কৃষ্ণচন্দ্রই সনাতনীদের উদ্ধারকর্তা? কী বলছে ইতিহাস?
Siraj ud Daulah and Krishnachandra Roy: গত এক পক্ষকাল ধরে পলাশীর অন্যতম ষড়যন্ত্রী নদিয়ার জমিদার কৃষ্ণচন্দ্রের চরিত্র বঙ্গভূমে বিস্তর কাটাছেঁড়া চলছে।
ছোট ছোট তেলেঙ্গাগুলি লাল কুর্তি গায়।
হাঁটু গেড়ে মারে তীর মীর মদনের হায়।।
নবাব কান্দে সিপাহ কান্দে আর কান্দে হাতী।
কলকাতায় বসে কান্দে মোহনলালের পুতি।
দুধে ধোয়া কোম্পানির উড়িল নিশান।
মীরজাফরের দাগাবাজিতে গেল নবাবের প্রাণ।রজতকান্ত রায়ের পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ থেকে মোক্ষদারঞ্জন ভট্টাচার্য, ‘নিরক্ষর কবি ও গ্রাম্য কবিতা, সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ১৩, ১৯৩-২৩৬।
চক্রান্তের ২৬৭ বছর পর হঠাৎই রাজনৈতিক দলগুলোর ২০২৪-এর বঙ্গ-ভোট-সমরে পূর্ণরঙ্গে বঙ্গ বাজারে সমুজ্জ্বল আবির্ভাব ঘটেছে ‘পলাশী’-র। প্রত্যেক গোষ্ঠী নিজেদের তাথ্যিক-তাত্ত্বিক অবস্থানের পক্ষে ঝোল টানতে কোমর বেঁধেছে সোৎসাহে। উপনিবেশবিরোধী চর্চার অন্যতম কর্মী হিসেবে আমরা অবশ্যই দ্বৈত শাসন এবং তার কিছু পরেই লুঠেরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পত্তনের আগে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌল্লাপন্থী। এই প্রবন্ধের প্রথম অংশে আমরা দেখাব ইতিহাসবিদ সুশীল চৌধুরীর বয়ান। দ্বিতীয় অংশে দেখাব ভদ্রবিত্ত বাঙালি লেখকের কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের হিন্দু চরিত্র নির্মাণ।
মাথায় রাখতে হবে সুশীল চৌধুরী দক্ষিণ এশিয়া ইতিহাসচর্চার - আলিগড় বা বাম বা কেমব্রিজ বা শিকাগো বা প্যারিস বা ডাচ - শিবিরের গবেষক ছিলেন না। কলকাতায় সারাজীবন শিক্ষকতা করা মানুষটির আওরঙ্গজেব প্রয়াণের পরের সময়ের ৫০ বছরের নবাবি আমল নিয়ে অসামান্য দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছিল। তিনিই একমাত্র বঙ্গ ইতিহাসবিদ যিনি লন্ডন, প্যারিস আর ডাচ মহাফেজখানায় গবেষণা করেছেন। ফলে মুর্শিদকুলি খান থেকে সিরাজদ্দৌলা পর্যন্ত অর্ধশতাব্দকাল বাংলায় ব্যবসা করা তিনটে গুরুত্বপূর্ণ ইওরোপিয় কর্পোরেট কোম্পানি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আর ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা Vereenigde Oost-Indische Compagnie, ভিওসির ব্যবসা-রাজনীতির ককটেল পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জেনে বুঝে, নির্দিষ্ট শিবিরের পক্ষপাতী না হয়ে ‘ট্রেড অ্যান্ড কমার্শিয়াল অর্গানাইজেশন ইন বেঙ্গল’, ‘ফ্রম প্রস্পারিটি টু ডিক্লাইন, এইটিন্থ সেঞ্চুরি বেঙ্গল’ ‘রোড টু পলাশী’, ‘নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদ’, ‘পলাশীর অজানা কাহিনী’র মতো গ্রন্থ রচনা করতে পেরেছেন। উপনিবেশপূর্ব সময়ের নবাবি বাংলা নিয়ে যে সব অনৃত তথ্য বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী কেমব্রিজ ইতিহাস, কিছুটা আলিগড়ি আঙ্গিকের সুবাদে, তার বড় অংশ তিনি যুক্তি, তথ্য-তত্ত্ব দিয়ে খণ্ডন করেছেন। তাঁর সূত্রে আমরা দেখাব উপনিবেশিক ইতিহাস যে নিষ্ঠুর, লোলুপ, সিরাজ চরিত্র নির্মাণ করল, তার ভিত্তি কী ছিল?
নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদ গ্রন্থের পঞ্চম অধ্যায় ‘পলাশী’-তে সুশীল চৌধুরী লিখছেন, ‘স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে শুধু নয়, এস.সি.হিল (বেঙ্গল ইন ১৭৫৬-৫৭) থেকে শুরু করে অধুনা পিটার মার্শাল (ব্রিটিশ ব্রিজহেড), ক্রিস বেইলি (ইন্ডিয়ান সোসাইটি অ্যান্ড দ্য মেকিং অব ব্রিটিশ এম্পায়ার), রজতকান্ত রায় (কলোনিয়াল পেনিট্রেশন এবং পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ) প্রমুখের গ্রন্থেও সিরাজদ্দৌল্লা এবং পলাশীর ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব সম্বন্ধে কতগুলি বক্তব্য স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে দেখা যায়। কী কী? পলাশীর ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের বিশেষ কোনও ভূমিকা ছিল না; সিরাজদ্দৌল্লা এতই দুশ্চরিত্র, দুর্বিনীত ও নিষ্ঠুর ছিলেন যে তাতে রাজ্যের অমাত্যবর্গ শুধু নয়, সাধারণ মানুষও নবাবের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। তাই তাঁকে অপসারণ করতে মুর্শিদাবাদ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বদ্ধপরিকর হয় এবং এ কাজ সম্পন্ন করতে তারা ইংরেজদের সামরিক শক্তির সাহায্য পাওয়ার প্রত্যাশায় তাদের ডেকে আনে। তাই ইংরেজদের বাংলা বিজয় একটি ‘আকস্মিক’ ঘটনামাত্র, এর পেছনে তাদের কোনও ‘পূর্ব-পরিকল্পনা’ (মার্শালের ভাষায় ‘no calculated plottings’) ছিল না। মুর্শিদাবাদ দরবারে ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে তারা মাঠে নেমে পড়ে এবং নবাবের অমাত্যদের সঙ্গে সিরাজকে হঠিয়ে মীরজাফরকে নবাব করার পরিকল্পনায় সামিল হয়। …আবার পলাশির ব্যাখ্যা হিসেবে যুক্তি দেখানো হয়ে থাকে যে সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হয়ে তাঁর আচরণ ও ব্যবহারে প্রভাবশালী অমাত্যবর্গকে তাঁর প্রতি বিরূপ করে তোলার ফলে বাংলায় যে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ‘সংকট’ দেখা দেয়, তার পরিণতিই পলাশীর ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব। ইদানীং এও প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে যে প্রাক-পলাশী বাংলায় রাজনৈতিক সংকটের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক ‘সংকটও’। বিশেষ করে কে.এন.চৌধুরী (দ্য ট্রেডিং ওয়ার্ল্ড অব এশিয়া), পিটার মার্শাল (ব্রিটিশ ব্রিজহেড)] দেখা দিয়েছিল এবং এই ‘উভয় সংকট’ থেকে বাংলাকে উদ্ধার করার জন্যই যেন ইংরেজরা ‘অনিচ্ছা সত্ত্বেও’ বাংলা জয় করে (এ বিষয়ে পড়ুন সুশীলবাবুর প্রবন্ধ ‘Was there a crisis in mid-Eighteenth Century Bengal?’ পাবেন Richard B. Barnett-এর সম্পাদনায়, Rethinking Early Modern India-য়)। কোনও কোনও ঐতিহাসিক আবার ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের যাথার্থ্য প্রমাণ করতে গিয়ে প্রাক-পলাশী বাঙালি সমাজের এক দ্বিধাবিভক্ত চিত্রকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার প্রচেষ্টায় যত্নবান।
তিনি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, ‘আমাদের মূল বক্তব্য, পলাশীর ষড়যন্ত্র ও বিপ্লবে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল ইংরেজরাই, ভারতীয়রা নয়। ইংরেজরা বেশ পরিকল্পিতভাবেই একাজ সম্পন্ন করে এবং নানা প্রলোভন ও প্রচ্ছন্ন ভয় দেখিয়ে তারা মুর্শিদাবাদ দরবারের একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে তাদের পরিকল্পনায় সামিল করে। শুধু তাই নয়, পলাশীর যুদ্ধের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে যাতে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীরা সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনায় যুক্ত থাকে’।
