মণিপুরের বুকে এখনও জমাট চাপ চাপ অন্ধকার
One year of Manipur violence: মণিপুরের জন্য দিবারাত্রের কয়েক মুহূর্তও বরাদ্দ করেনি কেন্দ্র সরকার। অথচ ভোট আসতেই গেরুয়া শিবিরকে গলা ফাটিয়ে বলতে শোনা গেল, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরে গিয়েছে মণিপুর। ভোট বড় বালাই।
একটা একটা করে দিন কাটে। ঘুরে যায় বছর। মণিপুরে ভোট আসে, সেই ভোট চলেও যায়। উত্তর-পূর্বের এই একরত্তি রাজ্যের ভোট তেমন গুরুত্ব রাখে না দেশের শাসকের কাছে। তাই হিংসায় দীর্ণ মণিপুরে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পায়ের ধুলো পড়ে না একবারও। আরও অনেক গুরুদায়িত্ব তাঁর কাঁধে। হিন্দু রাষ্ট্র গড়ার কাজ। প্রায় এক বছর ধরে রামমন্দির উদ্বোধনের নানাবিধ অনুষ্ঠান ধাপে ধাপে সেরেছেন মোদি। রীতিমতো সন্ন্যাসীর মতো রীতিনিয়ম মেনে জানুয়ারিতে ধুমধাম করে মূর্তি প্রতিস্থাপন হয়েছে রামলালার। এই এত সব ব্যস্ততার মধ্যে মণিপুরের কথা প্রায় ভুলতেই বসেছিল ক্ষমতাসীন সরকার। আর তার মধ্যেই কেটে গেল একটা বছর। মণিপুর-লজ্জার বর্ষপূর্তি।
জাতি হিংসার আবহে মণিপুর যখন উত্তাপে ফাটছে, যখন নগ্ন করে প্রকাশ্যে হাঁটানো হচ্ছে সে রাজ্যের দুই কন্যাকে, যখন তাঁদের সেই নগ্নমিছিল সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বের কাছে মুখ পোড়াচ্ছে ভারত নামক স্বর্গরাজ্যটির, তখনও সংসদে মণিপুর নিয়ে মাত্র কয়েকটি সেকেন্ড খরচ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ওই রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এসব দেখে শুনে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, মণিপুর কি ভারতের বাইরে? এ প্রশ্ন বড়ই মোক্ষম। সত্যিই মণিপুরের জন্য দিবারাত্রের কয়েক মুহূর্তও বরাদ্দ করেনি কেন্দ্র সরকার। অথচ ভোট আসতেই গেরুয়া শিবিরকে গলা ফাটিয়ে বলতে শোনা গেল, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরে গিয়েছে মণিপুর। ভোট বড় বালাই। মণিপুরে শান্তি ফেরানোর কৃতিত্বের মালা মোদি পরিয়ে দিলেন তাঁর সেনাপতি তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং বিজেপি শাসিত মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের গলায়। এর মধ্যেই মিটল মণিপুরের লোকসভা ভোট। শাসক থেকে শুরু করে বিরোধী, সকলেই মেতে রইলেন লোকসভা ভোটের প্রচারে। ব্রাত্য, অবহেলিত হয়ে পড়ে রইল মণিপুর।
আরও পড়ুন: কী দিন চেয়েছিলেন আর কী পেলেন মণিপুরের সেই নগ্নিকারা?
