ইতিহাস ও ইতিহাসচর্চার আলোকে পলাশীর যুদ্ধ ও সিরাজদ্দৌলা  

Siraj ud-Daulah: পলাশী যুদ্ধের কারণের সঙ্গে সিরাজের চরিত্র নিয়েও ঐতিহাসিক-গবেষক মহলে তর্কবিতর্ক প্রচুর। আসুন দেখা যাক সেই তর্কবিতর্কের কিছু ঝলক।

ইতিহাস আমাদের সঙ্গেই থাকে বা আমরা ইতিহাসের সঙ্গে থাকি, তবু বারবার ইতিহাসের দিকে ফিরে-ফিরে তাকাতে হয়। এই সময়-পরিস্থিতি-দায়বদ্ধতা মাঝে-মাঝে আসে, আর তখন ঐতিহাসিক-গবেষককে এগিয়ে আসতে হয়। সকলেই যেমন কবি নয় কেউ কেউ কবি; তেমনই ইতিহাসচর্চা সকলেই করতে চাইলে বা করলেও সকলেই ঐতিহাসিক-গবেষক নন। অন্যান্য বিদ্যাশৃঙ্খলার মত ‘ইতিহাস’ বিষয়টাও (যেমন অর্থনীতি, ফিজিক্স, ডাক্তারি প্রভৃতির মত) একটি পদ্ধতি-শৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। তবেই ঐতিহাসিক-গবেষক তৈরি হন এবং মান্যতা অর্জন করেন। তাই ইতিহাসের পাঠটা মোটেই সহজ কাজ নয়। কেননা তথ্য, তত্ত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গির মিশেলে ইতিহাসের ব্যাখ্যা পাল্টে যায়, নতুনত্ব পেয়ে যায়। ইতিহাস হল ‘ইন্টারপ্রিটেটিভ সাবজেক্ট’, ইন্টারপ্রিটেশনই সাবজেক্টির সজীবতা, গতিশীলতা। আবার এর জন্য সাবজেক্টটিকে নিয়ে এত বিতর্ক-দ্বন্দ্ব-রাজনীতি-বিভ্রম।  সেজন্য পাঠককেও স্থির করে নিতে হয় তার অবস্থান, নইলে সে দেখতে পায় সে অরণ্য হারিয়ে যাচ্ছে বৃক্ষের ভিড়ে।

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন সুবাহ্ বাংলার পলাশীর প্রান্তরে যে ঘটনাটি ঘটেছিল সেটি যুদ্ধ নাকি প্রহসন নাকি ষড়যন্ত্র নাকি আরও অনেক কিছু তা নিয়ে যেমন তর্ক আছে তেমনই তার তাৎপর্যও অনেক গভীর যা তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা যায়নি, সময় যত এগিয়েছে গবেষণা যত গভীর হয়েছে, নতুন উপাদান যত আবিষ্কার হয়েছে ও তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মিত হয়েছে, পলাশী যুদ্ধের আলোচনা-ইতিহাস-তর্ক-প্রতর্ক তত গভীর ও বিস্তৃত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে হয়েছে পলাশী যুদ্ধের বিভিন্ন নায়ক: ক্লাইভ-মীরজাফর-জগত শেঠ এবং সর্বোপরি সিরাজকে নিয়ে বিভিন্নভাবে আলোচনা-পর্যালোচনা-বিতর্ক। সবচেয়ে বেশি কাটাছেঁড়া হয়েছে সিরাজকে নিয়ে। সিরাজ নায়ক না খলনায়ক না মহনায়ক তা নিয়ে বিতর্ক সমসময় থেকে আজও বিদ্যমান (খুব সম্প্রতি এই বিতর্কটি বিভিন্ন কারণে আবার জেগে উঠেছে) তিনি ইতিহাসের বিভিন্ন সন্ধিক্ষণে বিভিন্ন অভিধায় ভূষিত হয়েছেন, যেমন: অপদার্থ, রাগী, লম্পট, অর্থলোভী, উগ্র স্বভাবের, অকারণে ইংরেজ বিদ্বেষী ইত্যাদি, ফলে পলাশী যুদ্ধের কারণের সঙ্গে সিরাজের চরিত্র নিয়েও ঐতিহাসিক-গবেষক মহলে তর্কবিতর্ক প্রচুর। আসুন দেখা যাক সেই তর্কবিতর্কের কিছু ঝলক।

