মারা গিয়েছেন ২ হাজার মানুষ, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আখ্যান শুনলে শিউরে উঠতে হয় আজও

Babri Masjid : ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর, ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক অন্ধকারময় দিন

২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর, রায় জানাল দেশের শীর্ষ আদালত। সে রায়ে বলা হল, সকলেই বেকসুর খালাস। অর্থাৎ একটা ফুৎকারে মিথ্যা হয়ে গেল সব ঘটনা। কিন্তু এতগুলো বছর ধরে বয়ে বেড়ানো অন্ধকার ইতিহাসের দায় ঝেড়ে ফেলা কি এতই সহজ? ঘটনার সূত্রপাত ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক ৩০ বছর আগের একটা দিন। মাঝে এতগুলো দিন অথচ কি টাটকা সব স্মৃতি। আজও দেশ জুড়ে ধর্ম নিয়ে দাঙ্গা লাগলেই দগদগে ঘায়ের মতো জানান দেয় ৯২ সালের ওই দিনটি। ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক অন্ধকারময় দিন সেটি। দেশজুড়ে সে এক বিভীষিকা। দাউ দাউ করে জ্বলছে সাম্প্রদায়িক আগুন। হাজার হাজার কর সেবক সেদিন চোখের সামনে গুঁড়িয়ে ফেললো আস্ত একটা মসজিদ। সশস্ত্র হামলায় একে একে উপড়ে ফেলা হল মসজিদের তিন-তিনটি গম্বুজ। আর এই মারাত্মক সাম্প্রদায়িক হিংসার দায় মাথায় নিয়ে বলি হল কয়েক হাজার মানুষ। উপস্থিত ছিল পুলিশ, প্রশাসন, অথচ সকলেরই মুখে যেন সেকেলে কোনও কুলুপ আঁটা। বহু জং তাতে। তারপর নিমেষের মধ্যে এই ঘটনার রেশ ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশ জুড়ে। শুরু হল দাঙ্গা। মাত্র একটা দিন তারপর থেকে আমলে বদলে গিয়েছিল ভারতীয় রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট। অথচ ২৭ বছর পর ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর দেশের শীর্ষ আদালত যেন সেসব ইতিহাসকে নিমেষে অস্বীকার করে ফেলল। জানিয়ে দিল যে, ভাঙা মসজিদের জায়গাতেই একটি মন্দির হবে, সেখানে শিলান্যাসও হয়ে গেল ওই বছরের ৫ অগস্ট।

কবি অবশ্য অনেকদিন আগেই বলেছিলেন, “মন্দির না না মসজিদ ওই জিজ্ঞাসা কোন জন..!” কিন্তু সে কথা কানে তোলেনি এ সমাজ। কানে তুললে অবশ্য স্বার্থলোভীদের বেশ খানিকটা অসুবিধাই হতো। রাম মন্দির না বাবরি মসজিদ? এই নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। মামলা চলেছে দীর্ঘ ২৮টি বছর। রায় অবশ্য মন্দিরের দিকেই গিয়েছে। আর দেরি না করে সেখানে গজিয়েও উঠেছে রাম মন্দির।

আরও পড়ুন : বাবরি ধ্বংসের প্রেক্ষাপটে অমর বন্ধুত্বের গল্প! কেন দেখতে হবে ‘দোস্তজী’

ষোড়শ শতকে মোঘল সম্রাট বাবরের সময় তৈরি হয়েছিল বাবরি মসজিদ। সেই মসজিদই ১৯৯২-এর ৬ই ডিসেম্বরে হিন্দুত্ববাদী ভিএইচপি, বিজেপি এবং শিবসেনা পার্টির সদস্যরা ধ্বংস করে। কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়, মসজিদের ওই জায়গাটি নাকি ছিল হিন্দুধর্মের অন্যতম আরাধ্য দেবতা অর্থাৎ রামের জন্মস্থান এবং সেখানে মসজিদ হওয়ার আগে একটি মন্দির ছিল। সুতরাং গুঁড়িয়ে ফেলো...

ভারতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের কণ্টকিত ইতিহাসে বাবরি মসজিদে হামলা একটি ‘কলঙ্কিত অধ্যায়’। গুটি কয়েক হিন্দু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী দিনটিকে সূর্য দিবস বলে আখ্যায়িত করলেও বেশিরভাগ ভারতীয় দিনটিকে ‘কালো দিন’ বলে উল্লেখ করেন। অনেকেই বলেন, এ ঘটনায় দেশের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি একেবারে ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল।

১৫২৭ সাল। দিল্লির মসনদে তখন জহিরুদ্দিন মহম্মদ বাবর। তাঁর আমলেই সরযূ নদী পাড়ে গড়ে উঠলো এক মসজিদ। নামকরণও হল তাঁর নামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই। সম্রাট অবশ্য তখন জানতেন না সাড়ে চার শতক পরে এটিই ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে।

আশ্চর্যজনক ভাবে সমকালীন ‘বাবরনামা’ এবং আবুল ফজলের ‘আইন ই আকবরীতে’, দুটোর কোনোটাতেই উল্লেখ মেলেনি বাবরি মসজিদের। এমনকী তুলসি দাসের রাম চরিতমানসেও কোনো উল্লেখ নেই এ মসজিদের! অবাক করে ঠিকই তবুও অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। বাবরি মসজিদের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৭১৭ সালে জয়পুরের মহারাজা দ্বিতীয় জয় সিংহের সময়ে। এটাকেই প্রামাণ্য দলিল বলা চলে।

আরও পড়ুন : বিজেপি-কে ‘সবক’ শিখিয়েছিলেন, মৃত মুলায়মের ভার যে কারণে জীবিত-র থেকেও বেশি

কিন্তু ধ্বংসের কারণ কী? আসল ঘটনা কী ঘটেছিল?

বিতর্কের শুরুটা অনেক আগেই। ১৮৫৩ সাল থেকেই ভিতরে ভিতরে ধিক ধিক করে জ্বলছে হিন্দু মুসলিম বিতর্কের আগুন। সেই সময় ব্রিটিশ সরকার দেওয়াল তুলে হিন্দু মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের প্রার্থনার জায়গা পৃথক করে দেয়। সংঘাতের শুরু সেখানেই। সে সময়ে ইংরেজ সরকার মন্দির বানানো নিষিদ্ধ করে দেয়। পাশাপাশি এলাকাকে ঘিরে দুই ভাগ করে দেওয়া হয় হিন্দু মুসলমানের মধ্যে প্রার্থনার জন্য। এরপর পরই শোন যায়, আওয়াধ অঞ্চলের বাবর-নিযুক্ত প্রশাসক মির বকশি অযোধ্যায় অবস্থিত প্রাচীন রামমন্দির ধ্বংস করে সেই মসজিদ নির্মাণ করেন। ব্যাস ঘৃতাহুতি আগুনে। জায়গা দখলের লড়াই যেন চলতেই থাকে। ১৯৪৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর আবার মসজিদের মধ্যে রাম সীতার মূর্তি স্থাপন করা নিয়ে উত্তেজনা তৈরি হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর নির্দেশে অপসারিত হয় মূর্তি। ১৯৮৬ সালে মসজিদের তালা খোলার পর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ একদিকে রামমন্দির নির্মাণ কমিটি গঠন করেন এবং মসজিদে প্রার্থনা করার অনুমতি চায়। অন্যদিকে মুসলমানরাও গড়ে তোলেন বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি। আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যায় সে জায়গা। অতঃপর সেই কলঙ্কিত ঘটনা। ১৯৮৯ সালে বিতর্কিত স্থানে ‘শিলান্যাস’ ঘিরে আগুন বাড়তে থাকে। এবং ঘনিয়ে আসে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর।

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর কেটে গেছে ৩০ বছর। সরযূ দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। বদলে গেছে সেদিনের অযোধ্যা। কড়া নিরাপত্তাকে স্বীকার করেই অযোধ্যাবাসী নিজেদের জীবন গুছিয়ে নিয়েছে ফের। উত্তেজনাও অনেকটা অস্তমিত। সুপ্রিম কোর্ট রায় একপ্রকার মীমাংসা করেছে ঠিকই কিন্তু সেই ১৮০০০ মানুষের প্রাণের হিসেব মেলেনি আজও। এই অন্ধকারের উৎস হতে আদৌ যে আলো মিলবে না সে কথা জানে গোটা দেশই।

More Articles