বারবার মণিপুর সাক্ষী থেকেছে মেয়েদের উপর নির্বিচার, নৃশংস অত্যাচার, নিগ্রহের। বারবার মণিপুরে নগ্ন হতে হয়েছে মায়েদের, মেয়েদের। কখনও সেনার বন্দুক, তো কখনও জাতি হিংসা। অত্যাচারীর মুখ বদলেছে, পোশাক বদলেছে। নিগ্রীহিতারা একই রয়ে গিয়েছেন এতগুলো বছর পরেও। একই রয়ে গিয়েছে সফট টারগেট। মণিপুরে বসবাসকারীদের মধ্যে দুটি জাতি, এক মেইতেই, অন্যরা কুকি। এই মেইতেই সম্প্রদায়কে তফসিলি উপজাতিভুক্ত করা নিয়ে এর আগেও বিতর্ক হয়েছে। হয়েছিল ২০২৩ সালের মে মাসেও। সেই ৩ মে। তফসিলি মর্যাদা সংক্রান্ত হাইকোর্টের নির্দেশের বিরুদ্ধে মিছিল চলছিল মেইতেইদের। সেই মিছিল থেকেই সংঘর্ষ বেঁধে গিয়েছিল কুকি সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে। সেই সংঘর্ষ যে কখন বিরাট, বিশাল বপু ধরে গোটা মণিপুরকে জ্বালাতে শুরু করল, তা বোধহয় টেরটিও পাননি বাসিন্দারা। জ্বলল ঘর, চোখের সামনে বাড়ি থেকে পুরুষ মানুষটিকে বের করে এনে গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হল আগুন। রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে প্রাণ হাতে করে দৌড়তে লাগলেন ন'মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এদিকে মেইতেইরা কুকি বাড়ির মেয়েটিকে টেনে বের করে আনল ঘরের বাইরে, কুকিরা মেইতেইয়ের মেয়েকে। ক্ষেতে নিয়ে গিয়ে চলল নির্বিচারে ধর্ষণ। এর নাম প্রতিহিংসা। দেখিয়ে দিল মণিপুর। রাজ্য জুড়ে জারি হল ১৪৪ ধারা। বন্ধ হল ইন্টারনেট। মণিপুরের সংযোগ ছিন্ন হল গোটা দুনিয়ার থেকে। ফলে কী চলছে মণিপুরে, সেই খবর আর বাইরে পৌঁছতে পারল না।
এরপর ইন্টারনেট ফিরেছে মণিপুরে। উঠেছে কার্ফুও। কিন্তু মণিপুর ঠিক কেমন আছে, সেই খবরখানা আজও পৌঁছয়নি শাসকের কানে। ওয়াকিবহাল মহল জানাচ্ছে, গত একবছরে যে অন্ধকারে ছিল মণিপুর, সেই চাপ চাপ অন্ধকার এখনও জমাট বেঁধে রয়েছে মণিপুরের বুকটিতে। সরকার কি আদৌ একবারও পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল উত্তর-পূর্বের এই খুদে রাজ্যটির? মণিপুরে শান্তি ফেরাতে, স্থিতবস্থা ফেরাতে আদৌ কোনও পদক্ষেপ করেছে বিজেপি সরকার? সরকারি হিসেব বলছে, এই এক বছরে মণিপুরে মৃতের সংখ্যা পেরিয়ে গিয়েছে ২২৫। যারা সংঘর্ষে ঘর ছেড়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই এখনও এলাকায় ফিরতে পারেননি। তার মধ্যে যেমন রয়েছে মেইতেইরা, তেমনই রয়েছে কুকি মানুষজনও। সংখ্যা বলছে, এখনও মণিপুরে ঘরছাড়া প্রায় ৭০ হাজার মানুষ। আর এই ভয়ঙ্কর জাতি হিংসায় জখম অন্তত ১৫ হাজার জন। যাঁরা সকলেই ভোটদাতা। হিংসার পরে তাঁদের কেউ আশ্রয় নিয়েছিলেন ত্রাণশিবিরে। কেউ প্রাণ বাঁচাতে জন্মভূমি ছেড়েছেন। হিংসায় বিধ্বস্ত মণিপুরে যাঁরা আর ফিরে আসতে পারেননি সাহস করে।