ভারতবর্ষে ‘ইতিহাস’ নামক বিদ্যাশৃঙ্খলাটির চর্চা প্রাচীন ও মধ্যযুগে হয়নি; হয়েছে আধুনিক যুগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে তাদের হাত ধরে। প্রাচীন যুগে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, ভরতের নাট্যশাস্ত্র থেকে শুরু করে অসংখ্য মূল্যবান জ্ঞানচর্চা বিষয়ক গ্রন্থ রচিত হলেও ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ রচিত হয়নি। মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকা (খ্রি.পূর্ব. তৃতীয় শতক) বা আল-বেরুনি রচিত কিতাব আল-হিন্দ(একাদশ খ্রি.) প্রভৃতি গ্রন্থ ঠিক ইতিহাস গ্রন্থ নয়, ইতিহাসের উপাদান, এখানে ট্র‍্যাভেলগ। দ্বাদশ শতকে কলহন রচিত রাজতরঙ্গিনী-কে কোনো কোনো ঐতিহাসিক প্রথম ইতিহাস গ্রন্থের মর্যাদা দিতে চাইলেও সেটিও ইতিহাস গ্রন্থ নয়, ‘ক্রনিক্যল’ মাত্র। ফলে প্রাচীন ও মধ্যযুগ জুড়ে অসংখ্য ট্র‍্যাভেলগ,ক্রনিক্যল, মেমরিজ, আখ্যান লেখা হলেও ‘ইতিহাস’ নামক বিদ্যাশৃঙ্খলার চর্চা আধুনিক যুগে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের স্বার্থে তাদের হাতেই ঘটে। জেমস মিল (১৮১৭)  রচিত গ্রন্থ প্রথম ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনার প্রয়াস। তারপর জাতীয়তাবাদী, কেমব্রিজ-অক্সফোর্ড, মার্কসবাদী, লিবারেল, সাবলটার্ন, পোস্টমডার্ন প্রভৃতি বিভিন্ন ঘরানার ইতিহাসবিদ ভারতবর্ষের ইতিহাস চর্চা করে চলেছেন। বর্তমানে ব্রিটিশ চলে গেলেও সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাসচর্চার প্রয়োজন না হলেও নয়া-সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাসচর্চার ঝোঁক বেড়েছে। ‘ইতিহাস’ নিয়ে এই বিভিন্ন ঘারানার ইতিহাস রচনাকেই ‘ইতিহাসচর্চা’ (Historiography) বলা হয় অর্থাৎ Historiography  হল History of History, ইতিহাসের ইতিহাস। বর্তমানে তাই আমাদের কাছে কোনো বিষয়ের ইতিহাস আলোচনার চেয়ে তার ‘ইতিহাসচর্চা’-র আলোচনা যেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

