পাঠকের সামনে ভালো বই তুলে ধরতে চায় প্রতিক্ষণ
Kolkata International Book Fair 2024: প্রতিক্ষণের কর্ণধার শুদ্ধব্রত দেবের সঙ্গে আলাপচারিতায় শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়।
আরও একটা বইমেলা। নতুন বইয়ের গন্ধ, পাঠকের সন্ধানী চোখ। গোটা মাঠ ঘুরে বেছে নেওয়া পছন্দের বইখানা। এর চেয়ে সুসময় আর কী-ই বা হতে পারে। বইমেলা মানেই প্রকাশকের তাড়াহুড়ো, ছাপাখানা, বাঁধাইখানা চরকিপাক, লেখকের উদ্বেগ। তবে এই ভিড়ভাট্টা থেকে যেন একটু দূরে প্রকাশনা দুনিয়ার পুরনো ঘোড়া প্রতিক্ষণ। তবু ব্যস্ততা তো একটা থাকেই। বইমেলা বলে কথা! তার মধ্যে থেকেই সময় বের করে শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আড্ডা দিলেন প্রতিক্ষণের কর্ণধার শুদ্ধব্রত দেব।
বাংলা বইয়ের বৃহত্তম ডিসপ্লে হিসেবে যদি কলকাতা বইমেলাকে দেখা যায় তাহলে বাংলা প্রকাশনায় পাঠকের সম্ভ্রম আদায় করে নেওয়া 'প্রতিক্ষণ'-এর অন্দরে বইমেলা নিয়ে সাধারণত কীরকম প্রস্তুতি চলে?
প্রশ্নের উত্তরের দু'টো পর্ব রয়েছে। আমি যদি ছোট করেও বলি, একটা হচ্ছে এ যাবৎ আর একটা ইদানিং। এযাবৎকাল মূলত বইমেলাকে লক্ষ্য রেখেই, বইমেলাতে তার মোড়ক উন্মোচন হবে, এমনটা ধরে নিয়ে বই বের করা হত। কিন্তু 'প্রতিক্ষণ'-এর চল্লিশ বছরে এসে, পলিসি ডিসিশন যেটাকে বলে, সেটা আমরা বদলেছি। আমরা বইমেলা বলতে এখন বুঝি, সারা পশ্চিমবঙ্গের জেলা বইমেলা এবং সেটা কালমিনেটেড হচ্ছে কলকাতা বইমেলায়। তার ফলে যেটা হয়, আমাদের নভেম্বর মাসের শেষ থেকে বই বেরোনো শুরু হয়, ফলে ডিসেম্বর এবং জানুয়ারির শুরুতে জেলা বইমেলা হয়ে বইগুলো কলকাতা বইমেলায় আসে। খুব বেশি হলে দু'টি বা তিনটি বই হয়তো কলকাতা বইমেলার জন্য অপেক্ষা করে। যেমন এ বছর রোমিলা থাপারের যে দ্বিতীয় বইটি আমরা করছি, 'আমাদের ইতিহাস না ওদের ইতিহাস'- এটা বইমেলাতেই প্রকাশ হচ্ছে। আর সুস্নাত চৌধুরীর 'পুস্তানি পেরিয়ে', যেটা ধারাবাহিক ভাবে 'সংবাদ প্রতিদিনে' প্রকাশ পেয়েছে, মূলত ভাস্কর লেটের আগ্রহেই সেটা 'প্রতিক্ষণ' থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। এই দু'টো ছাড়া বাকি সব বই-ই আমাদের জেলা বইমেলার আগে বেরিয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন: বলিউডের নতুনরা খারাপ ছাত্র, সকলে শুধু বিখ্যাত হতে চায়: তিগমাংশু ধুলিয়া