মেইতেইরা যদি তফসিলি উপজাতির স্বীকৃতি পায়, তাহলে কুকিদের ক্ষমতার বিস্কুটে কামড় পড়বে, সুবিধার গুড় খেয়ে যাবে মেইতেইরা! এই আশঙ্কায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কুকিরা সেদিন। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে হিংসা মাত্রা ছাড়ালে, রাজ্য সরকার অবিবেচকের মতো গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়। ৪ মে, থৌবল জেলার নংপোক সেকমাই থানা থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে দুই মণিপুরী মেয়েকে ধর্ষণের ভয়াবহ অভিযোগ উঠল।২০২০ সালে কেন্দ্রের কাছ থেকে দেশের সেরা থানার মর্যাদা পেয়েছিল এই নংপোক সেকমাই থানাই। অথচ সেই থানার চোখ এড়িয়েই ধর্ষণের পর ওই দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে হাঁটানো হয় এলাকা জুড়ে। প্রশাসন অন্ধ, প্রশাসন মূক এবং বধির। সেই দুই নগ্নিকার মার্চ ভাইরাল হল সোশ্যাল মিডিয়ায়। তার আগেই অবশ্য এই সংক্রান্ত অভিযোগ গিয়েছিল থানায়। তবে দেশের 'সেরা' থানার পুলিশ সেই অভিযোগ দায়ের করলেন না। অভিযোগ ছিল, ৮০০ - ১০০০ জন অজ্ঞাতপরিচয় সশস্ত্র দুষ্কৃতির বিরুদ্ধে। এমনকী সেই দুই নির্যাতিতা সাহায্যের জন্য পুলিশের দ্বারস্থ হলে, পুলিশ তাঁদের তাড়া করে নিয়ে যায় সেই সব দাঙ্গাকারীর কাছেই। যাদের হাতে নির্যাতিতা হন ওই দুই মহিলা। ততক্ষণ পুলিশ অন্ধ, মূক, বধির হয়েছিল, যতক্ষণ না সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় ওই দুই মহিলার লজ্জাজনক নগ্নমিছিল। যা দেখে শিউরে উঠেছিল গোটা বিশ্ব।
জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন রেখা শর্মা স্বীকার করেছেন, মণিপুরে মহিলাদের উপর অত্যাচারের বিভিন্ন অভিযোগ আগেই তাঁদের নজরে এসেছিল। খুনের ভয় দেখিয়ে মহিলাদের প্রকাশ্যে পোশাক খুলতে বাধ্য করার মতো ঘটনা ঘটছিল মহিলা কমিশনের চোখের উপর দিয়েই। অথচ তা নিয়ে কোনও পদক্ষেপ করেনি তারা। এক বছর হয়ে গিয়েছে মণিপুর হিংসার। আজও অধরা অভিযুক্তরা। সিবিআই সম্প্রতি তাদের চার্জশিটে জানিয়েছে, পুলিশের কাছে সাহায্য চেয়েছিল দুই নির্যাতিতা কিন্তু তাঁদের উন্মত্ত জনতার কাছেই ছেড়ে যায় পুলিশ। ৬ মে মণিপুরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব হাতে তুলে নেয় কেন্দ্র সরকার। অথচ মণিপুরে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারই। রাজ্য সরকারের এই চূড়ান্ত অদক্ষতার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছিল কেন্দ্র সরকার? ৬ মে-র পর মণিপুরে নামানো হল সেনা এবং অসম রাইফেলস। সেই অসম রাইফেলস, যাদের বিরুদ্ধে উনিশ বছর আগে গর্জে উঠেছিল মণিপুরের মায়েরা। যৌনলালসা মেটানো হয়ে গেলে মণিপুরের মনোরমার যৌনাঙ্গে গুলি করে মেরেছিল অসম রাইফেলসের জওয়ানরা। সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় নগ্ন হাঁটের মণিপুরের মায়েরা, মনোরমার মায়েরা। উনিশ বছরে যে মণিপুর বদলায়নি, তা একবছরে আর কতটা বদলাবে? কতটা শান্তি ফিরবে সে রাজ্যে?
