বরাদ্দ কোটি কোটি টাকা! ভোটের আগে যেভাবে তাক লাগাল মমতার 'কল্পতরু' বাজেট

West Bengal Budget 2024: বৃহস্পতিবার দুপুরে বিধানসভায় রাজ্যবাজেট পেশ করেছে অর্থ দফতরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য।

দরজায় কড়া নাড়ছে লোকসভা ভোট। ভোটের আগে অন্তর্বর্তী বাজেটে তেমন হাত উপুড় করেনি কেন্দ্রীয় সরকার। সরকার গড়েই সম্পূর্ণ বাজেট ঘোষণা করার কথা জানিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। তবে নিজের রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চললেন সম্পূর্ণ উল্টোপথে। ভোটের আগে কার্যত কল্পতরু মমতা।

বৃহস্পতিবার দুপুরে বিধানসভায় রাজ্যবাজেট পেশ করেছে অর্থ দফতরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। আর সেই বাজেট পড়া শুরু হতে না হতেই রাজ্যবাসীর কানের ভিতর দিয়ে মরমে পশিল একের পর এক চমক। একের পর এক প্রকল্পে বরাদ্দ শুনে কার্যত অবাকই করল বঙ্গবাসীকে। বাড়ল ডিএ-ও।

আরও পড়ুন: ফের লক্ষ্মীর ভাণ্ডারেই আস্থা! কেন মমতাকে সবচেয়ে বেশি ভোট দেন মহিলারা?

একের পর এক প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়িয়েছে এবার রাজ্যসরকার। তার মধ্যে রয়েছে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, পড়ুয়া ঋণকার্ডের মতো প্রকল্প। বাড়ানো হয়েচে একাধিক ভাতা। একই সঙ্গে ঘোষণা করা হয়েছে একাধিক নয়া প্রকল্পও। কী কী রইল ২০২৪-২৫ বাজেটে? চলুন দেখে নেওয়া যাক একনজরে।

ডবল লক্ষ্মীর ভাণ্ডার

লোকসভা ভোটের আগে লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পে আর্থিক বরাদ্দ বৃদ্ধি করল রাজ্য সরকার। সংশ্লিষ্ট সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের মাধ্যমে ২ কোটি ১১ লক্ষ মহিলা আর্থিক সহায়তা পাচ্ছেন বলে জানিয়েছে সরকার। রাজ্যের ঘোষণা, লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পে তফসিলি জাতি এবং জনজাতির শ্রেণির জন্য আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধি করে মাসিক ১,২০০ টাকা এবং অন্যদের জন্য এই সহায়তা বৃদ্ধি করে মাসিক ১০০০ টাকা হবে।

একশো দিনের কাজে বকেয়া বরাদ্দ

দীর্ঘদিন ধরেই কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের দরকষাকষি চলছেই। বেশ অনেকদিন ধরেই কেন্দ্রের থেকে একশো দিনের কাজের বরাদ্দ পায়নি বাংলা। সে নিয়ে বহু আবেদন-নিবেদন, চিঠি চালাচালি করেও কাজ হয়নি। এর আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, কেন্দ্র না দিলে একশো দিনের প্রকল্পে বকেয়া বাবদ বরাদ্দ করবে রাজ্য নিজেই। বাজেটে হলও তেমনটা। ১০০ দিনের কাজে শ্রমিকদের বকেয়া বাবদ ৩৭০০ কোটি বরাদ্দ করল রাজ্য সরকার। আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি ২১ লক্ষ মানুষের হাতে ১০০ দিনের কাজের টাকা হিসাবে ওই অর্থ তুলে দেওয়া হবে।

আবাস যোজনায় প্রতিশ্রুতি

একই অবস্থা প্রধানমন্ত্রীর আবাস যোজনা প্রকল্প নিয়েও। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, এপ্রিল পর্যন্ত কেন্দ্রের তরফে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার টাকা না দেওয়া হলে, মে মাসে রাজ্য ১১ লক্ষ বাড়ি তৈরির টাকা দিয়ে দেবে বলেও ঘোষণা করেছে মমতা সরকার।

ফের বাড়ল ডিএ

রাজ্যের সরকারি কর্মীদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, বাড়ানো হচ্ছে না ডিএ। ভোটের আগে সরকারি কর্মীদের মন জিততে তাই ফের মহার্ঘ ভাতা ঘোষণা করল রাজ্য সরকার। ডিসেম্বর মাসেই ৪ শতাংশ ডিএ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জানুয়ারি মাস থেকে কার্যকর হয় তা। তারপর ফের বাজেটে বাড়ানো হল আরও ৪ শতাংশ ডিএ। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীরা বর্তমানে ৪৬ শতাংশ হারে ডিএ পান। বৃহস্পতিবারের ঘোষণার পর রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ডিএ বেড়ে হল ১৪ শতাংশ। অর্থাৎ, এখনও ডিএ-র ক্ষেত্রে কেন্দ্র-রাজ্য ফারাক থাকছে ৩২ শতাংশ।