এটা তো কোনও তর্কের অপেক্ষা রাখে না যে কলকাতা বইমেলা বাংলা বইয়ের বৃহত্তম ডিসপ্লে। আমরা যে বই বিজ্ঞাপিত করে, দোকানে সাজিয়ে পাঠকের অপেক্ষায় থাকি, সেই পাঠকের একটা বড় অংশ নিজের উদ্যোগে ওখানে এসে হাজির হন বইমেলায়। আমাদের কাজ হচ্ছে সংযোগ তৈরি করা। আমার যে স্টল, যেখানে বইগুলো সাজানো থাকবে, সেটাকে পাঠকের কাছে স্বচ্ছন্দ করা মানে ওয়েল এক্সিসিবল করা। যাতে তাঁদের খুঁজে পেতে অসুবিধা না হয়!— এমন বেশ কতগুলো বাহ্যিক দিক তো রয়েইছে। হইচই ফেলে দেওয়া বইপ্রকাশের বিজ্ঞাপন আমরা ইতিউতি দেখি আজকাল। কিন্তু 'প্রতিক্ষণ' ঠিক সেই 'হইচই ফেলা দেওয়া' বই বইমেলায় রাখে না। বইকে সাজানোর ক্ষেত্রে বরং আমরা আগে থেকে প্রস্তুতি নিই। কোনও ফাঁক থাকলে সেগুলি পূরণ করে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ধরা যাক, আমাদের পাঁচটি পোস্টার আর প্রিন্টের বিক্রি খুব ভালো। দেখা গেল, অবন ঠাকুর, রামকিঙ্কর, নন্দলালের, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং গগনেন্দ্রের মধ্যে গগনেন্দ্রের পোস্টারটি ফুরিয়ে গিয়েছে। আমরা তখন কী করি, ওই সেটগুলোকে পঙ্গু হতে দিই না। এটা ছাপা জরুরি ধরে নিয়েই কাজ শুরু করি। মোটামুটি নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই আমাদের বইমেলার জন্য একটা স্টকচেকিং পর্ব চলতে থাকে। যে কোনটা কতটা আছে! দেখা গেল কোনও পোস্টারের মাত্র পঞ্চাশটা বা একশোটা প্রিন্ট পড়ে আছে। সেখানে আরো পাঁচশোটা বা এক হাজারটা সঙ্গে সঙ্গে ছেপে নেওয়া। কারণ এগুলো তো বিদেশি ইমপোর্টেড আর্টপেপারে ছাপা হয়। ফলে সময় লাগে। আসলে এই বইমেলা ডিসপ্লের আগে যেটা আমাদের একটু চোখ বুজে ভাবতে হয়, সেটা হচ্ছে যে পাঠক 'প্রতিক্ষণ'-এর থেকে কী প্রত্যাশা করেন? ধরুন সাময়িকপত্রে যে ভাষা ব্যবহার করা যায়, সেভাবে একটা চমকপ্রদ কোনও বিজ্ঞাপন, অর্থাৎ যেটা খুব চুড়মুড়ে, কিন্তু ওজনটা হয়তো একটু কম। আমাদের মনে হয়েছে, এই ধরনের চকিত চমকের বিজ্ঞাপন পাঠক পছন্দ বা প্রত্যাশা কোনওটাই করেন না 'প্রতিক্ষণ'-এর থেকে। ওজনটুকুকে বজায় রেখে পাঠকের সঙ্গে সেই উষ্ণতাটুকু ধরে রাখার তাই আপ্রাণ চেষ্টা করি আমরা।
মানে কোনও প্রতারক প্রচ্ছদ নয়, বইমেলা বলে কোনও তাড়াহুড়ো নয়, সারা বছর ধরে একটা নিয়মিত পরিসরে ভালো বই তৈরি করে পাঠকের সামনে তুলে ধরাটাই আপনাদের মূল লক্ষ্য তাই তো?
সেটা তো বটেই। পাশাপাশি আমাদের বিবিধ রুচির পাঠকেরা প্রত্যেকে যাতে তাঁরা একটা কমফোর্ট জোন ফিল করতে পারেন, সেই দিকে খেয়াল রাখার চেষ্টা করি। যেমন ধরুন কিছু বই যেগুলো লঘু নয়, কিন্তু হাল্কা চালে পড়া যেতে পারে, যেমন 'লুপ্ত জীবিকা লুপ্ত কথা' বা 'পুজো সংখ্যার অলঙ্করণ', এই বিষয়গুলো খুবই ইন্টারেস্টিং, কিন্তু খুব গ্রামভারী প্রবন্ধের বই বলতে যা বোঝায়, একেবারেই তা নয়।
যেমন ছিল প্রতিক্ষণের একটা পকেট বই সিরিজ?