সংখ্যার হিসেব বলছে, ২০২৩ সালের ৩ মে থেকে ৭ মে পর্যন্ত মাত্র পাঁচদিনে অন্তত ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল এই পড়শি রাজ্যটিতে। ৮ মে রাজ্যের সুরক্ষা বিভাগের দায়িত্বে থাকা সিআরপির প্রাক্তন প্রধান কুলদীপ সিং জানিয়ে দেন, মণিপুরে ৩৫৫ ধারা জারি করা হয়নি। অথচ রাজ্য সরকার তার আগেই জানিয়েছিল, সংবিধানের ৩৫৫ ধারা মেনে রাজ্যের নিরাপত্তার দায়িত্ব কেন্দ্রকে দেওয়া হয়েছে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, কুলদীপ-কে এই বিবৃতি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্র কারণ সামনে ছিল কর্ণাটকে বিধানসভা ভোট। ভোটের বাজারে যা প্রভাব ফেলতে পারত বিজেপির ভোটবাক্সে। পরে অবশ্য, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও একটি আরটিআইয়ের উত্তরে জানায়, সংবিধানের ৩৫৫ অনুচ্ছেদের অধীনে কেন্দ্রের দ্বারা জারি করা কোনও বিজ্ঞপ্তির কোনও তথ্য নেই মণিপুরে। অন্তত ২০২৩ সালে তো নেই-ই। কিন্তু এই ৩৫৫ ধারা জারি নিয়ে একটা বিভ্রান্তি সফল ভাবেই ছড়াতে পেরেছিল কেন্দ্র সরকার। মণিপুর রাজ্যে তফসিলি জনজাতিদের উপর আক্রমণের পিছনে বিজেপির সমর্থন রয়েছে। এই অভিযোগ এনে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল মণিপুর ট্রাইবাল ফোরাম। শুধু তারাই নয়, সুপ্রিম কোর্টে আরও কয়েকটি পক্ষ একই দাবিতে মামলা দায়ের করে। সূত্রের খবর, ১৩ মে পর্যন্ত মণিপুর থেকে ঘরছাড়া হয়েছিলেন ৪৫,০০০ জন। অসম রাইফেলস-সহ ১২৮ কলম সেনা নামানো হয়েছিল রাজ্যে। এতসব কিছু ঘটে যাওয়ার প্রায় ১২ দিন পর, ১৫ মে নাগাদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। আলোচনা করেন রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে।
এরই মধ্যে ২২ মে নাগাদ মণিপুর হাইকোর্ট রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেয়, যাতে তারা মেইতেইদের তফসিলি জনজাতির মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার করে। আর সেই নির্দেশকে কেন্দ্র করে ফের তেঁতে ওঠে মণিপুর। হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় নেমে পড়ে জনজাতি সংগঠনগুলি। পুনরায় আগুন লাগে দোকানে দোকানে। লাঠি ও অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন একদল মানুষ। ফের বেঁধে যায় সংঘর্ষ। ২৮ মে ইম্ফলের পাশাপাশি সেকমাই, সুগনু, কুম্বি, ফায়েং, সেরৌতে জঙ্গিহামলার ঘটনা ঘটে। এদিকে ২৫টি কুকি জঙ্গি গোষ্ঠী শান্তিচুক্তি করেছিল রাজ্য এবং কেন্দ্র সরকারের সঙ্গে। সেই চুক্তি অনুযায়ী তাদের তো অস্ত্র পরিত্যাগ করে শিবিরে থাকারই কথা। প্রশ্ন ওঠে, তাহলে হামলা কারা চালিয়েছিল? কারা ছিল সেই নতুন করে চাগাড় দেওয়া হিংসার নেপথ্যে? এর প্রায় এক মাস পরে মণিপুরে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু অমিত শাহ মণিপুরে পা দিতে না দিতেই, সেই হিংসার আঁচে যেন হাওয়া লাগে। লাফিয়ে ওঠে তার লেলিহান শিখা। পুড়িয়ে মারা হয় মা ও শিশুকে। হত্যা ও ধ্বংসের মিছিল যেন আরও এক হাত লম্বা হয়। দু'মাসব্যাপী মণিপুরের ইম্ফল - ডিমাপুর জাতীয় সড়ক অবরোধ করে রেখেছিল কুকিরা।
