ভোটের আমি ভোটের তুমি, ভোট দিয়ে যায় চেনা
Democracy and Election: নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা বা পক্ষপাতদুষ্ট বিচারব্যবস্থা বা বাজার নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম আসলে গণতন্ত্রের ভিত নাড়িয়ে দেয়। উইয়ের ঢিবি বানিয়ে দেয়।
১৭৮৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের এক স্মরণীয় দিন। সংসদীয় কনভেনশন থেকে বেরনোর মুখে উদগ্রীব এলিজাবেথ উইলিং পাওয়েল বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনকে প্রশ্ন করলেন, "ডাক্তার, কী পেলাম আমরা? রাজতন্ত্র না প্রজাতন্ত্র?" মিতবাক বেঞ্জামিনের অমোঘ উত্তর— "প্রজাতন্ত্র, তবে যদি তা টিকিয়ে রাখতে পারো"।
সারা পৃথিবী জুড়ে আজ প্রজাতন্ত্র তথা গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জোর লড়াই। মিডিয়া রসিকেরা ২০২৪ সালের নামই রেখে ফেলেছেন 'ভোটের বছর'। হবে না-ই বা কেন? একদিকে ভারত কাঁপছে সাতদফা লোকসভা ভোটের গরমে, অন্যদিকে আমেরিকা অপেক্ষা করে আছে এই বছরেরই নভেম্বরে ট্রাম্প বাইডেন দ্বৈরথ দেখার জন্য।
গণতন্ত্রের আঁতুড় ঘর যদি হয় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, তবে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বারোয়ারি উদযাপন যে হয় ভারতেই, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে দু' দেশেই গণতন্ত্র থুড়ি প্রজাতন্ত্রের চেহারা গত এক দশকে এতটাই বদলে গেছে যে গণতন্ত্র ব্যাপারটা যে আসলে কী? খায় না মাখে, তা রাষ্ট্রনীতির গবেষকদের নতুন করে ভাবতে বসার সময় এসেছে মনে হয়।
জনতার জন্য? জনতার দ্বারা?
২০২০-র নির্বাচনের পর অস্থির হয়েছিল আমেরিকাও। ট্রাম্প-প্ররোচিত দাঙ্গায় কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটল ইত্যাদিতে নির্বাচনের ফল অস্বীকার করা, জনতার লাগামছাড়া ভাঙচুর, মারধর অবিশ্বাস্যভাবে ওয়াশিংটনকে অস্থির হাইতি প্রজাতন্ত্র বা ভেনেজুয়েলার কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছে। গত চার বছরে এই দাঙ্গাকারীদের বেশিরভাগের শাস্তি তো হয়ইনি বরং ২০২০ নির্বাচনের ফল অস্বীকার করা সুবিধাবাদী, ষড়যন্ত্রের তত্ত্ববাদী রাজনীতিকরা দেশের নানান কোণে জাঁকিয়ে বসেছে। প্রসঙ্গত ভারতীয় মৃদুপ্রাণ উদ্বেল করা ভিভেক রামস্বামী বা নিকি হেইলিরা এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বেরই সমর্থক। গোঁড়া রিপাবলিকান ভোট যে বড় বালাই।
আরও পড়ুন: বিপজ্জনক সময়ের দিকে পা বাড়াচ্ছে ভারতীয় গণতন্ত্র
ভারতও কম যায় না তাতে। ক্রমে এ দেশেও প্রজাদের ইচ্ছে-অনিচ্ছেকে বাতুল করে দেওয়া যেন এক শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছেছে। চণ্ডীগড়ের মেয়র নির্বাচন থেকে সুরাতের ভোট; রাজস্থান থেকে মধ্যপ্রদেশ হয়ে মহারাষ্ট্রে জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের ঘোড়াতত্ত্ব বিসর্জন দিয়ে বাজারে নাম লিখিয়েছেন। যে নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনার জন্য নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সাংবিধানিকভাবে বিধিবদ্ধ, তাঁদের নিযুক্তি, কার্যকারিতা সবই কেন্দ্রীয় একতন্ত্রের কাছে বাধা পড়ে গিয়েছে। ফলে হিংস্র, ঘেন্নামাখা রাজনীতিই যেন ভারতের ভবিতব্য হয়ে উঠেছে দিনে দিনে।
আইন কানুন সততই সর্বনেশে