পলাশী বিষয়ে এই মুখবন্ধটুকু রচনা করে আমরা সুশীল চৌধুরীর গবেষণা মারফৎ বুঝতে চেষ্টা করব কোন কোন সূত্র থেকে উপনিবেশ আজকের সিরাজকে তৈরি করেছে। সুশীল চৌধুরী 'পলাশীর অজানা কাহিনী'-তে বলছেন
'সিরাজদ্দৌল্লা সত্যি সত্যিই ভিলেনজাতীয় নিকৃষ্ট জীব ছিলেন কিনা তা বিচার করার আগে যাঁরা তাঁর সম্বন্ধে এ অভিযোগ করেছেন তাঁদের সম্যক পরিচয় জানা একান্ত প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার বেশিরভাগ ফারসি ইতিহাসই পলাশীর প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ বছর পরে লেখা, যখন ওই ঘটনাবলী সম্বন্ধে উক্ত লেখকদের স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো ফারসি ইতিহাসের বেশিরভাগই লেখা হয়েছিল লেখকদের ইংরেজ প্রভু বা মনিবদের আদেশে বা তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় – নতুন আমলে নতুন বয়ান তৈরি করতে। তাই এগুলিকে সে যুগের ঐতিহাসিক তথ্যের প্রকৃত সূত্র হিসেবে গণ্য করা যায় কিনা তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ থেকে যায়। সিরাজদ্দৌল্লাকে 'ভিলেন' বা দুর্বৃত্ত প্রমাণ করা গেলে ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের যথার্থ প্রমাণ করা সহজ হয় অর্থাৎ সেক্ষেত্রে বলা যায় যে ইংরেজরা বাংলা জয় করে এক স্বেচ্ছাচারীর হাত থেকে বাংলাকে রক্ষা করেছে। এতে ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা মিলবে। ফলে পলাশী ষড়যন্ত্র করা সত্ত্বেও ইংরেজদের ভূমিকা ততটা নিন্দনীয় হবে না।'
সিয়রেমুতক্ষিণের লেখক গোলাম হোসেন খান ছিলেন সিরাজদ্দৌল্লার দাদু, বাংলার নবাব আলিবর্দি খানের প্রাসাদের চাকর, হাজি বা প্রাসাদ সরকার, চরমতম ইংরেজ-ভক্ত, আরও বেশি সিরাজদ্দৌল্লা-বিরোধী। মাঝেমধ্যেই নবাব এবং ছোটে নবাব সিরাজের সঙ্গে গোলাম হোসেনের খিটিমিটি লাগত ইংরেজ কর্পোরেটদের দুর্নীতি, দুষ্কর্মের পক্ষ নেওয়ার ঘটনায়। হুমকিতে কাজ না হওয়ায় চাকরি খোয়ালেন গোলাম হোসেন। রাষ্ট্র বিরোধিতার দায়ে তাঁকে প্রাণে না মেরে বাংলা থেকে দূর করে দেওয়া হলো। তিনিই যেই ব্যক্তি, যিনি পূর্ণিয়ার শাসক, আলীবর্দী খানের নাতি, সিরাজের খুড়তুতো ভাই শওকত জঙ্গকে খবর দিয়েছিলেন ইংরেজরা সিরাজকে সিংহাসন থেকে সরাতে উৎসুক, নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার কাজে তিনি ইংরেজদের সঙ্গী হন। ‘সাধু’ ইংরেজদের সঙ্গে অত্যাচারী সিরাজ উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে বিবাদ তৈরি করছে, এই তত্ত্ব গোলাম হোসেন খানের।
ইংরেজ সম্বন্ধে তার মত হলো 'এই জাতির (ইংরেজ)... শক্তি, সাহস ও মনোবলের তুলনা হয় না', 'এই জাতির সেনাপতিরা অত্যন্ত দক্ষ, সতর্ক ও সব ব্যাপারে অভিজ্ঞ এবং যুদ্ধক্ষেত্রে এরা অসম সাহসী', 'এই জাতি কোনও সঙ্গত কারণ ছাড়া কারও সঙ্গে বিরোধ বাধায় না’ ইত্যাদি। আলিনগরের [কলকাতার] চুক্তি ভেঙে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইংরেজদের ছাড় দিয়ে লেখেন, ‘...সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ কারণে নবাবের সঙ্গে বিরোধ করা ছাড়া তাদের কোনও উপায় ছিল না। ...