একেবারেই। সেই লুসিড রিডিংয়ের একটা ধারাকে আমরা বজায় রেখেছি। শিল্পকলা, ইতিহাস, আসলে সমাজবিজ্ঞান নিয়ে 'প্রতিক্ষণ' কাজ শুরু করেছে সত্যি কথা বলতে গেলে কুড়ির পর থেকে। একটা সময় পর্যন্ত সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি, ইতিহাস এগুলো খুব নিয়মিত বিষয় ছিল না 'প্রতিক্ষণ'-এর, যতটা না সাহিত্য এবং শিল্পকলা ছিল। এইটা এখন হয়েছে। এখন ধরুন, সাধারণত কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বলতে যা বোঝায়, সে ধরণের বিষয় নিয়ে বই করে না 'প্রতিক্ষণ'। এই ধরুন না প্যালেস্টাইন হচ্ছে, প্যালেস্টাইন নিয়ে ছোটো একটা বই বের করে দিলাম, বুকলেট আকারে বা অনুপত্রিকা অথবা অল্টারনেটিভ পাবলিশাররা যেভাবে করতে পারেন। আমি মনে করি, এটা করা উচিত নয় কারণ বই নির্মাণে আমরা যে সময়টা নিই, ততক্ষণে কারেন্ট অ্যাফেয়ার কিন্তু পিছনে চলে যেতে পারে। ফলে আমরা স্থায়িত্বের কথা মাথায় রেখে কাজ করি। আমরা মূল সময়টা দিই সম্পাদনার পিছনে। তাতেও কিন্তু প্রচুর খামতি, ভুলচুক থেকেই যায়। কিন্তু ওই বইমেলার পরেই আমাদের তিন দিন ব্যাপী সবচেয়ে বড় মিটিংটা হয়, সেটা হচ্ছে এই দু'মাসে যে বইগুলো বেরিয়েছে, তার একটা ইভালুয়েশন। কোথায় কোথায় কী কী খামতি থেকে গেল! আমাদের ওই খামতির একটা শিট আছে। এটা আমাদের কাছে খুব জরুরি জায়গা। যাতে পরের বছর বইমেলায় সেই ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি না হয়। নতুন কিছু ভুল সেই হবেই জানি। কিন্তু পুরনো ভুলগুলো যেন আর ফেরত না আসে।
আপনার কথা শুনে আমার মনে পড়ে গেল! সুমনের গানে একটা লাইন আছে, 'লেখকরা লেখে আর প্রকাশক ছাপে' — তো বাংলা প্রকাশনার এই রেওয়াজের বাইরে গিয়ে লেখক-প্রকাশক দ্বন্দ্ব সমাসের মাঝখানে 'সম্পাদক' নামে একধরনের মানুষ, তাঁদের একটা অস্তিত্বের কথা আপনার স্বীকার করছেন তাহলে?
শুধু স্বীকারই করি না, হাড়ে হাড়ে উপলব্ধী করি যে অসম্পাদিত একটা ব্লার্ব অবধি কতটা প্রতারক হতে পারে। অসম্পাদিত কোনও বইয়ের পাঠ, মানে ধরুন রোমিলা থাপারের কোনও বই নিয়ে তা অনুবাদ করে ছেপে দেওয়া, এর থেকে সহজ তো কিছু নেই। কারণ রোমিলা থাপার নামেই একটা বই হাজার হাজার কপি বিক্রি হয়ে যাবে। কিন্তু ধরুন, রোমিলা থাপারকে অনেকে বামপন্থী মনে করেন। কিন্তু 'বিরুদ্ধতার স্বর'-এ তিনি টানা গান্ধীবাদের পক্ষে সওয়াল করে গিয়েছেন। এখানে একটা বিতর্কের পরিসর তিনি উন্মুক্ত রেখেছেন। আমরা ব্লার্বের ক্ষেত্রে শুধু ধরিয়ে দিই যে তিনি এই বিতর্কের পরিসরটুকু রেখেছেন। সেখানে বলি: যেখানে একজন গান্ধীবাদের পক্ষে সওয়াল করছেন! রামচন্দ্র গুহ বা রোমিলা থাপার, তাঁদের মতো মানুষকে যখন রাষ্ট্রদ্রোহী বলা হচ্ছে, তাহলে রাষ্ট্র কতটা অসহিষ্ণু হতে পারে, দেখো। এইটুকু হচ্ছে আমাদের ধরতাই। এটা আমাদের সম্পাদনা টেবিলের কাজ। বইমেলার আগে বই না-ছাপার যে দু'টো কারণ, তার একটা কারণ হচ্ছে, জেলা বইমেলাগুলো ও তার পাঠককে সম্মান করা। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, বইমেলার আগে, এই ডিসেম্বর মাস থেকে বই ছাপার যে প্রায় মাৎস্যন্যায় শুরু হয়, সেখানে এটা বুঝতে হবে যে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে যে মানুষরা বই ছাপেন ও বাঁধেন, তাঁরা মূলত শিক্ষার সুযোগ পাননি, এবং তাঁরা বই পড়েন না। ফলে তাঁদের কাছে এটা একটা অসম্ভব ও অন্ধকারময় কাজের মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ফর্মা ভুল হওয়া, বাঁধাইয়ের মধ্যে গলদ থাকা, আলগা হওয়া, ছাপার ভুল হলে কোনও ফর্মা পাল্টানোর সুযোগ না-পাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি চলতে থাকে। আর এটাও একটা বড় কারণ। আমরা মনে করি, ঠিকঠাক ভাবে বই নির্মাণ করতে গেলে, যাঁরা আসল কাজটা করছেন, তাঁদের কিন্তু প্রার্থিত সময়টা দিতেই হবে।
গত শতাব্দীতে মানে নয়ের দশকের শেষের দিকেও 'প্রতিক্ষণ'-এর স্টল ছিল পাঠকের অবশ্য-গন্তব্য। এবং সেই স্টল শুধুমাত্র বইয়ের দোকান, তা তো নয়। আমি শুনেছি কখনও সেই স্টল সাজানোর পরিকল্পনা করেছেন পূর্ণেন্দু পত্রীর মতো শিল্পীও। বইমেলাতে যেমন মঁমার্ত-এ প্রচুর শিল্পী নিজের মতো কাজকর্ম করেন। কেউ আঁকেন, কেউ গান করেন। আমি নিজে দেখেছি, ৯৭ বা ৯৮ সাল হবে, শাকিলা এসে কোলাজ তৈরি করছেন। পানেসারজি হয়তো বসে আছেন। এই যে একটা শিল্পগ্রাম তৈরি হচ্ছে বইমেলার মধ্যে 'প্রতিক্ষণ'-এর নিজস্ব, এই ব্যাপারটা তো আর সেভাবে করে ওঠা সম্ভব হয় না। এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
এর মধ্যে কিছুটা টেকনিক্যাল কারণ জড়িয়ে আছে। যখন থেকে সল্টলেকে মেলা গেল, এবং তারপর কোভিডের পর স্টলে কিছু ছাটকাট হওয়ার পরে এখন যে লেআউট ম্যাপটা পান, তাতে 'প্রতিক্ষণ'-এর আগের যে অবস্থান ছিল মাঠে, তার থেকে ব্যাপারগুলো অনেকটাই বদলে গিয়েছে। ফলে আমাদের স্টলের পরিসর সামান্য ছোটো হয়েছে। ফলে আড্ডার জায়গাটাও সংকুচিত হয়েছে। এবং এটাও ঘটনা যে 'প্রাতিক্ষণিক' বলতে যাঁদের বোঝায়, তাঁরা বয়ঃবৃদ্ধ এবং অনেকেই নেই। ফলে এই অংশটাই প্রায় অনুপস্থিত। প্রতিক্ষণের এডিটোরিয়াল বোর্ডের মধ্যে স্বপ্না দেব ছাড়া আর কেউ-ই বেঁচে নেই। অরুণ সেন, দেবেশ রায়, পূর্ণেন্দু পত্রী, রণজিৎ সিংহ- এঁরা এখন আর কেউ নেই। 