গত কয়েক দশকে প্রথম বার! লোকসভা ভোট ঘিরে যে ছকভাঙা ছবি দেখল কাশ্মীর
Jammu Kashmir Lok Sabha Election 2024: লোকসভা ভোটের চতুর্থ ধাপে কড়া নিরাপত্তার মধ্যেই সকাল সাতটা নাগাদ শুরু হয়েছিল শ্রীনগরের ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ। সম্ভবত এই প্রথমবার শ্রীনগরে ভোট হয়েছে কোনও রকম বয়কটের ডাক ছাড়াই।
লোকসভা ভোট। গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎসব। সেই উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছে দেশ জুড়ে। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েক দফার ভোট মিটে গিয়েছে। বাকি গুটি কয়েক দফা। সেই কয়েক দফার মধ্যে পড়েছে জম্মু-কাশ্মীরের ভোট। ভারতের ভূস্বর্গ। ২০১৯ সালে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিয়েছিল মোদি সরকার। সংবিধান থেকে বিলোপ করা হয় ৩৭০ অনুচ্ছেদ। সেই ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের পর জম্মু-কাশ্মীরে প্রথম লোকসভা নির্বাচন। যে যে দাবি নিয়ে মোদি সরকার এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা আদৌ কি কাজে এল? নাকি কাশ্মীর রয়ে গেল কাশ্মীরেই?
গত ১৩ মে জম্মু-কাশ্মীরে হয়ে গিয়েছে প্রথম দফার ভোট। আরও এক দফা ভোট বাকি রয়েছে সেখানে। ২০১৯ সালের পর প্রথম ভোট। ফলে স্বভাবতই দেশের চোখ ছিল কাশ্মীরের দিকে। আর এ বারই জম্মু-কাশ্মীরের প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের বাইরে উপচে পড়ল ভিড়। কার্যত ২০২৪ লোকসভা ভোট ভেঙে দিল জম্মু-কাশ্মীরের এ যাবৎকালের সমস্ত রেকর্ড। গত সোমবার ছিল শ্রীনগরের ভোটকেন্দ্রগুলিতে নির্বাচন।
আরও পড়ুন: কেন প্রতিটি দফায় কম ভোট পড়ছে? কম ভোটে কার লাভ, কার ক্ষতি?
এতদিন ধরে কাশ্মীরের ভোট মানেই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভোট বয়কটের ডাক, অশান্তি, গোলাগুলি। তবে সেই প্রতিটা বছরের চেয়ে এই বছরটা ছিল ব্যতিক্রম। গত লোকসভা ভোট অর্থাৎ ২০১৯ সালের ভোটে শ্রীনগরে ভোট পড়েছিল মাত্র ১৪ শতাংশ। ২০১৪ সালের ভোটে ভোটার সংখ্যা ছিল ২৫.৮৬ শতাংশ। সেই বছরের ভোট পড়ার হারকেও ছাপিয়ে গিয়েছে এবারের লোকসভা ভোট। চলতি বছর সেই ভোটগ্রহণের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ শতাংশ।
লোকসভা ভোটের চতুর্থ ধাপে কড়া নিরাপত্তার মধ্যেই সকাল সাতটা নাগাদ শুরু হয়েছিল শ্রীনগরের ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ। সম্ভবত এই প্রথমবার শ্রীনগরে ভোট হয়েছে কোনও রকম বয়কটের ডাক ছাড়াই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে তাঁর প্রধান সেনাপতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ, প্রায় প্রত্যেকেই দাবি করে এসেছেন, শান্তি ফিরেছে কাশ্মীরে। সংবিধান থেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর প্রাথমিক ভাবে কাশ্মীরে প্রবল অশান্তি মাথা চাড়া দিলেও ক্রমশ ঠান্ডা হয়েছে সেই উত্তাপ। আর চলতি ভোটে শ্রীনগরে ভোটারদের এই স্বতস্ফূর্ততা যে গেরুয়া শিবিরকে খানিকটা অতিরিক্ত অক্সিজেন জুগিয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
শ্রীনগরে শান্তিপূর্ণ ভোটের জন্য এলাকার জনগণকে বিশেষ সাধুবাদ ও ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি জানান, আগের তুলনায় কাশ্মীরের পরিস্থিতি উল্লেখযোগ্য ভাবে ভালো। ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের সিদ্ধান্ত যে উদ্দেশ্য় নিয়ে করা হয়েছিল, তা অনেকটাই সফল। বিশেষত জম্মু-কাশ্মীরের যুব সম্প্রদায়ের যে স্বতস্ফূর্ত যোগদান দেখা গিয়েছে, ভোটে, তা না বললেই নয়।
জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক পিকে পোল জানিয়েছেন, এখনও পর্যন্ত যে সংখ্যাটা পাওয়া গিয়েছে, ফাইনাল ডেটা হাতে পেলে সেটা আরও বাড়তে পারে। আর জম্মুকাশ্মীরের এই অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোটের পিছনে মূলত চারটি কারণ দেখছেন তিনি। তাঁর মতে, কাশ্মীরের পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। এ বছর জম্মু-কাশ্মীর প্রার্থীরাও প্রচারে যথেষ্ট মন দিয়েছিলেন। তাছাড়া জনগণের মধ্যে আগের তুলনায় সচেতনতা বেড়েছে বলে মনে করছেন তিনি। কাশ্মীরের জনগণ বুঝতে পেরেছেন, স্থায়ী উন্নয়নের জন্য ব্যালটই একমাত্র অস্ত্র।
পুলওয়ামা জেলায় গত লোকসভা ভোটে ভোট পড়েছিল মাত্র ১ শতাংশ। সেই হার আশাপ্রদ রকমের বেড়েছে। ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা গোলাম মহিউদ্দিন মীর জানাচ্ছেন, এই যে ভোট কাশ্মীর দেখল, তা আসলে শত শত রাজনৈতিকদের প্রতি শ্রদ্ধা। যার সন্ত্রাস আর গণতন্ত্রের মধ্যে থেকে গণতন্ত্রকে বেছে নিতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন। যার মধ্যে রয়েছেন মীরের বাবাও। মীর নিজেও একাধিক বার জঙ্গিহামলার হাত থেকে বেছেছেন। পুলওয়ামার মুরান গ্রামের একটি ভোট কেন্দ্রে তিনি ভোট দিতে এসে তাঁর বারবার মনে পড়ে গিয়েছে ২০১৮ সালের কথা। যেখানে ভোট কেন্দ্রেই ঘটে যায় বড়সড় জঙ্গিহামলা। যার থেকে কোনও মতে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন মীর। সেই সমস্ত ভোটের থেকে এই ভোট যেন আকাশ-পাতাল আলাদা। এমন শান্তিপূর্ণ ভোটের স্মৃতি কাশ্মীরবাসীর মনে পড়ে না বোধহয় বিগত অতীতে।
এদিকে যখন ভারতের নিয়ন্ত্রণাধীন কাশ্মীর সাক্ষী থাকছে অবাধ এবং শান্তিপূর্ণ এক ভোটগ্রহণের, সেখানে পাক অধিকৃত কাশ্মীর বিগত কিছু দিন ধরে অশান্তিতে ফুটছে। চড়া রাজস্ব, মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুৎ সঙ্কট-সহ একাধিক অভিযোগ নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই ক্ষোভ জমা হচ্ছিল কাশ্মীরের বাসিন্দাদের মনে। জনঅসন্তোষ প্রতিরোধ করতে মারমুখী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে পাক পুলিশ ও আধাসেনা। পাক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর এবং ভিডিয়োতে ধরা পড়েছে জনতা-রক্ষী বাহিনীর সংঘাতের ছবি। রীতিমতো একে ৪৭ বের করে শূন্যে গুলি চালাতে দেখা যাচ্ছে পাক রেঞ্জারদের। এমনকি ছুটন্ত জনতার দিকেও তাক করা হচ্ছে বেয়নেট। দু’জন প্রতিবাদীর মৃত্যুর খবরও মিলেছে ইতিমধ্যেই।
এর মধ্যেই আবার ভোটে জিতে পাক অধিকৃত কাশ্মীর ছিনিয়ে নেওয়ার দাবি তুলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তেলঙ্গানায় প্রচারে গিয়ে শাহকে বলতে শোনা গিয়েছে, এনডিএ যদি এবার লোকসভা ভোটে জিতে ক্ষমতায় ফিরে আসে, তাহলে পাক অধিকৃত কাশ্মীরকে ভারতে ফিরিয়ে আনা হবে। সম্প্রতি কংগ্রেস নেতা মণিশঙ্কর আইয়ার বলছেন পাকিস্তানকে সমীহ করে চলা উচিত, কারণ তাদের কাছে পারমাণবিক শক্তি রয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে কথা বলতে গিয়েই শাহ পাক অধিকৃত কাশ্মীর ফিরিয়ে আনার কথা বলেন।
আরও পড়ুন: লাদাখকে দেওয়া কথা রাখেননি মোদি! রাজ্যের মর্যাদা ফিরে পাবে জম্মু-কাশ্মীর?
একদিকে কাশ্মীরে শান্তিপূর্ণ ভোট, জনগণের অবাধ ও স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ একরকম ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে কাশ্মীরে সফল বিজেপি সরকারের সিদ্ধান্ত। অন্য়দিকে, পাক অধিকৃত কাশ্মীর যে ভালো নেই, সেখানকার বাসিন্দাদের যে চরম অবস্থায় দিন কাটছে, সেই ছবি ক্রমশ সামনে এসেছে। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে অমিত শাহের এই দাবি কতটা তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। যদিও আরও এক দফা ভোট বাকি জম্মু-কাশ্মীরে। আগামী ২৫ মে সেই ভোট। সেদিনও কি একই রকম ছবিই ভেসে আসবে কাশ্মীর থেকে? নাকি পুরনো প্রথা ফিরিয়েই ফের ভোটে অশান্ত হবে কাশ্মীর? সেটাই দেখার।