রাশভারী ব‍্যক্তিত্ব, এদিকে মুখে অনর্গল অশ্লীল কথা? কাঁচা খিস্তির ক্লাস নিতেন কমল মিত্র ও বিকাশ রায়

প্রথম দিনেই চমক। এ তো যে সে ক্লাস নয়! প্রথম পাঠ শেখাচ্ছেন কমল মিত্র—বাংলা ভাষায় খিস্তি ঠিক কত ধরনের। শুধু খিস্তি না, কাঁচা খিস্তি।

জীবনে অনেক অদ্ভুত ঘটনাই ঘটে। কত চরিত্র, কত ওঠানামা, বোঝাপড়া… কত তাদের রহস্য— এমন হাজারো উপাদান দিয়েই তো জীবন। তবে তারই মাঝে এক বিশ্বাসঘাতক লুকিয়ে রয়েছে। প্রায়শই ঠকে যেতে হয় সেই ঠাঁইয়ে। বড় বেশি ভরসা করা হয় বলেই সে আরও পেয়ে বসে। ভাবছেন কী? আমাদের দু'টি চোখ। ঘটনা হোক, চরিত্র হোক- এক নজর দেখে নিয়েই সে মেপে ফেলতে চায়। আর তাতেই যত ভুল বোঝাবুঝির সূত্রপাত। পরে মনের সংস্পর্শে সে চরিত্র এলে মন বলে কই, এমনটা তো নয়। ব্যস! চোখে আর মনে নারদ নারদ। এর মাঝখানে ভোম্বল হয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। বাংলা ছবির কথাটাই ধরুন। বাইরে তার কত জৌলুস! বড় বড় তারকা, বিলাসী জীবনযাপন, বিভিন্ন লোকেশনে শুটিং, পাঁচতারা হোটেলে মোচ্ছব— চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কিন্তু এর অন্তরালে দৃষ্টি যায় না। একটি ছবি তৈরি যে কী পরিমাণ খাটনির কাজ, তা একমাত্র যারা ছবির সঙ্গে জড়িত তাঁরাই বোঝেন। তবে দিনশেষে পাওনার মাপটা বড় লোভনীয়, তাই সারাদিনের ক্লান্তি অতটা গায়ে লাগে না। আর্টের তৃপ্তি, সৃষ্টির উত্তেজনা, লক্ষ লক্ষ মানুষের ভালবাসা- শিল্পীর কাছে এই তো সব। আবার এই হাড়ভাঙা খাটনির মধ্যেও গড়ে ওঠে পারিবারিক সম্পর্ক, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা, রাগ, ঘৃণা, ঈর্ষা। বাস্তব জগতের সমান্তরাল এই পরিসরে জন্ম নেয় কতশত গল্প। চেনা মানুষ বলে যাদের মনে হয়েছে এতকাল, দেখা যায় তাদের পর্দায় ফুটিয়ে তোলা চরিত্রগুলি আমরা চিনি মাত্র।

কমল মিত্র এমনই চরিত্র। রাশভারী জমিদার, অত্যাচারী, মেজাজি… অথবা গম্ভীর পিতার চরিত্র, কখনও খলনায়ক- এই রূপেই মোটামুটি আমরা তাঁকে চিনি। কিন্তু তাঁর যে 'পাড়ার দাদা' গোছের আরেকটি মূর্তি ছিল, তার খবর রাখে কতজন! আজ সে কথাই বলব।