মৎস্যজীবীদের জন্য নয়া প্রকল্প

উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুরের মৎস্যজীবীদের জন্য বৃহস্পতিবার বাজেটে সমুদ্রসাথী প্রকল্পের ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। সেই প্রকল্পে বর্ষার দু’মাস ভাতা বাবদ মৎসজীবীদের পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। যার জন্য বরাদ্দ করা হবে ২০০ কোটি টাকা। উপকৃত হবেন দু’লক্ষ মৎস্যজীবী।

পথশ্রীতে বাড়ল বরাদ্দ

পথশ্রী প্রকল্পের জন্যও অর্থ বরাদ্দ করল রাজ্য সরকার। ১২ হাজার কিলোমিটার গ্রামীণ রাস্তাকে উন্নত করা হবে। বরাদ্দ করা হচ্ছে ৩,৮৬৮ কোটি টাকা।

পরিযায়ীরাও স্বাস্থ্যসাথীর আওতায়

ভিনরাজ্যে কাজ করতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কম নেই বাংলায়। এবার তাঁদের জন্য স্বাস্থ্যসাথীর সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ নিল রাজ্যসরকার। বৃহস্পতিবারের বাজেটে জানানো হয়েছে, রাজ্যের যে শ্রমিকেরা বাইরে আছেন, সেখানকার হাসপাতালেই তারা স্বাস্থ্যসাথী কার্ড ব্যবহার করতে পারবেন এবার থেকে।

কর্মশ্রী প্রকল্প

এবার বাজেটে নয়া প্রকল্পের ঘোষণা করছে রাজ্য সরকার। একশো দিন নয়, বেকারত্ব ঘোঁচাতে ৫০ দিন করে কাজ দেওয়ার ঘোষণা করল রাজ্য। বোঝাই যাচ্ছে, ১০০ দিনের প্রকল্পের পাল্টা এই প্রকল্পের ঘোষণা করা হল। চলতি বছরের মে মাস থেকে কার্যকর হবে ওই কর্মশ্রী প্রকল্প। রাজ্যের প্রতিটি জব কার্ড হোল্ডার এই প্রকল্পের আওতায় কাজের সুযোগ পাবেন।

Bengal FM presents Rs 3.6 lakh crore budget, says Centre imposed 'financial blockade' on state

সিভিক ভলিন্টিয়ার ভাতা

বাজেটে সিভিক ভলান্টিয়ার, ভিলেজ পুলিশ এবং গ্রিন পুলিশদের ভাতা বাড়ল ১০০০ টাকা। এর জন্য ১৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে বাজেটে। পাশাপাশি এখন থেকে রাজ্য পুলিশের ২০ শতাংশ চাকরি সংরক্ষিত থাকবে সিভিক ভলান্টিয়ারদের জন্য, যা এত দিন ১০ শতাংশ ছিল।

৫ লক্ষ কর্মসংস্থান

ভোটমুখী এই বাজেটে নতুন করে ৫ লক্ষ বেকার যুবক-যুবতীকে রাজ্যের বিভিন্ন দৎতরে নিয়োগ করার কথা ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। একই সঙ্গে রাজ্যে দারিদ্রের হার কমেছে বলেও বাজেট পেশ করার সময় জানিয়েছেন অর্থ-প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা। তাঁর দাবি, তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার কয়েক বছর আগে, ৫৭.৬০ শতাংশ রাজ্যবাসী দারিদ্রসীমার নীচে ছিলেন। তৃণমূল সরকার আসার পর ২ কোটির বেশি মানুষের জীবিকা সংস্থান হয়েছে। ফলে দারিদ্রসীমার নীচের মানুষের সংখ্যা কমে ৮.৬০ শতাংশ হয়েছে বলে দাবি তাঁর।

মাধ্যমিক পাশে স্মার্টফোন

বাজেটে রাজ্যের পড়ুয়াদের জন্য নতুন ঘোষণা তৃণমূল সরকারের। মাধ্যমিক পাশের পরে ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে ভর্তি হলেই স্মার্টফোন পাবে বলে জানালেন রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা। এর জন্য বরাদ্দ করা হচ্ছে ৯০০ কোটি টাকা।

প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ

দেশের তুলনায় বেকারত্বের হার এ রাজ্যে অন্তত ৩ শতাংশ কম বলেই দাবি করা হয়েছে রাজ্যবাজেটে। তার সঙ্গেই বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের জন্য মাসিক দেড়-দু’হাজার টাকা দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করা হল বাজেটে। প্রতি বছর অন্তত ১ লক্ষ যুবক-যুবতী এতে লাভবান হবেন। এর জন্য বরাদ্দ করা হচ্ছে ২০০ কোটি টাকা।