অবশ্য এ বিষয়ে আমার কাছে উপযুক্ত তথ্য নেই তবে মনে হয় সম্ভবত নবাব (শর্ত অনুযায়ী) টাকা পয়সা দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন এবং অকারণ দেরি করছিলেন।' ১৭৫৬-য় পূর্ণিয়ায় বিদ্রোহী শওকত জঙ্গয়ের বিরুদ্ধে জিতে সিরাজ মোহনলালকে নির্দেশ দিলেন প্রাণে না মেরে গোলাম হোসেন আর পরিবারের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে। সিরাজের আশীর্বাদে গোলাম হোসেন বেনারসেও মামা আর ভাইদের সঙ্গে যোগ দিলেন। সেই অকৃতজ্ঞ গোলাম হোসেন সিরাজকে ধন্যবাদ জানানো তো দূরস্থান, লিখলেন বাংলা অত্যাচারী নবাবের হাত থেকে মুক্তি পেল। তিনিই লিখেছিলেন সিরাজ নাকি জগৎশেঠকে সুন্নত করার হুমকি দিয়েছিলেন। এই বক্তব্যের পক্ষে তিনি একটাও প্রমাণ দেননি।
এবারে আরেক গোলাম হোসেন, ইংরেজ মনিব উডনির কর্মচারী, রিয়াজুসসালাতিনের লেখক, উপাধি সালিম। মনিবের নির্দেশে ‘এই অধম ব্যক্তি' রিয়াজুসসালাতিন রচনা করার প্রেরণা পেলেন ১৭৮৬-তে পলাশীর প্রায় তিন দশক পরে। আমাদের আলোচ্য দু'নম্বর গোলাম হোসেন যে জীবিকার্জনে স্পষ্ট ইংরেজ অনুরক্ত হতে বাধ্য হয়েছেন একথা বলার প্রয়োজন নিশ্চয়ই হয় না। তিনি ইংরেজদের চাটুকারিতা করে লিখলেন, 'তারা (ইংরেজরা) কোনও প্রতিশ্রুতি দিলে তা রক্ষা করতে এমনই বদ্ধ পরিকর হয় যে নিজেদের প্রাণসংশয় করেও তাতে অবিচল থাকে। মিথ্যাবাদীকে তারা সমাজে বরদাস্ত করে না। তারা উদার, বিশ্বস্ত, সহনশীল ও সম্মানিত ব্যক্তি। প্রতারণা কাকে বলে তারা জানে না। শঠতা ব্যাপারটাই তাদের কাছে অজানা।' সিরাজ চরিত্র বিষয়ে স্বাভাবিকভাবেই বিমুখ – তাঁর ভাষায় সিরাজ ছিলেন বদমেজাজি এবং রূঢ়ভাষী, অভিজাত আর সেনাপতিদের বিদ্রুপ করতেন।
সব শেষে মুজফফরনামার রচয়িতা করম আলি। ১৭৭২-এ লেখা। তিনিও ইংরজপক্ষীয়। ঘোড়াঘাটার ফৌজদার হলেও অধিকাংশ সময় সিরাজের চাচাতোভাই শওকত জঙ্গের সঙ্গে পূর্ণিয়াতে সিরাজ বিরোধী চক্রান্তে সামিল হন। শওকত জঙ্গের পতন হলে ঘোড়াঘাটার ফৌজদারি হারালেন এবং কারাগার বন্দি হলেন। সিরাজ বিরোধী চক্রান্তের পুরষ্কার হিসেবে গোলাম আলির মত প্রাণে না মেরে, নবাব তাকে পটনায় নির্বাসন দিলেন।
বিশদে লেখার এখানে অবকাশ নেই, উৎসাহীরা সুশীল চৌধুরীর বইটা আরও বিশদের জন্য পড়ে নিতে পারেন। কিন্তু সুশীলবাবুই হাতেগোনা ইতিহাসকারদের মধ্যে অন্যতম, যিনি সিরাজকে ইতিহাসের মিথ থেকে বের করে রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে উপস্থিত করেন।
২
এবার বঙ্গ ভদ্রবিত্ত মনোজগতবাসী মহারাজা উপাধির হিন্দুকুলতিলক কৃষ্ণচন্দ্র আখ্যান।
গত এক পক্ষকাল ধরে পলাশীর অন্যতম ষড়যন্ত্রী নদিয়ার জমিদার কৃষ্ণচন্দ্রের চরিত্র বঙ্গভূমে বিস্তর কাটাছেঁড়া চলছে। দু’তিনজন স্যাঙাৎ বাদে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলারা পলাশী ষড়যন্ত্রের সঙ্গীদের মধ্যে কাউকে খুন করেছে, কাউকে কারাগারে বন্দি করেছে কারও জমিদারি কেড়ে প্রায় পথের ভিখারি করেছেন। কৃষ্ণচন্দ্র আখ্যান শুরু করব রজতকান্ত রায়ের ‘পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ’ থেকে,
‘সে যুগের আদর্শ মানব বলতে এখনকার লোকে নিশ্চই তাঁর [কৃষ্ণচন্দ্রের] কথা স্মরণ করবে না – রাণী ভবানী, হাজি মহম্মদ মহসিন বা সাধক রামপ্রসাদের কথা ভাববে। কিন্তু নানা দিক থেকে এই বিদ্যানুরাগী কবিগুণগ্রাহী দেবদ্বিজপণ্ডিত প্রতিপালক রাজা গোটা সমাজের উপর তার ধূর্ত বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার ছাপ রেখে গেছিলেন। ...খাজনার দায়ে নবাব আলিবর্দি খান নদীয়ার জমিদারকে যে মুর্শিদাবাদে আটক করে রেখেছিলেন তা ভারতচন্দ্র বিলক্ষণ অবগত ছিলেন, অথচ নিজের প্রভুকে ‘স্ফুরদ্বীর্য’ ‘সূর্যোল্লসৎ’ ‘মহারাজ রাজাধিরাজ প্রতাপ’রূপে অভিহিত করতে কবির কোনো দ্বিধা হয়নি... বস্তুতপক্ষে নবাব সরকারের দৃষ্টিকোণ থেকে যে লোক দেওয়ানীর সনদ দ্বারা নিযুক্ত খিদমৎকারি জমিদার মাত্র, সেই একই লোক দেশবাসী প্রজাদের দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বশক্তিমান মহারাজ হওয়ায়, কবি ভারতচন্দ্রের বা অন্যান্য সমসাময়িক লোকের চোখে এ দুয়ের মধ্যে কোনও বৈসাদৃশ্য ছিল না’।
চরিত্র ধরেও টান দিতে বাকি রাখেননি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যপন্থী কেমব্রিজ আঙ্গিকের রজতকান্ত রায়, ‘…লম্পট এবং নানারকম কুরুচিপূর্ণ আমোদ প্রমোদের প্রবর্তক বলেও তাঁর একটা অথ্যাতি ছিল। রাজা হবার পর তিনি আর একটি বিয়ে করেছিলেন৷ সে সম্বদ্ধে প্রচলিত গল্পটিতেও তাঁর চরিত্রের আর একটি দিক সম্বন্ধে লোকের ধারণার কিছু কিছু পরিচয় মেলে| একদিন রাজা নৌকা করে বেড়াতে যাচ্ছেন এমন সময় নৌকারীর ঘাটে একটি ব্রাহ্মণের মেয়েকে জলক্রীড়া করতে দেখে তাঁর অঙ্গসৌষ্ঠবে আবিষ্ট হয়ে মেয়ের বাপকে ডাকলেন৷ বাপ উচ্চ ঘরের কুলীন রাজার বংশমর্যাদা সে তুলনায় অনেক খাটো। কিন্তু সে আপাত্তি টিকল না। বিয়ে করে মেয়েটিকে রাজবাটিতে এনে গর্বিত রাজা বললেন, 'দেখ, এখানে এসে তুমি রূপার পালঙ্কে শুতে পারলে।' সেই কুলীন কন্যা তখনই দৃপ্ত সুরে উত্তর দিলেন, আর একটু উত্তরে গেলে সোনার খাটে শুতে পারতাম।' আর একটু উত্তর বলতে মুর্শিদাবাদের নবাবি অন্তঃপুরের তাৎপর্য গ্রহণ করে রাজা তেজস্বিনী স্ত্রীর উপর বড়ই সন্তুষ্ট ভাব প্রদর্শন করলেন৷
আগেই বলেছি রজতকান্ত রায় কেমব্রিজ ইতিহাস আঙ্গিক অনুগামী, তিনি পলাশী চক্রান্তে ইংরেজের দায়মুক্তি ঘটিয়েছিলেন, যার বিপরীত বয়ান আমরা সুশীল চৌধুরীর বয়ানে দেখেছি। দু'টি উদাহরণেই রজতকান্ত ‘নদের জমিদার’ কৃষ্ণচন্দ্র চরিত্র নির্মাণে ভয়ঙ্কর নির্মম, কটুভাষিতায় চূড়ান্ত। উপনিবেশিক কোলাবরেটরদের সহায়তায় ভদ্রবিত্ত বঙ্গভূমে দোর্দণ্ডপ্রতাপ মহারাজা নামে খ্যাত ‘দেওয়ানীর সনদ দ্বারা নিযুক্ত খিদমৎকারি জমিদার’ কৃষ্ণচন্দ্র ‘সর্বশক্তিমান মহারাজ’ বনলেন এবং যবনদের হাত থেকে বঙ্গ হিন্দু উদ্ধারের নায়ক হলেন, তার জনপ্রিয়তম কিন্তু চরমতম অনৈতিহাসিক আখ্যান আমরা দেখব ১৩২৪-এ প্রকাশিত আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘জীবনী-সন্দর্ভ, বঙ্গের কর্মবীরগণের জীবনীসংগ্ৰহ (চরিত্রগঠনোপোযোগী প্রথম পুস্তক’ প্রকাশক আড্ডি অ্যান্ড কোম্পানি বুকসেলার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স) থেকে। মাথায় রাখতে হবে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বইটির আদর্শ আরেকটি অনৈহাসিক ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আমলের প্রথম দিককার চাটুপটু বই ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে উইলিয়ম কেরীর সহকারী লেখকদের অন্যতম রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়ের ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং’।
