আনিস হত্যায় নাগরিক নীরবতা চাইছে অস্বস্তিতে পড়া শাসক?

সাল ২০১৯। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নিয়ে এল নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। প্রথমে আসামে বলবৎ হলেও ৯ ই ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ সংসদে ঘোষণা করেন গোটা দেশে চালু হবে এন আর সি- সি এ এ। মুহূর্তের মধ্যে এর আঁচ ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। ধীরে ধীরে সাম্প্রদায়িক বিজেপি সরকারের নীতি স্পষ্ট হতে শুরু করে। দেশের সংখ্যালঘু খুব বিশেষ ভাবে বললে মুসলিম তাড়ানোর জন্যই এই নীতির প্রণয়ন। যে রাজ্যগুলি দেশভাগের যন্ত্রণা দেখেছে তাদের কাছে এই নীতি আরও প্রতিবাদের কারণ হয়ে উঠল। বাদ গেল না পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গের দিকে দিকে কলেজ ইউনিভার্সিটি রাজপথ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল এনআরসি, সিএএ বিরোধী মিছিল। দিল্লির শাহিনবাগের পর খোদ কলকাতার বুকে পার্ক সার্কাসে শুরু হল মহিলাদের অবস্থান। এই আন্দোলনেই যোগ দিতে এলেন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আনিস খান। 

যদিও আনিসের রাজনীতিতে হাতেখড়ি বাগনান কলেজে। আমতার বাসিন্দা আনিস তখন স্টুডেন্টস ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার সক্রিয় কর্মী। তারপরে সময় যত গড়িয়েছে আনিসের রাজনৈতিক পরিচিতি বেড়েছে। ২০১৫ সালে আনিস আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরেই ২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এম টেকের স্টুডেন্টদের সাসপেন্ড করে। আন্দোলন শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। আনিস সেদিন সেই আন্দোলনের দায়ভার তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে। সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দিয়ে সেদিন ছাত্রদের ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন। রাজনীতির শুরু এসএফআই-এর হাত ধরে হলে ও পরবর্তীকালে আব্বাস সিদ্দিকি যখন ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট তৈরি করলেন আনিস ধীরে ধীরে আই এস এফের আদর্শে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন। তার একটা বড় কারণ হয়তো আনিসের সংখ্যালঘু পরিচয়ের সঙ্গে আব্বাসের দলের মতাদর্শগত মিল।

শুধু তাই নয় আনিস হাওড়ায় নিজের এলাকাতে ও তার রাজনৈতিক মতাদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সক্রিয় হয়ে উঠছিলেন। সামাজিক নানা কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন আনিস। খুব স্বাভাবিকভাবেই যে হাওড়া শাসকদলের শক্ত ঘাঁটি সেখানে এমন বাম মনোভাবাপন্ন ছাত্রনেতার ‘রাজনৈতিক বাড়াবাড়ি’ শাসকদলের অস্বস্তির কারণ। সে কথা বুঝেছিলেন আনিস নিজেও। নিজের রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য যে শাসকদলের স্থানীয় নেতাদের আক্রমণের মুখে পরতে হবে সে কথা অনুমান করে পুলিশের হস্তক্ষেপও চেয়েছিলেন। কিন্তু পরে সেই পুলিশের উর্দিধারীদের হাতেই খুন হলেন আনিস। সমাপতন বললেও কম বলা হয়। পুলিশের ভূমিকা ঠিক না ভুল তা বিচার করবে প্রশাসন। কিন্তু এই ‘রাজনৈতিক হত্যা’ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেল।

আনিস খানের মৃত্যুর পরের দু'দিন কার্যত নীরব ছিলেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান। এই দু'দিনে কলকাতা দেখেছে কীভাবে আনিসের মৃত্যুর বিচার চেয়ে পথে নেমেছে গোটা নাগরিক সমাজ। অবশেষে নীরবতা ভেঙে মুখ্যমন্ত্রী তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। শাসকদলের অস্বস্তি কাটাতে মমতা আনিসের উপর আরোপ করেছেন নিজেদের দলের রাজনৈতিক পরিচয়। দাবি করেছেন ভোটের সময় আনিস সরাসরি তৃণমূলকে সাহায্য করেছেন নির্বাচনে। এই তথ্য ভুল না ঠিক তা যাচাই করবে কে! তার থেকেও বড় কথা নেত্রী এ কথা কেন বললেন! সংখ্যালঘু আনিসকে নিজেদের লোক প্রমাণ করতে না পারলে তৃণমূলের এতদিনের অর্জন করা মুসলিম ভোটব্যাঙ্কে তা সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে, সেই কারণেই কি?

অতীতে রিজওয়ানুর রহমানের মৃত্যুতে পশ্চিমবঙ্গ দেখেছে কীভাবে তৎকালীন শাসকদল সিপিএমের নাম জড়িয়ে গিয়েছিল ওই ঘটনায়। ড্যামেজ কন্ট্রোলে নামতে হয়েছিল স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। নিজের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে মমতা জানেন এই ঘটনা যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে বেরিয়ে যায় এই ঘটনা তার গদি টলমল করে দিতে পারে। সেই কারণেই শাসকদলের ভিতর থেকেই একের পর এক নেতা প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এই ‘রাজনৈতিক খুন’-কে লঘু করার।

রাজ্যের মন্ত্রী এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম বিশ্বস্ত সৈনিক ফিরহাদ হাকিম ঘটনার নিন্দা করে আক্ষেপ করেছেন, এমন ঘটনা উত্তরপ্রদেশে ঘটলেও বঙ্গে তা অমিল। কিন্তু সেই মন্ত্রীই আবার পরমুহূর্তে বলেছেন যা ঘটেছে তা নিন্দনীয় হলেও বিক্ষোভ করে কোনও লাভ নেই। বিক্ষোভ বিরোধিতার গণতান্ত্রিক নাগরিক অধিকারটি তো সাংবিধানিক। সেখান থেকে বিরত হতে বলা কি ঠাণ্ডা গলার হুকুম! বিরোধিতা সইতে কেন পারছে না তৃতীয় ইনিংস শুরু করা একটি সরকার? কেন স্রেফ ববি হাকিমকেই এগিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিবৃতি দিতে? ছাত্রের মৃত্যুতে শিক্ষামন্ত্রীর কোনো বার্তা নেই কেন! ভাবুন, ভাবা প্র্যাকটিস করুন।

More Articles