কানন দেবী যখন নিউ থিয়েটার্সে কাজ করতেন, সেসময় থেকেই নিজের একটি প্রযোজনা সংস্থা খোলার ইচ্ছে তাঁর ছিল। শেষ অবধি সে রূপ পেল, 'শ্রীমতী পিকচার্স'-এ। নিউ থিয়েটার্সের পিএন রায় কানন দেবীকে ডাকতেন 'শ্রীমতী' নামে। তার থেকেই নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থার নাম রাখলেন, 'শ্রীমতী পিকচার্স'। স্বামী ভট্টাচার্যসাহেব পরিচালক। যে সময়ের কথা, তখন শ্রীমতী পিকচার্স সবে 'নববিধান'-এর কাজ শুরু করেছে। কমল মিত্র এলেন সেই ছবিতে কাজ করতে। লম্বা দোহারা চেহারা, ভারী গলা যেন গমগম করছে, স্পষ্টবাদী, মুখের ওপর যা তা বলে দিতে পারতেন, আবার স্নেহও করতেন। অমোঘ ব্যক্তিত্ব। আর ছিল তাঁর সময়জ্ঞান, লোকে বলাবলি করত, কমলবাবুকে দেখে ঘড়ি মেলানো যায়। সেটের লোকজনের কাছে কমলদা একটু ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধাভক্তির পাত্র। সেসময় তরুণ মজুমদার শ্রীমতী পিকচার্সে বিনা বেতনে কাজ করেন। মূলত অবজার্ভার। কাজ শেখেন বলা চলে। একেবারে আম টেকশিয়ানদের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা। এটা-ওটা টুকরোটাকরা কাজ করে দেন। তাঁর ওপরেই ভার পড়ল কমল মিত্রকে ডায়লগ পড়ানোর।

আরও পড়ুন: হাসপাতালের বেডে শুয়ে মিনিট পাঁচেকে ‘পলাতকে’র গানে সুর দিয়েছিলেন হেমন্ত

এই সুযোগে দু'জনের পরিচয় বন্ধুত্বে বদলে গেল। মাত্র কয়েকদিনেই কমলবাবু থেকে 'কমলদা'-তে উত্তরণ। একদিন ডেকে বললেন, "আরে! তুই তো নেহাৎ দুধু-ভাতু টাইপের দেখছি। এই ফিলিম্ লাইনে টিঁকবি কী করে? তোর ভালোর জন্যেই তোকে একটু পাকানো দরকার। মাঝে মাঝে আমার কাছে আসবি। ক্লাস নেব।" ভালো কথা। একেবারে টেনিদামার্কা নির্দেশ। ফেলার উপায় নেই। তরুণ মজুমদার মাঝে মাঝে 'ক্লাস করতে' যাওয়া শুরু করলেন। কিন্তু প্রথম দিনেই চমক। এ তো যে সে ক্লাস নয়! প্রথম পাঠ শেখাচ্ছেন কমল মিত্র—বাংলা ভাষায় খিস্তি ঠিক কত ধরনের। শুধু খিস্তি না, কাঁচা খিস্তি। সে সিলেবাসের সামনে পড়ে তরুণ মজুমদারের রীতিমতো নাকানিচোবানি অবস্থা। একে অনভ্যস্ত কান, তার ওপরে শিক্ষকের আসনে কমল মিত্র। যার মুখ দিয়ে অমন শব্দ বেরতে পারে, তা কল্পনার অতীত। কমলবাবুর অবশ্য সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। বাল্মীকির ধৈর্য নিয়ে তিন ময়দানে নেমেছেন। ছাত্রকে একেবারে শিখিয়ে-পড়িয়ে নিয়ে, তবেই ছাড়বেন। এদিকে তরুণের প্রাণ ওষ্ঠাগত। বেশিরভাগই আদিরসাত্মক, সঙ্গে নানা রকম যৌন রেফারেন্স। ছাত্র ইতস্তত করছে দেখে বললেন, "প্রথমটায় তোর এমনটা হবে, যেমন এখন হচ্ছে। পরে দেখবি কত উবগার এতে। আরে, পক্সের টিকা দেওয়া হয় পক্স আটকাবার জন্য। সেটাও তো লো ডোজে পক্সেরই জার্ম। এই যে তৈরি করে দিচ্ছি তোকে, ফিউচারে আর কোনও...-এর (একটি কাঁচা খিস্তি) সাধ্যি নেই তোর মাথাটি‌ খায়।"