প্রজাতন্ত্র আর রাজতন্ত্রের মূল পার্থক্যটা বোধহয় এখানেই যে, রাজতন্ত্রে রাজার অধিকার প্রজার চেয়ে ঢের বেশি। রাজা ইচ্ছে মতো প্রজা শিকার করতে পারেন আর প্রজার বিন্দুমাত্র ট্যাঁ ফোঁ করার ও জোর নেই। প্রজাতন্ত্র তার থেকে আলাদা। অথচ সেই প্রজাতন্ত্রেই যখন শাসকের পরিব্যাপ্তি সর্বাত্মক হয়ে ওঠে তখন তা রাজতন্ত্রে পরিণত হয়। আইনের সামনে রাজা-প্রজা এক হলে তবেই না প্রজাতন্ত্র।
২০২০ সাল থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করে আসছেন তিনি রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন যা যা করেছেন; এমনকী তা যদি গৃহযুদ্ধে উস্কানি দেওয়ার মতো অভিযোগও হয়, সেক্ষেত্রেও তিনি সমস্ত আইনের ঊর্ধ্বে। আমেরিকার বিচারব্যবস্থা তা এখনও মেনে নেয়নি। তবে, এ রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী বিচারপতিদের মধ্যে গরিষ্ঠ অংশ প্রকাশ্যে বা প্রচ্ছন্নে ট্রাম্প সমর্থক। তাই আসলে কী হতে চলেছে আমেরিকায় বলা মুশকিল। পাশাপাশি সুতোয় ঝোলা সেনেট বা কংগ্রেসও শক্ত কোনও আইন পাশ করতে অক্ষম। ফলত বলাই যায়, ওয়াশিংটনের অকর্মণ্যতা এই মুহূর্তে বেশ চরমে।
ভারতের অবস্থা অবশ্য এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের থেকে বেশ আলাদা। আমেরিকাতে যেখানে প্রায় কোনও নতুন আইনই প্রণয়ন হচ্ছে না, ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠাতে বাইডেনের কালঘাম ছুটছে রিপাবলিকানদের অসহযোগিতার ফলে। সেখানে ভারতীয় লোকসভা-রাজ্যসভায় কৃষি বিল থেকে শুরু করে অগ্নিবীর, তথ্যপ্রযুক্তি আইন— প্রায় সবই পাশ হয়ে গিয়েছে বিনা বিতর্কে। লোকসভার কার্যকালীন দিনের সংখ্যা কমেছে। প্রশ্নোত্তর পর্বের ভূমিকাও কমেছে। লোকসভা ও রাজ্যসভাতে মণিপুর নিয়ে আলোচনার দাবিতে বেশিরভাগ বিরোধী সাংসদই বিতাড়িত হয়েছেন। সংবিধান অনুসরণ করার দায়ভার নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট যখনই কোনও আইন বা আদেশ নাকচ করেছে, তার পরের দিনই কেন্দ্রীয় সরকার নতুন আইন এনে সুপ্রিম কোর্টের থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দিয়েছে। আর জনতা রাস্তায় নামলে হয় ইন্টারনেটবিহীন শ্রীনগর বা ইম্ফল, নয় কাঁদানে গ্যাস, রবার বুলেট গাঁথা শাহিনবাগ। প্রসঙ্গত মোদী জমানা কিন্তু স্থিতিশীল সরকার পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে ভীষণ রকম প্রশংসিত। তবে প্রশ্ন ওঠে, সর্বাত্মক সংখ্যাগরিষ্ঠ গণতন্ত্রকে কি আদৌ গণতন্ত্র বলা যায়?
এ কি সত্য সকলই সত্য?
২০০৯ সালে ব্রায়ান অ্যাক্টন আর জান কোউম যখন হোয়াটসঅ্যাপ প্রতিষ্ঠা করেন তখন তারা হয়তো স্বপ্নেও ভাবেননি আগাপাশতলা এনক্রিপ্টেড এই বার্তা আদান-প্রদান মাধ্যম হাজার হাজার যুবক-যুবতীকে নানান রাজনৈতিক দলের আই টি সেলের চাকরি দেবে আর আমাদের শ্বাশ্বত খাস খবরের নড়বড়ে ভিতটি ক্রমে ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়বে। খেয়ালি পোলাওয়ের ইতিহাসে নেহরু হয়ে যাবেন মুসলিম, কোরাল রিফ হয়ে যাবে রামসেতু আর পুষ্পক বিমানের নকশা চুরি করেছেন রাইট ব্রাদ্রার্সরা।