'প্রতিক্ষণ'-এর পুরনো আড্ডা বলতে যা বোঝানো হয়, তাকে আর ওইভাবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে চেষ্টা চলছে যাতে আবার আড্ডার সেই পরম্পরাকে ফিরিয়ে আনা যায়। তাছাড়া পত্রিকা আর প্রকাশনা সংস্থার পরিধি, তা তো অনেকটাই আলাদা। ওই লেখকরা আসবেন, এসে বসে সই দেবেন। আমরা এই ব্যাপারগুলিতে বিশেষ আগ্রহী নই। আমরা চাই লেখকের সঙ্গে পাঠকের দেখা হোক। এই লেখক-পাঠক কথাবার্তার পরিসরটাকে ফিরিয়ে আনতে আবার একটু জায়গা দরকার। এই জায়গাটুকু পেলেই সেই পরিসরটাও ফিরিয়ে আনা হবে। আমরা চেষ্টা করব প্রতিদিন যাতে এমন কোনও একজন লেখক থাকেন, যার কোনও না কোনও বই প্রকাশিত হয়েছে, এবং সেটা ভালো কোনও বই। সেটা প্রতিক্ষণ থেকে না-ও প্রকাশিত হতে পারে। ছোট্ট একটা অনুপত্রিকাও কোনও কোনও সময়ে চমকে দেওয়ার মতো বই করেন। কথা হতে পারে সেটা নিয়েও। একটা ওপেন ফোরাম গোছের কিছু।
'প্রতিক্ষণ' একটা অসাধারণ কাজ বইমেলার মাঠে করত। সেটা হচ্ছে 'প্রতিক্ষণিকা'। একটা ফোল্ডার বলা যেতে পারে একে। যেটা প্রতিক্ষণ থেকে বেরোত, এবং সেটা বিনামূল্য বিতরণ করা হত। এবং তাতে একটি বিখ্যাত লেখকের বড় লেখার সঙ্গে 'বইমেলা থেকে' নামে একটা সেদিনের বুলেটিন বের করা হত। সঙ্গে থাকত সাহিত্যের ধাঁধা ও ক্রসওয়ার্ড, এবং তার নীচে লেখা থাকত 'প্রথম নির্ভুল উত্তরদাতার নাম 'প্রতিক্ষণিকা'-য় ছাপা হবে। এবং তাঁকে প্রতিক্ষণ পাবলিকেশনের একটি বই উপহার দেওয়া হবে।' সেই যে একটা চমৎকার সাহিত্যের পরিবেশ, সেই 'প্রতিক্ষণিকা' কি আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব?
'প্রতিক্ষণিকা'-র ফিরে আসাটা খুব জরুরি। বইমেলাতে অনেক প্রকাশক সারা বছর ধরে ভালো বইপত্র বের করে। এবার বইমেলার সময়ে ধরুন, তাঁর এক নম্বর গেটের সামনে একটা ছোটো স্টল পড়ল। তার বিজ্ঞাপনের তেমন জোর নেই। হয়তো কলেজস্ট্রিটে কোনও আউটলেটও নেই। ফলে মানুষ তেমন আর জানতে পারছে না, সে কী কী করেছে। ধরুন, আমরা যদি 'প্রতিক্ষণিকা'-তে প্রতিদিন একটা করে এই ধরনের বই ও প্রকাশনার কথা ছাপতে পারতাম, চোদ্দো দিনে অন্তত চোদ্দোটা বই ও চোদ্দোটা প্রকাশনীর কথা মানুষকে জানানো যেত। প্রতিক্ষণের চল্লিশ বছর হয়ে গেল। ফলে তার তো সামান্য হলেও একটা পাঠক-ফলোয়িং রয়েছে। তাঁদের কাছে সেই বইগুলোর কথা পৌঁছে যেত। এই কারণেই 'প্রতিক্ষণিকা'-র দরকার ছিল। কিন্তু আপনি যে সময়ের কথা বলছেন, সে সময়ে 'প্রতিক্ষণ' পত্রিকার একটা স্ট্যান্ডিং সেটআপ ছিল। যাঁরা প্রতিদিন এই লেখাগুলিকে তৈরি করে এক রাতের মধ্যে ছাপার ব্যবস্থা করে ফেলতেন। তখন আসলে 'প্রতিক্ষণ'-এর জন্য মুদ্রণমেশিন ডেডিকেটেট থাকত। এখন কী হয়, এখন অল্প করে কিছু পিওডি করে ছাপা হয়, তাতে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হচ্ছে না। কিন্তু অন্তত তো এটুকু করা সম্ভব, যে প্রতি বৃহস্পতিবার বা প্রতি শনিবার মেলায় 'প্রতিক্ষণিকা' প্রকাশিত হল। সেক্ষেত্রে 'প্রতিক্ষণিকা' বেরনোর পথটা একটু হলেও সুগম হতে পারে। আসলে পত্রিকা বা খবরের কাগজের সেটআপ থাকলে এটা রোজ রোজ করা সম্ভব। নাহলে একটু ব্যবহারিক সমস্যা এসে পড়ে আর কী!