‘জীবনী-সন্দর্ভ - বঙ্গের কর্মবীরদের জীবনীসংগ্রহ’তে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁর পূর্ববসূরী রাজীবলোচনের অনুকরণে কোমর বেঁধে সিরাজদ্দৌল্লাকে খলনায়ক আর কৃষ্ণচন্দ্রকে ব্রিটিশ অনুগামী রূপে দেখালেন, ‘এইরূপে সিরাজ দুশ্চরিত্রতা ও নিষ্ঠুরতা নিবন্ধন শীঘ্রই লোকের অপ্রিয় হইয়া উঠিলেন এবং তাহার পদচ্যুত করিবার অবসর সকলেই অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। ক্রমে এক ষড়যন্ত্রের আয়োজন হইল। তখন কোষাধ্যক্ষ জগৎশেঠ উদ্যোগী হইয়া, তাহার বাটীতে মন্ত্রী রায় দুর্লভ (রাজা মহেন্দ্র) রাজা রামনারায়ণ, রাজা কৃষ্ণদাস ও তাহার পিতা রাজা রাজাবল্লভ, সেনাপতি মীরজাফর, মীরমদন, উমীচাঁদ, খোজা বাজীদ প্রভৃতিকে লইয়া দুর্দান্ত নবারের উৎপীড়নের প্রতিবিধান করিবার, পরামর্শ করিতে লাগিলেন’। যে বড় জমিদারদের ঘাড় ধরে আলিবর্দি বর্গি ঠ্যাঙ্গানোর বড় পরিমাণ আর্থিক সাহায্য উদ্ধার করলেন, তাদের মধ্যে হিন্দু বাঙালি ভদ্রবিত্তের দোর্দণ্ডপ্রতাপ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র অন্যতম, তাছাড়া ছিলেন দিনাজপুর আর রাজশাহীর জমিদারও।'
এখানেই হেনস্থার শেষ নয়। ১৭৪২-এ খাজনা অনাদায়ে মুর্শিদাবাদে বেশ কিছু দিন আটক ছিলেন। রজতকান্ত লিখছেন ১২ লক্ষ টাকা বকেয়া জমা দেওয়ার মুচলেকা দিয়েই তিনি ছাড়া পান ‘লিখি দিলা সেই রাজা দিব বার লক্ষ’। এই বিপুল অর্থ জোগাড় করলেন নদিয়া জমিদারের দেওয়ান রঘুনন্দন মিত্র। বর্গির হ্যাঙ্গাম শেষেও রক্ষা নেই। আবারও জেল খাটলেন ‘মহারাজা’ কৃষ্ণচন্দ্র। শোনা যায় হাত জোড় করে নবাবের জমিদারির দুরবস্থা বর্ণনা করে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে কৃষ্ণনগর থেকে দূরে শিবনিবাসে রাজধানী তৈরি করেন।
এই ঘটনার ২০০ বছর আগে ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে নায়ক ব্যাধ কালকেতুর শহর পত্তনের বর্ণনা দেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। সুলতানি আমলা ডিহিদার মামুদ শরীফের অত্যাচারে সাতপুরুষের ভিটে থেকে উচ্ছেদ হতে বাধ্য হলেও তিনি নতুন গুজরাত শহরে মুসলমান সমাজের জন্য উপযুক্ত চাষের জমি, হাল, সসম্মানে আলাদা বসত অঞ্চলও নায়কের ভাত দিয়ে বরাদ্দ করছেন। উপনিবেশপূর্ব সময়ে মুসলমান সমাজের অসামান্য বিশ্বস্ত বর্ণনা কবিকঙ্কণেই পাই। অথচ ব্রিটিশ রাজত্বে রাজীবলোচন সরাসরি হিন্দু আধিপত্যময় শিবনিবাস শহরের বর্ণনায় মুসলমান সমাজের বসতির উল্লেখ পাই না। রজতকান্ত রায় কৌতুকভরে লিখছেন শহর পত্তনের ১০০ বছর পর ১৮৪৬এ বিশপ হেবার শিবনিবাসে এসে কতগুলো জঙ্গলে ভরা দালান ছাড়া আর কিছুই দেখেননি।
আশুতোষ, কৃষ্ণচন্দ্রের দু'বার জেলখাটা ভুলে, তাঁকে নায়ক বানাতে প্রখ্যাত অভিজাতদের দিয়ে কৃষ্ণচন্দ্রের পরামর্শ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। লেখক কৃষ্ণচন্দ্রকে মুর্শিদাবাদের বৈঠকে আনালেন। কিন্তু একজোট হওয়া হিন্দু বীররা ‘সিরাজের ক্রোধানলে আমাদের প্রাণদণ্ডর ভয়ে নবাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের উদ্যোগ নিতে পিছুপা। লেখক কী করেন? হিন্দু বীরদের বীরত্বের মাত্রা যাই হোক না কেন, তাদের যবনমুক্ত বাংলা ঘটাতেই হবে। অথৈ জলে পড়া জগৎ শেঠ, রাজবল্লভ, রাজা মহেন্দ্র ‘…কহিলেন, …এক্ষণে যবন কর্তৃত্বাধীন হিন্দু জাতির নিরাপদে বাস করা অসম্ভব হইয়া দাঁড়াইয়াছে, যাহাতে আর যবনের অধীন না থাকিতে হয় ইহারই মন্ত্রণা করা কর্তব্য। এই প্রস্তাবে কেহ অনুমোদন কেহ বা প্রতিবাদ করিতে লাগিলেন, কিন্তু কিছুই স্থির সিদ্ধান্ত হইল না’। আমরা পরের স্তবকে দেখাব এই মুসলমানবিদ্বেষের ইতিহাস সুলতানি আমলের। তখন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কহিলেন ‘যে সভায় মীরজাফর একজন প্রধান সভ্য ও জাতিতে যবন অথচ আপনারা যবনাধিকার নিরাকৃত করিতে চাহেন, সেস্থানে আমি আর কি কহিব?’ ইহাতে সকলেই বলিয়া উঠিলেন ‘মীরজাফর অতি উদার প্রকৃতির লোক, ইহাকে অবিশ্বাস করিবেন না’।