স্যাটেলাইট টেলিভিশনের ইতিহাস ষাট সত্তর বছর পুরনো হলেও ২৪ ঘণ্টার খবরের চ্যানেলের ইতিহাস বছর কুড়ি আগের। প্রাচীনকালে মানে বছর কুড়ি আগে 'গুড নাইট' বলে প্রণয় রায় আমাদের ঘুম পাড়িয়ে যেতেন রাত সাড়ে ন'টার মধ্যে। সে সময় বদলেছে। ইদানীং বহু বিজ্ঞাপন ও বাণিজ্য নির্ভর চ্যানেলে সুধীর-অঞ্জনাদের রাতবিরেত অবধি জেগে চেঁচামেচি করতে হয়, পেট বড় বালাই। শেঠ বড় বালাই। প্রাইম টাইম খবর চলাকালীন নাটকীয় চিৎকার-চেঁচামেচির যে বিনোদন ব্যবস্থা মার ডক সাহেব ফক্স চ্যানেলে শুরু করলেন তা দেখতে দেখতে সবাই আত্মস্থ করে নিল। যুক্তরাষ্ট্রের শন হ্যানিটি থেকে টাকার কার্লসন এই সুযোগে নানান তথ্যপ্রমাণহীন আজগুবি তত্ত্বের যোগান দিতেই থাকলেন। আর তেমন ভাবেই আমাদের অন্তহীন জেহাদ আর হেরফের করা তথ্য পরিবেশন করে যেতে লাগলেন অর্ণব গোস্বামী, নাভিকা কুমারেরাও।
রাতের বেলা হ্যানিটি বা অর্ণব যা বলেন, তা পরের চব্বিশ ঘণ্টা তাঁদের চ্যানেলে গুঞ্জরিত হয় আর হোয়াটসঅ্যাপ ফেসবুকের অগুনতি গ্রুপে যুধিষ্ঠির রূপে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে গোময় হয়ে ওঠে করোনা বিনাশী আর পক্ষাঘাতগ্রস্ত অধ্যাপক হয়ে ওঠেন দেশের অন্যতম প্রধান শত্রু। তবে এর মধ্যে বাঁচোয়া একটাই। যুক্তরাষ্ট্রে জন অলিভার, জন স্টুয়ারা এখনও করে কম্মে খাচ্ছেন; ভারতে পথ দেখাচ্ছে আকাশ ব্যানার্জী, ধ্রুব রাঠিরা। এর এসবের বাইরে অনেকটা একা শিবরাত্রির সলতে রভিশ কুমার। পারলে ওঁর তথ্যচিত্রটা দেখুন। মাইরি।
কী যে জাগায় চেতনা? কী যে যোগায় ভোট?
'রক্তকরবী'-তে বড় ঠাকুর পষ্টাস্পষ্টি দেখিয়েছিলেন বিচারাগার, মন্দির আর অস্ত্রাগারের সহাবস্থানে কেমন করে প্রাণের বায়ু আটকে আসে। ইতিহাসের গল্প আর গল্পের ইতিহাসের মধ্যে আটকা পড়া 'মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন' বা "বিকশিত ভারত" দেখে বড্ড অবিশ্বাসে ভুগি, প্রাণটা আছে না গেছে!
মাস্টারক্লাসের একটি নতুন কোর্সের শুরুতে নীল ডিগ্রিসি টাইসন বলছেন, প্রত্যেক মানুষের তিনটে সত্যি। ব্যক্তিগত সত্যি, রাজনৈতিক সত্যি আর বস্তুগত সত্যি। সেদিন ইউটিউবে দেখলাম এক উত্তর ভারতীয় মহিলা বলছেন, যদি একটি কুকুরও বিজেপি প্রার্থী হয় তবে তাকে ভোট দেবেন। আমি অত্যন্ত সারমেয়প্রেমী এবং আমার পোষ্য মোমো আমার সন্তানতুল্য। তবে সংশয়ে সন্দেহে জেরবার হলাম এই ভদ্রমহিলার কাছে কৃষক আন্দোলন কি বস্তুগত সত্য? মহিলা বক্সারদের আন্দোলন? মণিপুরে গণহত্যা? করোনায় ভেসে যাওয়া লাশ? চিনের আবিষ্কৃত জমি? বিনা বিচারে আটক উমর খালিদ?
আমেরিকাতে যারা বিশ্বাস করে ক্লিন্টনরা শিশু পাচারে জড়িত, ভারতে তারাই বিশ্বাস করে নরেন্দ্র মোদী চা বিক্রি করে প্যারিস ঘুরতে গিয়ে ১৯৮৭ সালে ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি তুলেছেন।
আরও পড়ুন:কাকে ভোট দিচ্ছেন তার নেপথ্যেও আছে বিজ্ঞান! জানেন, কোন অঙ্ক মেনে চলে গণতন্ত্র?
১৭৮৭ তে বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন যা বলেননি তা হল, গণতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্র একা বাঁচে না। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা বা পক্ষপাতদুষ্ট বিচারব্যবস্থা বা বাজার নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম তার ভিত নাড়িয়ে দেয়, উইয়ের ঢিবি বানিয়ে দেয়। তার ভেতর থেকে রাম বা মরা কিছুই স্পষ্ট শোনা যায় না।
তবে মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। নাস্তিকের পাপ-পুণ্যের বালাই নেই তবে আশা তো রাখাই যায়। রেশন-খোর, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার-খোর, আদানি-খোর, কাশ্মীর ফাইলস-খোর কোটি কোটি মানুষ আগামীতে চাকরি-খোর, শিক্ষা-খোর, স্বাস্থ্য-খোর হয়ে উঠবে। নিজের ভোট নিজে দেবে। ভেবেচিন্তে বোতাম টিপবে। হিটলারের জার্মানিতেও কিন্তু ভোট হত।