এ যাবৎ যা 'প্রতিক্ষণিকা' বেরিয়েছে, তার একটা সংকলন কি পাঠক প্রত্যাশা করতে পারে না?
'প্রতিক্ষণ' এটা মাঝখানে একবার ভেবেছিল। তার পরে কালের নিয়মে তা পিছনের দিকে চলে যায়। আপনি এই প্রসঙ্গটা তুলে ভাবনাটাকে আবার সামনে ঠেলে দিলেন। এটা হওয়া উচিত।
বেশ। এটা 'নষ্ট কষ্ঠী' উদ্ধারের মতো ব্যাপার হবে বলে আমার মনে হয়। আচ্ছা, আপনাদের তো কাজের একটা বড় জায়গা হল ছবি ও শিল্প সংক্রান্ত বই। বাংলায় তো ছবি নিয়ে আর বিশেষ কাজ করতে দেখি না অন্য প্রকাশকদের? ছবির বই করার অভিজ্ঞতা একটু শুনতে চাইব। মানে টেকনিক্যাল সমস্যা এবং বাণিজ্যিক চ্যালেঞ্জ— দু'টোই।
আমার ধারণা, নতুন প্রজন্মের যাঁরা প্রকাশক, তাঁরা এই কাজটা করতে চান না এমনটা নয়। ছবির বই করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, এই বইয়ের প্রোডাকশন। আপনি সম্ভবত স্বীকার করবেন যে 'প্রতিক্ষণ' যে শিল্পকলানির্ভর বইগুলো করেছিল, সেগুলো প্রায় প্রত্যেকটাই আন্তর্জাতিক মানকে ছুঁতে পেরেছিল। এখন এই মানের কাজ করতে গেলে ছাপাছাপির যে প্রকৌশলকে ব্যবহার করতে হয়, মানে ধরুন যে ধরনের কাগজের ব্যবহার করতে হয়, তাতে দাম... ধরুন স্বাভাবিক অবস্থায় একটা বই যদি আমি এখান থেকে ফোর কালার অফসেটে ছাপি, সেই বইটার দাম যদি এক লাখ হয়, তার প্রোডাকশন কস্ট ধরতে হবে আপনাকে মোটামুটি সাড়ে ৬ থেকে ৮ লাখের মধ্যে। এতটাই পার্থক্য। ওই কাগজে ছাপার জন্য যে মেশিনে এগুলো ছাপতে হয়, তাতে 'কোটার' থাকা জরুরি। রংটার উপরে একটা স্তর পড়ে যায় তাতে। যাতে এই রং বিবর্ণ না হয়ে যায়। সাধারণ মেশিনে আড়াই বা তিন হাজার টাকায় যেখানে একটা প্লেট ছাপতে পারছেন, কোটারযুক্ত মেশিনে সেই প্লেটের দাম পড়ছে দশ হাজার। তা সত্ত্বেও আর্টের বই করা উচিত। মুশকিল হচ্ছে, আর্টের বই বলতে আমরা যা বুঝি, মানে যা আর্ট নির্ভর, তা খুব দ্রুত, হু হু করে বিক্রি হয় না। এগুলি বিক্রি হতে সময় লাগে। ধরুন 'রবীন্দ্র চিত্রাবলী' এতদিন ধরেও শেষ হয়নি। হ্যাঁ, প্রায় শেষের মুখে। চলেছে ভালোই। কিন্তু শেষ হয়নি। আমাদের শেষ হয়েছে অবন ঠাকুর ও গগন ঠাকুর। সেটা হতেও কিন্তু পাঁচ-ছ বছর সময় লেগেছে। ধরুন, এই গগন ঠাকুরের তিরিশ বা চল্লিশ লক্ষ টাকা প্রোডাকশন কস্ট। এবার এই পাঁচটা বছর কিন্তু আপনার এই টাকাটা আটকে থাকছে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, এর ওয়্যারহাউজিং। সেই কাজটা খুব কঠিন। এমন একটা জায়গায় ওয়্যারহাউজ বানাতে হবে, যেখানে আর্দ্রতা নেই। যেখানে আমাদের ওয়্যারহাউজ, সেখানে আর্টের বইয়ের জন্য সম্পূর্ণ একটা আলাদা সেকশন তৈরি করতে হয়েছে। সেখানেও