ঠিক হল মীরজাফর গুড মুসলিমের ভূমিকা পালন করে ব্যাড মুসলমান সিরাজের পতন ঘটাবেন। হিন্দু বীর অভিজাতরা, যাদের উত্তর প্রজন্ম ১৯২৫-এ রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ তৈরি করবেন, আপন জীবন রক্ষায়, স্বার্থসিদ্ধিতে গুড মুসলিমের ছায়ার পিছনে লুকোলেন। সিরাজ বধের মঞ্চ তৈরি হল ব্রিটিশ আমলের লেখকের মুসলমানফোবিয়া তৈরি করে, যে ফোবিয়া আমরা লক্ষ্য করি কৃষ্ণচন্দ্র ক্রিয়াশীল থাকার ২০০ বছর আগে। বর্তমান লেখক অত্রি ভট্টাচার্যের সঙ্গে মিলে জ্ঞানগঞ্জের পক্ষে বাংলা সাহিত্যে মুসলমানফোবিয়া খুঁজেছেন গত বছরের অগাস্টে প্রকাশিত ‘টডের তরবারি : ভদ্রবিত্তের ইসলাম বিদ্বেষ ও রাজপুত-পৌরুষের খোঁজে’ চটি বইতে। বলা হয়েছে ‘... আমপাবলিকের ধারণা, দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলমান বিদ্বেষের বয়স সঙ্ঘ পরিবারের বয়সের কাছাকাছি। ইতিহাস বোধহয় অন্য কথা বলে। মুসলমান ভয়ঙ্কর, ‘গোব্রাহ্মণদ্রোহী' মুসলমানের অধীনে চাকরি করা পাপের ধারণা সাভারকর-গোলওয়ালকদের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ আর স্যাঙাৎদের চালানো উপনিবেশিক প্রকল্পের থেকেও পুরোনো, বঙ্গভূমে এই ভদ্রবিত্তিয় ধারণার বয়স ৫০০ পার। ‘চৈতান্যচরিতামৃত' কাব্যে কৃষ্ণদাস কবিরাজ শ্রীচৈতন্যকে সাক্ষী মেনে দুই গোস্বামী ভাই রূপ, সনাতনের উদ্ধৃতি লিখছেন, 'ম্লেচ্ছ জাতি ম্লেচ্ছ সঙ্গী করি ম্লেচ্ছ কাম।/গোব্রাহ্মণদ্রোহী সঙ্গে আমার সঙ্গম।’ লেখক কার্যত মুসলমান সমাজকে শহরে ডেকে এনে সসম্মানে ঠাঁই দেওয়ার কাজে অগ্রণী ব্যাধ কালকেতু নয়, কৃষ্ণচন্দ্রকে উপস্থাপন করেছেন সবর্ণ, এলিট রূপ-সনাতন গোস্বামীর উত্তরাধিকারী হিসেবে যারা সিরাজের মতো ‘গোব্রাহ্মণদ্রোহী’ মুসলমানের সঙ্গে একসঙ্গে থাকতে সমস্যা বোধ করে।
‘তখন কৃষ্ণচন্দ্র বলিলেন যদি আমার মতামত জানিতে চাহেন তাহা হইলে শ্রবণ করুন। যবন আধিপত্যে আমাদিগের নিরাপদে বাস করা একপ্রকার অসম্ভব এবং হিন্দু রাজা হইবারও কোন সম্ভাবনা নাই, কারণ সকলেই শক্তিহীন। এ স্থলে যদি মীরজাফর সহায়তা করেন তাহা হইলে আমার জমিদারির মধ্যে কলিকাতার যে সকল ইংরাজ বণিক বাস করেন, তাহারা মনে করিলে এ দেশ রক্ষা করিতে পারেন। আমি তাহাদের রীতি, নীতি, স্বভাব, চরিত্র, উত্তমরূপে অবগত আছি। তাহারা যেমন পরাক্রান্ত ও সাহসী, তেমনি বুদ্ধিমান ও বিশ্বস্ত। যদি ইংরাজ রাজা হন তাহা হইলে দেশের মঙ্গল, ইংরাজ নাম মাত্র রাজা থাকিবেন এবং মীরজাফরই নবাব হইবেন। এইরূপ হইলে, আমাদের সুখ শান্তিতে কালযাপন হইবে। যদি আপনাদের ইহাতে মত হয় তাহা হইলে আমি ইংরাজদের নিকট এবিষয় প্রস্তাব করি.....’। মীরজাফরও নবাবি পদ প্রাপ্ত হইবার আশায় কৃষ্ণচন্দ্রের প্রস্তাবে সম্মত হইলেন । তখন সকলেই কৃষ্ণচন্দ্রের প্রস্তাব শিরোধার্য করিলেন। সভাভঙ্গ হইলে অভিবাদন প্রত্যভিবাদনান্তর রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সকলের নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া শিবনিবাসে প্রত্যাগমন করিলেন.....’ ইত্যাদি। …অনন্তর রাজা কৃষ্ণচন্দ্র পাত্র মিত্র সঙ্গে লইয়া কালীঘাটে আসিয়া জগজ্জননী মা কালিকা দেবীর অর্চনা করিলেন। তৎপরে কলিকাতার বড় সাহেবের কুটীতে একজন বিশ্বস্ত দূত দ্বারা সংবাদ পাঠাইয়া পশ্চাৎ আপনি গমন করিলেন। তখন কুঠির অধ্যক্ষ ড্রেক সাহেব ছিলেন। তিনি মহারাজকে মহা সম্বর্ধনা করিয়া সিংহাসনে বসাইয়া তাহার যথেষ্ট অভ্যর্থনা করিলেন। রাজ ও সাহেব দুইজনে বসিয়া পরস্পর কুশলাদি প্রশ্ন করিয়া নানা কথাবার্তা কহিতে লাগিলেন। তৎপরে সিরাজুদ্দৌলার অত্যাচারের কথা ও ষড়যন্ত্রের বিষয় অবগত করাইয়া বলিলেন আপনারা এদেশ জয় করিয়া সকলকার জাতি, ধর্ম ও জীবন রক্ষা করুন। জগৎশেঠ, রাজ মহেন্দ্র, রাজা রাজবল্লভ প্রভৃতি নবাবের প্রধান প্রধান পাত্র, মিত্রগণ এই বিষয়ের জন্য উদ্যোগী হইয়া আপনার নিকট আমাকে প্রেরণ করিয়াছেন। আমাদের সকলকার ইচ্ছা, ইংরাজ রাজা হইয়া এ হতভাগ্য দেশে শান্তি স্থাপনা করেন’। ড্রেক সাহেব অতি বিচক্ষণ বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী ইংরাজ ছিলেন। তিনি কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন ‘মহারাজ! আপনি আমাকে দুই তিন মাস সময় দিউন্, আমি বিলাতে পত্র লিখি, সেখান হইতে আদেশ আনাইয়া পশ্চাৎ কার্য্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইব। আপনি রাজা মহেন্দ্র প্রভৃতি পাত্র মিত্রগণকে আশ্বাস প্রদান করিয়া নিশ্চিন্ত থাকুন। শীঘ্রই ইহার প্রতিকার করিব।” তখন কৃষ্ণচন্দ্র আশ্বস্ত হইয়া শিবনিবাসে প্রত্যাগমন করিলেন।..."
কিন্তু পলাশীর পরে কৃষ্ণচন্দ্রের হাল কী হল? চক্রান্তে জিতে পাশ্চাত্য সভ্যতার অভ্যেসে ইংরেজরা ষড়যন্ত্রী কৃষ্ণচন্দ্রের সহযোগিতা ভুললেন। ইংরেজদের তিন কোটি টাকার খাঁই মেটানোর ঘা পড়ল কৃষ্ণচন্দ্রের ঘাড়ে। নতুন নবাব লিখেদিলেন কৃষ্ণচন্দ্রের নদিয়ার জমিদারির খাজনার টাকা মুর্শিদাবাদে না এসে সরাসরি কলকাতা যাবে। একদা সনাতন হিন্দু সমাজের জ্যাঠামশাই, কৃষ্ণচন্দ্রকে নানান প্রকার উৎপীড়ন করল ইংরেজরা। বহু মানুষের, সমাজের জাতিনাশ করে বিখ্যত হয়েছিলেন যিনি, তারই তৈরি জাতিনাশের হুমকিকে হাতিয়ার করেই তার জাতিনাশের ভয়ও দেখাল ইংরেজরা। তিনি সর্বস্বান্ত হয়ে পড়লেন। তার বংশধরেরা আর জমিদারি রক্ষা করতে পারল না। সূর্যাস্ত আইনে সব নিলাম হলো।
টিকা
তেলেঙ্গারা হলো ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাদ্রাজি বাহিনী। সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ যাত্রা করে যে ক'টা ব্রিটিশ জাহাজ মাদ্রাজে অপেক্ষা করছিল, সেই জাহাজে প্রচুর দক্ষিণী সেনা বাংলায় আসে। তারাই স্থানীয় ভাষায় তেলেঙ্গা। আর একটা কথা, পলাশীর তিন মাস আগে ক্লাইভ চন্দননগর ধ্বংস করে, লুঠ করে, সিরাজ ফরাসিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার যে দায়িত্ব নন্দকুমারকে দিয়েছিলেন, নন্দকুমার সেটি পালন করেননি। এই দুই ঘটনা পলাশী চক্রান্তে বিপুল প্রভাব ফেলেছিল, এ বিষয়ে ইতিহাস প্রায় চুপ। কয়েকজন ঐতিহাসিকের বক্তব্য সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, যার অন্যতম ফল পলাশী। পলাশী হলো হাজার হাজার বছর ধরে ইওরোপ যে এশিয় আফ্রিকিয় আমেরিকিয় ট্রেড ইমব্যালেস তাদের দিকে ঢলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল, সেই আলেকজান্ডারের আমল থেকেই, সেই কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল প্রত্যেক ক্যাথলিক প্রটেস্টান্ট দেশ; তো সেই দীর্ঘ প্রচেষ্টার সফল ফল ফলল পলাশীতে। তারপর আর বিশ্ব আগের মতো রইল না - চিরতরে পাল্টে গেল। কর্পোরেট পুঁজিবাদী বিশ্ব তৈরি এবং সেটিকে লুঠ চালিয়ে আজ পর্যন্ত লাভের আর্থ-রাজনীতিতে পরিণত করার প্রাচীন বিন্দু হলো পলাশী।