নয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র

নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুতের জন্য রাজ্যে চার-চারটি নতুন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র অর্থাৎ পার ক্রিটিকাল থার্মাল পাওয়ার ইউনিট তৈরির কথা ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। পিপিপি মডেলে বাস্তবায়ন করা হবে। যার জন্য় বরাদ্দ হয়েছে ১০০ কোটি টাকা।

নতুন সেতু

একই সঙ্গে নতুন সেতু তৈরির জন্যও বরাদ্দের কথা ঘোষণা করা হয়েছে ২০২৪ রাজ্যবাজেটে। মুড়িগঙ্গা থেকে কচুবেড়িয়া পর্যন্ত ৩.১ কিলোমিটারের সেতু তৈরি করা হবে। নাম দেওয়া হবে ‘গঙ্গাসাগর সেতু’।

শিল্প সেতু

দামোদরের উপর শিল্পসেতু তৈরি করা হবে। ৬৪০ মিটারের সেতু। যে সেতুর ফলে প্রচুর স্থানীয় মানুষ উপকৃত হবে। তিন বছরের মধ্যে সেতু তৈরি করা হবে। ২৪৬ কোটি আনুমানিক ব্যয়। চার লেনের সেতু তৈরি করা হবে।

নিউটাউনে উড়ালপুল

নিউ টাউন ও বিমানবন্দরের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত করতে ইএম বাইপাসে সাত কিলোমিটারের উড়ালপুল তৈরির ঘোষণা করা হয়েছে রাজ্য সরকারের তরফে। তিন বছরের মধ্যে সেই প্রকল্প শেষ করা হবে বলেও খবর। প্রথম বছরের জন্য বরাদ্দ থাকবে ১৫০ কোটি টাকা।

২৮ কোটি কর্মদিবসের ঘোষণা

দীর্ঘদিন ধরে একশো দিন কাজের প্রকল্পে বাংলাকে বরাদ্দ দেয়নি কেন্দ্র সরকার। হিসেব অনুযায়ী, সেই বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার মতো। যার ফলে শ্রমিকদের বরাদ্দ মেটাতে পারেনি রাজ্যসরকার। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে রাজ্যের মনরেগা শ্রমিকদের জন্য ২৮ কোটি কর্মদিবস তৈরি করা হবে বলেও জানিয়েছেন অর্থ দফতরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী।

পেনশন ও ভাতায় বরাদ্দ বৃদ্ধি

বাজেট পেশের আগেই মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, আরও ১০ লাখ প্রবীণ নাগরিক পেনশন পাবেন। বিধবা ভাতা পাবেন আরও ১.৪ লাখ বিধবা। আরও ১০ লাখ তরুণী পাবেন কন্যাশ্রীর সুযোগ-সুবিধা। ফলে সেই সব খাতেও বেড়েছে বরাদ্দ।

ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা

ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা আরও বাড়ানো হচ্ছে। কোনও কোলাট্যারল ছাড়াই ১০০ শতাংশই ঋণ দেওয়া হবে। নামমাত্র চার শতাংশ সুদ দিতে হবে। বাকি সুদ বহন করবে রাজ্য সরকার।

একাদশে ১০ হাজার

তরুণের স্বপ্ন প্রকল্পের জন্য ১০,০০০ টাকা দেওয়া হয়। দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়ারা ট্যাব কেনার জন্য পান। এবার একাদশ শ্রেণি থেকেই সেই টাকা দেওয়া হবে। সেজন্য অতিরিক্ত ৯০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হচ্ছে।

ভাতাবৃদ্ধি কুক কাম হেল্পারদের

মিড ডে মিলের কুক-কাম-হেল্পারদের মাসিক আর্থিক সাহায্য বাড়ছে ৫০০ টাকা। তার ফলে দু'লাখ কুক-কাম-হেল্পাররা লাভবান হবেন। অতিরিক্ত ১৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন: এক মাসের ব্যবধানে দু’বার ডিএ! ভোট-বাজারে নিশানায় রাজ্য সরকারি কর্মীদের মন?


ভোটের আগে একগুচ্ছ জনমোহিনী প্রকল্প তো ঘোষণা করল রাজ্য সরকার। একাধিক জায়গায় বরাদ্দ করা হল কোটি কোটি টাকা। তবে সেই পরিমাণ অর্থ রয়েছে তো আদৌ রাজ্যের কোষাগারে। সে কথাটা কিন্তু ইতিমধ্যেই ভাবাতে শুরু করেছে বিশেষজ্ঞদের। লোকসভা ভোটে ইন্ডিয়া জোটের অংশ হয়েও রাজ্যে একা লড়ার কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি হিসেবেই কি ঘোষণা করা হল এই জনমোহিনী বাজেট? যা প্রতিশ্রুতি দিলেন মুখ্যমন্ত্রী, তা সত্যিই পূরণ করতে পারবেন তো তিনি? উঠেছে প্রশ্ন।

 

 

More Articles