটাই বিজেপি নিয়েছে বলে মন রাজনৈতিক অভিজ্ঞদের। কয়েক লক্ষ থেকে শুরু করে এক কোটি টাকার পর্যন্ত বন্ড কিনেছেন অনুদানকারীরা। এদিকে, ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্পের গ্যাঁরাকলও কম নয়। নিয়ম অনুযায়ী, ১৫ দিনের মধ্যে এই অনুদান নিজেদের অ্যাকাউন্টে তুলতে না পারলে তা সোজা চলে যায় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে। আর সেই ত্রাণ তহবিলের হিসেব নিয়ে তো এমনিতেই বিতর্কের শেষ নেই।

সুপ্রিম কোর্টের রায় বেরনোর পরেই এই ইলেক্টোরাল বন্ড নিয়ে মুখ খুলেছেন বিরোধীরা। নরেন্দ্র মোদির দুর্নীতিগ্রস্ত নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন অনেকে। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন, যা মোদী সরকারের এই কালো টাকা রূপান্তর প্রকল্প বাতিল করেছে। তবে সুপ্রিম কোর্টের এই রায় বাতিলেরও পথ খোলা রয়েছে বিজেপি সরকারের হাতে। অতীতেও বহু সরকার সুপ্রিম কোর্টের বহু রায় অর্ডিন্যান্স এনে হয় বাতিল করেছে, নয় অকেজো করেছে। সুপ্রিম কোর্ট ওই প্রকল্পকে বেআইনি ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছে, যাতে কোন রাজনৈতিক দল গত পাঁচ বছরে কোন শিল্প সংস্থার থেকে কত টাকা চাঁদা পেয়েছে, তা মার্চ মাসেই প্রকাশ্যে আনা হয়। র সেটা হলে বিজেপির ভাবমূর্তি ধাক্কা খেতে পারে। সেই সঙ্গে কোন কোন ব্যবসায়ী তাঁদের বিপুল অনুদান দিয়েছে সেটা প্রকাশ্যে আসাটা ওই ব্যবসায়ীদের জন্যও সুখকর হবে না। ফলে অর্ডিনেন্স এনে সুপ্রিম কোর্টের রায় বাতিল করার সম্ভাবনা প্রবল বলেই মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহলের একটি অংশ।

আরও পড়ুন:বিজেপি জমানার ‘ইলেক্টোরাল বন্ড’ দুর্নীতিকে ভোটের ‘হাতিয়ার’ করতে পারবে বিরোধীরা?

বর্ষীয়ান আইনজীবী তথা রাজ্যসভার সাংসদ কপিল সিব্বাল বলছেন, “অর্ডিন্যান্স এনে সুপ্রিম কোর্টের রায় বদলে দেওয়া সম্ভব নয়। মার্চের মধ্যে সব ইলেক্টোরাল বন্ডের তথ্য প্রকাশ্যে আসবে। তবে কেন্দ্র চাইলে এই বন্ড পদ্ধতির বদলে অন্য কোনও অনুদানের পদ্ধতি চালু করতে পারে।” প্রাক্তন অ্যাডিশনাল সলিসিটর জেনারেল বিকাশ সিংও একই কথা বলছেন। তাঁর বক্তব্য, কেন্দ্র চাইলেও অর্ডিন্যান্স এনে বর্তমানে যে ইলেক্টোরাল বন্ড চালু আছে, সেটা ফেরাতে পারবে না। যদিও দু’জনেরই মত লোকসভার আগে কেন্দ্র অর্ডিন্যান্স এনে সুপ্রিম রায় বদলাতে চাইবে না। কারণ, ভোটের আগে সেটা করলে কেন্দ্রের ভাবমূর্তি ধাক্কা খেতে পারে। তবে আদতে এই ভোটের বাজারে ঠিক কোন পথে হাঁটতে চলেছে বিজেপি সরকার, তার আন্দাজ এখনই পাওয়া যাচ্ছে না।

 

More Articles