পলাশীর যুদ্ধ ও সিরাজকে নিয়ে এই ইতিহাসচর্চা (Historiography) বেশ বিতর্কমূলক ও আকর্ষণীয়। ব্রিটিশ ওরিয়েন্টালিস্ট উইলিয়াম জোন্স, কোলব্রুক; ইভানজেলিক জন শোর,  চার্লস গ্রান্ট; প্রশাসক এলফিনস্টোন; সর্বোপরি সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিক জেমস মিল প্রমুখ কিছু পার্থক্য থাকলেও একদিকে যেমন প্রাচীন ভারতকে কল্পনা করে নিলেন সমস্ত আধুনিকতার ক্লাসিক্যাল সূত্র হিসেবে, তেমনি মুসলিম শাসনকে ঠেলে দেয়া হলো মধ্যযুগীয় অন্ধকারে। মুসলমানদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো: ধর্মান্ধ, অসহিষ্ণু, যুদ্ধপ্রিয় দুর্নীতিপরায়ণ, নিষ্ঠুর। জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকরাও সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিকদের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে বিরোধিতা করলেও মুসলিম প্রশ্নে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের সঙ্গে একমত। তাঁদের রচনায় সেখানে ঔপনিবেশিক পর্বে পরাধীন জাতির ঐতিহাসিক মুক্তির যে আধুনিক চেতনা দেখা গেল, তার শর্তগুলি উপস্থিত করেও শোনানো হল কেবল মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে হিন্দু জাতির বাহুবলের কাহিনি। ভারত-ইতিহাসের স্বর্ণযুগের ঠিকানা তাই সেই প্রাচীন হিন্দুযুগে, মুসলমানযুগে সেই স্বর্ণযুগের অবসান, ব্রিটিশ শাসনে বা আধুনিকযুগে সেই অন্ধকার অধ্যায় থেকে মুক্তি। আমাদের নবজাগরণ এই ধারায় চলেছে— পরবর্তীকালে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা এই ধারণাকেই সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে সাজিয়েছে, ভারত হয়ে উঠেছে হিন্দু-ভারত (বন্দ্যোপাধ্যায়,২০২২) ।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ভারতীয় সাংস্কৃতিক গৌরব অনায়াসে হিন্দু জাত্যাভিমানের সঙ্গে সমার্থক হয়ে দাঁড়ায় এবং মুসলমান শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রামই জাতীয় অস্মিতা প্রমাণের একমাত্র চিহ্ন বলে বিবেচিত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। যে যুগে এই লেখকেরা তাদের উপন্যাসে হিন্দু পরাক্রমের বর্ণনা করেছেন তখন ক্ষমতায় আসীন ইংরেজ শাসক। (মুখোপাধ্যায়, ২০০৩, পৃ.৩৯, ৪০)

পলাশী ও সিরাজ নিয়ে যে ইতিহাস ও ইতিহাসচর্চা তা বেশ প্রাচীন বলা যায়। প্রায় সমসময় থেকেই। এবং প্রথম থেকেই দরবারের ষড়যন্ত্রকেই প্রধানত দায়ী করা হয়েছে। যার প্রধান তিনপক্ষ যথা নবাব সিরাজ, দরবারের ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী ও ইংরেজদের পারস্পরিক জটিল সম্পর্ক। যতদূর জানা যায়, ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম ইউসুফ আলী খান নামক এক পন্ডিত ১৭৬৩-৬৪ খ্রি. রচনা করেন তারিখ-ই-বাঙ্গালা-মহাব্বত-জঙ্গী গ্রন্থটি। এই গ্রন্থে তিনি অনেক বিষয়ের সঙ্গে ইংরেজ ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কোনো নিন্দাসূচক বক্তব্য না-রেখে শুধুমাত্র সিরাজকে সব কিছুর জন্য দায়ী করেছেন (যাকারিয়া, ২০০৬,পৃ.১৫)। এরপর সৈয়দ গোলাম হোসেন খান তবাতবায়ি রচনা করেন সিয়ার-উল-মুতাখ-খিরীন (১৭৮০-৮১) ও গোলাম হোসেন সলিম জহিদপুরী রচনা করেন রিয়াজ-উস-সালাতিন(১৭৮৬ খ্রি.)। দু’টি গ্রন্থেই কমবেশি ইংরেজদের প্রশংসা ও সিরাজকে তিরস্কার করা হয়েছে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কিছু বলা হয়নি। (চৌধুরী,২০০৪, জানুয়ারি,পৃ.২১, ২২-২৩)।

পলাশী যুদ্ধের প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে ও আরো এক শতাব্দী অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরেও দেশীয় মানুষদের স্মৃতিপটে পলাশীর যুদ্ধ / ষড়যন্ত্র কী আকার লাভ করেছিল তা বোঝা যায় যথাক্রমে রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়ের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিতং(১৮০৫ খ্রি.) ও কবি নবীনচন্দ্র সেনের ‘পলাশীর যুদ্ধ’ পাঠ করলে (রায়, ১৯৯৪, পৃ.১৮১)। দু’টি গ্রন্থের মধ্যে সত্তর বছরের ব্যবধান হলেও এবং সেই সত্তর বছরে বাঙালির মনোজগতে বিপুল পরিবর্তন দেখা দিলেও উভয় গ্রন্থেই পলাশীর ষড়যন্ত্রে যে রূপ প্রতিফলিত হয়েছে তাতে হিন্দু জমিদারদের ভূমিকাই মুখ্য, ইংরেজদের নয়।