নানা ধরনের সিলিকন প্যাকেট ইত্যাদি রাখা, মেঝে, ছাত এবং দেওয়াল অন্য উপাদান দিয়ে মুড়তে হয়। এসব না করে আর্টের বই রাখা যায় না। কারণ একটা ছোট্ট ড্যাম্পের স্পট আপনার এক হাজার বইকে নষ্ট করে দিতে পারে। একটা আট কিংবা কুড়ি হাজার টাকা দামের বই কেউই খুঁত থাকলে কিনবেন না। আমাদের বাণিজ্যিক অভিজ্ঞতা হচ্ছে এটা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। এ কারণেই অনেকদিন প্রতিক্ষণ এই বইগুলির পুনর্মুদ্রণ করেনি। কিন্তু আমরা সবচেয়ে সিরিয়াসলি কাজ করছি গগনেন্দ্রনাথকে নিয়ে। আমাদের মনে হয়েছে, এত সব কিছুর মধ্যে কেউ যদি সবচেয়ে আন্ডাররেটেড কেউ থাকেন, তাহলে তিনি গগনেন্দ্রনাথ। তাঁকে আরও একটু বড় করে এবং দামের দিক থেকে আরেকটু সহজ করে আনা যায় যাতে, তার চেষ্টা চলছে। কীভাবে পপুলার এডিশন বের করা যায়, তা নিয়ে আমার বাবা প্রিয়ব্রত দেব ক্রমাগত কাজ করে যেতেন। ফলস্বরূপ গগনেন্দ্রনাথের উপর 'পপুলার এডিশন' বেরিয়েছিল সাড়ে ৩ হাজার টাকায়। আমাদের মনে হয়, কাউকে না কাউকে এই ঝুঁকিগুলো নিতে হবে। তবে এটাও ঠিক যে এই ধরনের ঝুঁকি খুব বেশি নেওয়া যায় না। 'প্রতিক্ষণ' সেসময়ে স্পনসরশিপ পেত। সরকারি বা মিনিস্ট্রি অব কালচারের। এখন 'প্রতিক্ষণ' যাঁরা পরিচালনা করেন, তাঁরা সরকারি বা কর্পোরেট স্পনসরশিপের বিরোধী। ফলে টাকাপয়সা পাওয়ার উপায় নেই। ফলে নিজস্ব পুঁজি বিনিয়োগ করে কাজ করাটা একটু কঠিন হয়ে পড়ে কোনও কোনও সময়।
'প্রতিক্ষণ' এখন নতুন কবিতা বা গল্পের বই করে না। কিন্তু 'প্রতিক্ষণ' একটা সময় আধুনিক গল্পের একটা চমৎকার সিরিজ শুরু করেছিল। সেই সিরিজ কি ফিরিয়ে আনা যায়?
আজকের প্রতিক্ষণ যে আইডেন্টিটিটা তৈরি করতে চাইছে, তা এসেনশিয়ালি ননফিকশনের। এখন বড় প্রকাশক বলতে যাঁদের বোঝানো হয়, তাঁদের অনেকেই ফিকশন নিয়ে কাজ করে। ফিকশন অনেক বেশি মূল বিনিয়োগ ফিরিয়ে দেয় প্রকাশককে, এমনও একটা কথাবার্তা ঘোরে বাজারে। তবে ফিকশনেও অনেক রকম পরীক্ষামূলক কাজকর্ম হচ্ছে আজকাল। আমার মনে হয়, ননফিকশন নিয়ে এখন কাজের সুযোগ আছে অনেক। আর যে আমরা ফিকশনের দরজা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছি, তা-ও নয়। প্রতিক্ষণের বেরোনো কবিতা এবং গল্প নিয়ে কাজকর্ম শুরু হয়েছে ইতিমধ্যেই। এই বইমেলার পরে পরেই 'প্রতিক্ষণের গোলটেবিল', 'প্রতিক্ষণের ফিচার', প্রতিক্ষণের 'পুজোসংখ্যার গল্প' ও 'পুজোসংখ্যার কবিতা', এরকম চারটে সংকলন বেরনোর কথা রয়েছে। গল্পের বইটার সম্পাদনা করছেন ভগীরথ মিশ্র এবং কবিতার বইটা সম্পাদনা করছেন রাহুল পুরকায়স্থ। সেসময়কার তরুণ গল্পকারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভগীরথ আর সম্ভবত তরুণতম কবি ছিলেন রাহুল। ২ জুলাই 'প্রতিক্ষণ'-এর চল্লিশ বছর পূর্তি। ১৯৮৩ সালে 'প্রতিক্ষণ'-এর প্রথম সংখ্যা বেরিয়েছিল। এইবার চল্লিশ পূর্ণ করছি আমরা। এই বছর পুরনো প্রতিক্ষণের অনেক কিছু ছাপার পরিকল্পনা রয়েছে। যেমন ধরুন খালেদ চৌধুরীর 'থিয়েটারের শিল্পভাবনা', অরুণ সেনের 'বইপড়া ও বইপাড়া' ও 'চার ইয়ারি আড্ডা'-সহ অনেকগুলি বইয়ের পুনর্মুদ্রণের ভাবনা রয়েছে। তার মধ্যে অরুণবাবুর 'চার ইয়ারি আড্ডা'-টা অবশ্য এই বইমেলাতেই প্রকাশ পেয়েছে। তবে পঁচিশ বছর আগের 'প্রতিক্ষণ'কে আর পুনর্নিমাণ সম্ভব নয়। 'প্রতিক্ষণ'-এর পত্রিকার সেটআপ থাকা আর না-থাকার পার্থক্যটা খুব বড় ভূমিকা পালন করেছে এখানে। সময়ের ডাকে সাড়া দিয়ে আরও অনেক বই হয়তো বেরোতে পারতো, যা হয়নি তখন। ফলে আমরা এই সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতির জায়গাটাতে আসতে চাইছি ইদানীং। আরও একটা বিষয়কে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি, সেটা অনুবাদ। সেটা মূলত অরুণ সোমের জন্যই শুরু হয়েছে। 'বিনতা' নামে দস্তইয়েভ্স্কির একটি নভেলা অনুবাদ করেছেন অরুণবাবু, সেটা এবারের বইমেলাতেই আসতে চলেছে। এরকম আরও বেশ কিছু কাজকর্ম আসতে চলেছে সামনের বছর। আশা করছি, পয়লা বৈশাখের আগে সারা বছরের কাজের পরিকল্পনা আমরা লিখিত ভাবে জানিয়ে দিতে পারব। তবে সারা বছরের বইগুলোকে একটু সুচারুভাবে দর্শকদের সামনে তুলে ধরা, বইমেলার পরিকল্পনা বলতে এটাই। তবে একটা খামতি আমাদের আছে। ছোটোদের জন্য বহুদিন আমরা কোনও ভালো কাজ করছি না। বইমেলার একটা বড় অংশ জুড়ে কিন্তু এই ছোটো-পাঠকের ভিড়। তাদের জন্য ভালো কাজের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়।
আরও পড়ুন:জামার তলায় চুরি করা রুশদি! বইমেলায় ক্রমেই ফিকে হচ্ছে বইপাগলরা
আমার মনে হয়, আরেক ধরনের ছোটোও এখন সংখ্যায় বড় হয়ে উঠেছে, যাকে আমরা বলি ইয়ং অ্যাডাল্ট। তাঁদের জন্যও কিছু বইয়ের কথা ভাবা যেতে পারে?
হ্যাঁ, এটা তো ভাবা উচিত। যৌথ পরিবারগুলি যখন ভাঙতে শুরু করল, যেই নিউক্লিয়ার পরিবারে বড় হতে শুরু করল তারা, তাদের ওঠাবসা-খাওয়া সবটাই তো বড়দের সঙ্গে। স্মার্টফোনের মাধ্যমে যে কনটেন্ট তাদের হাতে আসে, সেগুলো অ্যাডাল্টদের তৈরি করা। ফলে তাদের বিস্মিত হওয়ার মাত্রা কমছে। ফলে তাদের জন্য সিরিয়াস কাজ হওয়া দরকার। তাদের জন্য বাংলায় ভালো বই হওয়া জরুরি। সেই খামতি নিয়ে আমরা সচেতন। আগামী বছরের মধ্যে এ নিয়ে নিশ্চিত ভাবে কোনও পদক্ষেপ করবে 'প্রতিক্ষণ'।