ওই বছরেরই ৪ জুলাই ৩ নম্বর রিজার্ভ ব্যাটেলিয়নের শিবির থেকে গুলি ও অস্ত্র লুট করে জনতা। মৃত্যু হয় দু'জনের। লুট হয়ে গিয়েছিল ৫,০০০ স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, কারবাইন, মেশিনগান, রকেট লঞ্চার, লাথোড গান, ৬.৫ লক্ষ গুলি, মর্টার ও শেল। তবে শেষ হল না হিংসার। ৩১ অগস্ট আবার সংঘাত বাঁধল দু'পক্ষের। সরকারি হিসেবে সেদিন অন্তত ১৬০ জনের মৃত্যু হয়। মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের মামলা ছিল ১৯ টি, অস্ত্র লুটের মামলা ছিল ৩ টি, ২ জনের হত্যা, ১ টি করে হিংসা, খুন, অপহরণ, অপরাধ ষড়যন্ত্রের মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এরই মধ্যে জুলাইয়ে মণিপুরের স্কুলগুলি খোলার নির্দেশ দেয় রাজ্যে সরকার। তার আগেও অবশ্য বহুবার সেই নির্দেশ এসেছিল। কিন্তু পরিস্থিতি উত্তপ্ত থাকায় তা সম্ভব হয়নি। ৫ জুলাই অবশেষে স্কুল খোলে। চলে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু তার মধ্যে আবার অশান্তির জেরে স্কুলে তালা পড়ে যায়। ৬ অক্টোবর নাগাদ পুনরায় স্কুল খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এই করতে করতেই কেটে গেল একটা গোটা বছর। মণিপুর রইল মণিপুরেই। কিন্তু চলে এল ভোট। গণতন্ত্রের সব চেয়ে বড় উৎসব। যেখানে মানুষ বেছে নেবে তার সরকার। সেই সরকার, যারা মণিপুরের জন্য কার্যত তেমন কিছুই ভাবেনি। অথচ ভোট আসতে না আসতেই মণিপুরে শান্তি ফেরার কথা সগর্বে ঘোষণা করে দিলেন মোদি।
২০২৪ লোকসভা ভোট। ফের যে ভোটে জিতে ক্ষমতায় বসতে চলেছে গেরুয়া শিবিরই, সে বিষয়ে গোড়া থেকেই একরকম নিশ্চিত ছিল বিজেপি। তবে সেই আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরল ইলেক্টোরাল বন্ড দুর্নীতির মতো এক একটি ফাঁক সামনে এসে পড়তেই। তড়িঘড়ি নজর ঘোরাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক দেশ জুড়ে কার্যকর করে দিল বিতর্কিত সিএএ আইন। এত সব কিছুর মধ্যে সরকারও দিব্যি ভুলে রইল মণিপুরকে, মানুষও। গত ২৬ এপ্রিল ছিল মণিপুরে লোকসভা ভোটে। সেই ভোট বয়কটের ডাক দিয়েছিল মণিপুরের একাধিক কুকি ও মেইতেইদের সংগঠন। আদৌ শান্তিপূর্ণও হন না মণিপুরের ভোট। নির্বাচনে রিগিং ও ভোট দখলের অভিযোগও ওঠে দেদার। ওই দিন নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর, মধ্যরাতে জঙ্গি হামলায় মৃত্যু হয় ২ জওয়ানের।
মণিপুরের সমস্যার বীজ পোঁতা আসলে অনেক গভীরে। সেখানকার মেইতেইরা মনে করে, কুকিরা আসলে বহিরাগত এবং মাদক ব্যবসায়ী। নানা সময় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও এই দাবিই করে গিয়েছেন। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজেও মেইতেই সম্প্রদায়ভুক্ত। শুধু তা-ই নয়, প্রশাসনের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদই মেইতেইদেরই দখলে। ফলে তাঁরা যে লড়াই করে নিজেদের জায়গাই বজায় রাখবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! অন্যদিকে কুকি বিধায়কেরা দিল্লি গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করে আলাদা শাসনাঞ্চলের দাবি করেছেন। অভিযোগ, কুকিদের থেকে মেইতেইদের রক্ষা করতে নাকি মেইতেই যুবকেরা ' আরাম্বাই টেঙ্গল' নামে জঙ্গি বাহিনী গড়ে তুলেছে। আর এই বাহিনীকে নাকি প্রত্যক্ষ ভাবে সমর্থন করে চলেছে রাজ্যের বিজেপি