এরপর প্রায় সমসাময়িক দু’জন স্বদেশপ্রেমিক ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্র সিরাজদ্দৌলা (১৮৯৮খ্রি.) ও নিখিলনাথ রায় মুর্শিদাবাদের ইতিহাস (১৯০২ খ্রি.), মুর্শিদাবাদ কাহিনী (১৯০৩ খ্রি.) রচনা করেন। এঁরা দুজনই স্বদেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে সিরাজকে ইংরেজ বিরোধিতার জন্যে জাতীয় বীরের মর্যাদা দান করে ইংরেজদের পলাশী যুদ্ধের প্রকৃত খলনায়ক চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু এঁরা দুজনেই ইংরেজ ও এদেশীয় দোসরদের স্বরূপ উন্মোচন করার পরও ব্রিটিশ কর্তৃক ভারত দখলের ইতিবাচক দিকগুলিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তপনমোহন চট্টোপাধ্যায়ের  গ্রন্থটিও (১৯৫৩ খ্রি.) এ-গোত্রের।

রামকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়  (১৯৭৪খ্রি.) ও ব্রিজেন গুপ্তের  (১৯৬২খ্রি.) গ্রন্থদুটি সমাজতাত্ত্বিক ও পেশাদার ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে এবং লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গিতে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। কেমব্রিজ ঘরানার বিশিষ্ট ঐতিহাসিক রজতকান্ত রায় পলাশীর যুদ্ধের পেছনে ষড়যন্ত্র-তত্ত্বকে গুরুত্ব দিয়েছেন ও তার জন্য রাজপুরুষদের দায়ী করেছেন। তাঁর মতে এই চক্রান্তের সঙ্গে সুবাহ্ বাংলার জনজীবনের কোনো যোগ ছিল না। ইংরেজরা যেমন ষড়যন্ত্র করেনি তেমনি তাদের কোন রাজ্যাভিলাষও ছিল না। ঘটনাই তাদেরকে পলাশীর পরবর্তী অধ্যায়ে বাংলার মসনদে বসিয়েছিল। সিরাজুল ইসলাম  (১৯৯৯ ও ২০০০ খ্রি.) ট্র‍্যাডিশানাল মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে পলাশীর যুদ্ধের কারণসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন ‘মুর্শিদাবাদের রাজনীতি’কে। তিনি কোনো পক্ষকেই বেশি দায়ী করা সঙ্গত বিবেচনা করেননি ষড়যন্ত্রে দু-পক্ষই অংশীদার, তবে ইংরেজরা শেষ পর্যন্ত নেতৃত্ব দিতে পেরেছিল।

বিশিষ্ট মার্কসবাদী ঐতিহাসিক সুশীল চৌধুরী পলাশীর যুদ্ধ ও নবাবী আমল নিয়ে দু'টি গ্রন্থ রচনা করেন (২০০৪ খ্রি.) যদিও এই দু'টি বাংলা-গ্রন্থ রচনার পেছনে তাঁর দীর্ঘ প্রস্তুতি ছিল। তিনি ইউরোপের বিভিন্ন আর্কাইভস, বিশেষত ব্রিটিশ লাইব্রেরি, ডাচ কোম্পানির দলিল, (যা পলাশীর প্রেক্ষিতে আগে কেউ দেখেননি) সমসাময়িক ফরাসি ইতিহাস ও বাংলা সাহিত্যের পুনর্বিচার করে গ্রন্থদু'টি রচনা করেন। এর পূর্বে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আগমন ও তার জন্য বাংলার অর্থনৈতিক দুর্দশা নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ ও গ্রন্থ রচনা করেন; যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৯৯৫ খ্রি. প্রকাশিত গ্রন্থটি (এর বঙ্গানুবাদ ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে)। তিনি এস সি হিল (১৯০৫খ্রি.), পিটার মার্শাল (১৯৭৫, ১৯৮৭ খ্রি.), ক্রিস বেইলি (১৯৮৭খ্রি.), কে এন চৌধুরী  (১৯৭৮খ্রি.) রজতকান্ত রায় (১৯৯৪ খ্রি.) প্রমুখ ঐতিহাসিকদের বক্তব্যকে খন্ডন করে পলাশীর যুদ্ধের কারণ হিসেবে কার্ল মার্ক্সের ভারতবর্ষের সম্পর্কে বক্তব্য (১৮৫৩খ্রি.) বা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে বক্তব্যের প্রতিফলন হিসেবে আরো গভীর ও নতুন  তথ্যাবলীর  সাহায্যে পলাশীর যুদ্ধের জন্যই শুধু নয় বাংলার অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য প্রধানত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকেই দায়ী করেন। এ নিয়ে রজতকান্ত রায়সুশীল চৌধুরীর বিতর্ক খুবই আকর্ষণীয় ঐতিহাসিক মহলে যাকে কেমব্রিজ বনাম মার্কসবাদী বিতর্ক হিসেবে গণ্য করা হয়।