সত্যিই সাধ্যি নেই। প্রথম দিনের লো ডোজেই তরুণের মাথা ভার। দিলীপ মুখার্জি, শচীন মুখার্জির সঙ্গে তখন খুব দোস্তি। কোনওরকমে 'ক্লাস' থেকে 'সটকে' এসে বন্ধুদ্বয়কে বললেন সেকথা। ও বাবা! এ তো উল্টোসুরে গায়। দু'জনেই লাফিয়ে উঠলেন, "তাই নাকি? তাহলে তো আমরাও যাব। এমন ক্লাস মিস করতে আছে?" এড়িয়ে যাবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু বন্ধুবান্ধবের উৎসাহের চোটে তরুণের পক্ষে নিয়মিত 'ক্লাস' করা ছাড়া উপায় থাকল না। এদিকে এমন মনোযোগী ছাত্র পেয়ে কমল মিত্রের সে কী উৎসাহ! পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, "শোন্, অশ্লীল কথা বলার কত উপকার তা জানিস? পেটের মধ্যে চেপে রাখিস তাহলে এসব বাজে জিনিসপত্তর ভেতরেই জমা হয়ে দিন-কে-দিন পচে ফুলে আরও 'পয়জনাস্' হয়ে উঠবে। তার থেকে মুখ দিয়ে ভুর ভুর করে বাইরে বের করে দে, বাতাসে মিশে যাক। দেখবি, ভেতরটা ফুরফুরে আর হেলদি লাগে।"

এমন কোবরেজি ব্যাখ্যা শুনে তিন ছাত্রই বাক্যহারা। বটেই তো, বটেই তো। বেশ একটা নতুন ব্যাপার শেখা গেল। কমলবাবুই নাকানিচোবানি খাওয়াচ্ছিলেন, তাঁর সঙ্গে আবার এসে জুটলেন বিকাশ রায়। এ-ব্যাপারে কমল মিত্রের স্ট্রং সাপোর্টার। বয়সে তরুণদের প্রায় দ্বিগুণ। গুরুবাক্যের চাপে ছাত্রদের খাবি খাওয়া অবস্থা। অথচ এই লোকদু'টিই আর পাঁচজনের সামনে আদ্যোপান্ত গম্ভীর, মেজাজি লোক। সকলের মাঝখানে দেখে ভুল করেও কেউ এই চেহারার কথা ভাবতে পারবে না। তবে খিস্তির ক্লাসে পাঠদান ছিল সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক। সঙ্গে ঋষিসুলভ নিরাসক্তি। 'কুবাক্য' মনে হওয়ার জো নেই। বরং তিনজনের মনে হতো, মহাপুরুষের মুখনিঃসৃত পবিত্র বাণী তাঁদের কানে সুধা ঢেলে দিচ্ছে। চারদিককে ধূপের ধোঁয়ার মতো নির্মল করে তুলছে।

টোল বেশ ভালোই চলছিল, কিন্তু কপাল মন্দ। 'নববিধান'-এর শুটিং একদিন শেষ হলো। কমল মিত্রর সেটে আসার প্রয়োজন ফুরোল। পণ্ডিতের অভাবে টোল ছত্রাখান। হতভাগ্য তিন ছাত্রের প্রাইমারি-সেকেন্ডারি পাঠ শেষ হয়েছিল বটে, কিন্তু গ্র‍্যাজুয়েশনের স্বপ্ন অধরাই রয়ে। বাংলা খিস্তির ডিগ্রিটা তাদের কপালে জুটল না।

প্রতি সেটেই এমন কিছু গল্প থাকে। আর যেহেতু তরুণ মজুমদার মাটি থেকে শুরু করেছিলেন, তাঁর জীবনের নানা ঘটনায় সেই মেঠো সুর। জীবনের আনাচকানাচ। আজ সেই ছাত্ররা বেঁচে নেই কেউ। বেঁচে নেই শিক্ষকরাও। তবু গল্প রয়ে যায়। গল্পের সেতু বেয়ে অতীতের চরিত্ররা পাশে এসে বসে, হাতে হাত রাখে, হাসিকান্নার আরও ডজন ডজন গল্পের সৃষ্টি হয়। যেদিন গল্প থেমে যাবে, জীবন বলে কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না।

তথ্য ঋণ:
সিনেমাপাড়া দিয়ে (দু'খণ্ড), তরুণ মজুমদার, দে'জ প্রকাশনী

More Articles