সরকার। ৩ মে দিনটিকে 'কালা দিবস ' ঘোষণা করেছে একাধিক কুকি সংগঠন। এলাকার সমস্ত কুকিদের বাড়িতে উঠেছে কালো পতাকা। অন্যদিকে, দিনটি পালন করছে মেইতেইরাও। তাঁদের কাছে এ দিনটা বহিরাগত মাদককারীদের হামলার বর্ষপূর্তি। এই দিন মণিপুর ও দিল্লি জুড়ে নানা কর্মসূচি করেছে মেইতেই ও কুকিদের সংগঠন। ৭ জন মেইতেই মা শান্তির দাবিতে মাথা কামিয়ে সেকমাই থেকে ইম্ফলের কাংলা দুর্গ পর্যন্ত সাইকেল চালিয়ে গিয়েছেন। গণকবরে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। কুকি সম্প্রদায়ের ছবি লাগানো ও শতাধিক নিহতের কফিন রাখা 'ওয়াল অব রিমেমব্রেন্স' - এ জমায়েত করেছেন কুকিরা। আর মণিপুর হিংসার এই ভয়াবহ কালো দিনটিকে কার্যত ফাইলের তলায় চাপা দিয়ে ভুলে যেতে চেয়েছে ক্ষমতাসীন সরকার। কারণ হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার মহান কাজে মণিপুরের ভূমিকা প্রায় নেই বললেই চলে। ছোট্ট ওই ভুখণ্ডের অস্তিত্বকে ঘিরে তাই বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই শাসকের।
আরও পড়ুন:ফের ফিরছে মনোরমার স্মৃতি! এ কোন অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে মণিপুরে?
মার্কিন বিদেশ মন্ত্রকের '২০২৩ কান্ট্রি রিপোর্টাস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিসেস : ইন্ডিয়া'-র রিপোর্টে বলা হয়েছে, মণিপুরে কুকি ও মেইতেই জনগোষ্ঠীর এই সংঘর্ষে মানবধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। সেই রিপোর্টে উঠে এসেছে সংবাদমাধ্যম 'বিবিসি'র দফতরে তল্লাশির প্রসঙ্গও এসেছে । প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছিল বিবিসি। তার পরেই অভিযান চলে ওই সংবাদমাধ্যমের দফতরে। কিন্তু মণিপুরের অন্ধকার কাটে না। এখন মণিপুরের বিভিন্ন ত্রাণশিবিরে কোনওমতে বসবাস করছেন অন্তত ৬০ হাজার মানুষ। এখন সেখানকার মানুষ এক চরম অসুরক্ষিত পরিস্থিতিতে বেঁচে রয়েছেন। অথচ এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি বোধহয় সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনা। অথচ সে দিকটা ভাবছেই না শাসক দল। স্বাধীন ভারতবর্ষের একটি স্বাধীন রাজ্যের মানুষ যে কীভাবে নিমেষে ছিন্নমূল হয়ে যেতে পারে, কীভাবে মুহূর্তে ভিটেমাটিহারা হয়ে ঘুরে বেড়াতে হতে পারে মানুষকে পররাজ্যে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল মণিপুর। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা কিংবা সিরিয়ার থেকে কি কোনও অংশে ভালো রয়েছে মণিপুর? প্রশ্ন ওঠে বৈকি। বিরোধীরা বারবার বলে এসেছে, মণিপুর যখন জ্বলছিল, প্রধানমন্ত্রী তখন কর্ণাটকের ভোটের প্রচারে ' জয় শ্রী রাম ' স্লোগান দিচ্ছিলেন। এই গোষ্ঠী সংঘর্ষ আসলেই কি রাজনৈতিক মদত ছাড়া হয়েছে? কেন্দ্রীয় সরকার এখনও যে ভাবে এই সঙ্কটের মোকাবেলা করছে তার মধ্যেও কি দমনের প্রবণতাই স্পষ্ট নয়? কোনও যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রে, কেন্দ্র-রাজ্য এমন সম্পর্ক হওয়ার কথা ছিল আদৌ? ভোট আসবে-যাবে। রাজা আসবে, রাজা বদলাবে। উনিশ বছর ধরে যে অন্ধকারের বীজ পোঁতা রয়েছে মণিপুরের বুকে, সেখানে আলোকবর্তিকা নিয়ে হাজির হবে কি কোনও সরকার? নাকি মণিপুর থেকে যাবে সেই মণিপুরেই!