আবার ঐতিহাসিক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় (২০০৬ খ্রি.) পলাশী নিয়ে এই তর্ক-বিতর্ককে নিরর্থক মনে করে জানিয়েছেন যেটি গুরুত্বপূর্ণ তা হল একটি আঁতাত গড়ে উঠেছিল যার পরিণাম পলাশী যুদ্ধ। মোহাম্মদ যাকারিয়া বিপুল তথ্য সন্নিবেশ করে মুর্শিদাবাদে ষড়যন্ত্রকারীদেরই পলাশীর জন্য প্রধানত দায়ী করেছেন।

সালাহউদ্দীন আহমদ (২০০৮খ্রি.) বাংলাদেশের বিশিষ্ট ঐতিহাসিক। তিনি পুরো প্রক্রিয়া থেকে মীরজাফরকে আলাদা করে নিয়ে তাকেই পলাশীতে সিরাজের পরাজয়ের একমাত্র কারণ বলে প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিশিষ্ট মার্কসবাদী ঐতিহাসিক অনিরুদ্ধ রায় (২০০৯ খ্রি.) দরবারের ষড়যন্ত্রকারীদেরই প্রধান উদ্যোক্তা বলে চিহ্নিত করেছেন, যেখানে ইংরেজরা ছিল কনিষ্ঠ সভাসদ। আর একজন মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিক গৌতম নিয়োগী (২০১২খ্রি.) গ্রন্থের দুটি প্রবন্ধে (২০০৭ ও ২০০৮ খ্রি.) পলাশীর জন্য ইংরেজদের প্রধানত দায়ী করেছেন, কিন্তু সিরাজকে দেশপ্রেমিক ভাবাটা যে হাস্যকর বা দেশপ্রেমিক সাজাবার যে চেষ্টা তা যে গ্রহণযোগ্য নয় এ ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

ইংরেজদের বাংলা দখলের মূল কারণের পেছনে যে দীর্ঘ ষড়যন্ত্র ছিল এবং তা যে বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী ক্ষোভের বাণিজ্যপুঁজি থেকে শিল্পপুঁজিতে উত্তরণের প্রয়াস ছিল তা স্বীকার করে নিয়েও মার্কসবাদী ঐতিহাসিক গবেষকরা ও সিরাজের ভূমিকা প্রসঙ্গে একমত নন। পলাশীর যুদ্ধ ও সিরাজ নিয়ে আরো অন্যান্য গ্রন্থ ও প্রবন্ধের মধ্যে সম্প্রতি প্রকাশিত এবং এখনো পর্যন্ত শেষ গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটি লিখেছিলেন সুদীপ চক্রবর্তী (২০২০খ্রি.)। তিনি নিয়মিত পেশাদার ঐতিহাসিক না হলেও দীর্ঘদিন ধরে পেশাদার পদ্ধতিতে পোস্টমডার্ন লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গিতে বাঙালি জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে ইতিহাস-গ্রন্থ রচনা করে যাচ্ছেন। তাঁর গ্রন্থটির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিশিষ্ট সাবলটার্ন ঐতিহাসিক রুদ্রাংশু মুখার্জি যথাযথ বলেছেন:

Sudeep chakravarti’s book on the battle  of plassey is popular history writing at its very best, He has looked at all the relevant sources and books and then constracted an analytical narrative...plassey was a turning point but the battle and its background have not reccived the attention it merits. Chakravarti’s book fills a significant gap and does so in an enviable manner. This book will stand the test of time.”

গ্রন্থটির বিশেষত্ব এই যে- পলাশীর যুদ্ধ, সিরাজ, ক্লাইভ, মীরজাফর, চক্রান্ত, কে বেশি দায়ী— এ সবের চেয়েও এই লেখায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলা তথা ভারত তথা বিশ্বের ইতিহাসের পলাশীর ঘটনার যথার্থ গুরুত্ব উপলব্ধি করে তার পর্যালোচনা। সুদীপ চক্রবর্তী এই আলোচনা করেছেন ‘পপুলার’ পদ্ধতিতে ও ‘নতুন’ দৃষ্টিভঙ্গিতে।

বিশেষ করে ১৮৭৫ থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত বাঙালি জাতীয়তাবাদ নির্মাণ-পর্বে সিরাজকে নিয়ে যেসব রচনা, নাটকের মঞ্চায়ন, ইতিহাস, সাহিত্য প্রভৃতি রচিত হয়েছে, তা বাঙালি জাতি, জাতীয়তা, জাতীয়তাবাদ, কংগ্রেসি জাতীয়তাবাদের নির্মাণের পর্বে-পর্বে যে অভিব্যক্তি ঘটেছে তাতে ‘সিরাজ’ নিজেই হয়ে উঠেছেন সর্ববৃহৎ ‘আয়না’। সেই ‘আয়না’-র সামনে আজও আমাদের ভিন্ন পরিসরে দাঁড়াতে হচ্ছে।

গ্রন্থপঞ্জি

১। বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মল, ইতিহাসচর্চা, কলকাতা, ২০২২ (প্রথম প্রকাশ ২০০১)

২। মুখোপাধ্যায়, মীনাক্ষী, উপন্যাসে অতীত: ইতিহাস ও কল্প ইতিহাস, কলকাতা,২০০৩।

৩।Mill James, The History Of British India, 3vols, Landon,1817

৪। যাকারিয়া, আবুল কালাম মোহাম্মদ, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, ঢাকা, ২০০৬।

৫। Gholam Hossein khan, Seir Mutakherin, vol.ll, Haji Mustafa, Lahore,1975

৬। Gulam Husain Salim, Riaz Us Salateen, trans., Maulavi Abdus Salam, Calcutta, 1904

৭। চৌধুরী, সুশীল, পলাশীর অজানা কাহিনী, কলকাতা, ২০০৪ (জানুয়ারি),

ওই, নবাবি আমলের মুর্শিদাবাদ, কলকাতা, ২০০৪ (ডিসেম্বর)

৮। Chaudhury, Susil, From prosperity to decline: Bengal in Eighteenth century, New Delhi, 1995

৯। মুখোপাধ্যায়, রাজীবলোচন, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং, (সম্পা: ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়) দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থাবলী২, কলকাতা,১৩৪৩।

১০। রায়, রজতকান্ত, পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ, কলকাতা, ১৯৯৪

১১। মৈত্র, অক্ষয়কুমার, সিরাজদৌল্লা, কলকাতা, ১৮৯৮

১২। রায়, নিখিলনাথ , মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, কলকাতা, ১৯০২।

ওই, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, কলকাতা, ১৯০৩।

১৩। চট্টোপাধ্যায়, তপনমোহন,পলাশীর যুদ্ধ, কলকাতা ১৯৫৩

১৪। Mukherjee, Ramkrishna, The Rise and Fall of the East India Company, Delhi, 1974

১৫। Gupta, Brijen K, Siraj ud Daulah and the East India Company, 1756-57, Leiden, 1962

১৬। ইসলাম সিরাজুল, বাংলার ইতিহাস: উপনিবেশিক শাসনকাঠামো, ঢাকা,১৯৯৯

 ওই, বাংলাদেশের ইতিহাস, প্রথম খন্ড, (সম্পা.) সিরাজুল ইসলাম, ঢাকা, ২০০০

১৭। Hill. S.C. , Three Frenchmen in Bengal, London, 1905

১৮। Marshall. P.J.,  Bengal: The British Bridgehead, Cambridge, 1987
—,East India Fortune, Oxford, 1976

১৯। Bayly, C. A.,  Indian Society and the Making of the British Empire, Cambridge, 1987

২০। Chaudhuri, K.N., The trading world of Asia and the English East India Company,  Cambridge, 1978

২১। বন্দ্যোপাধ্যায়, শেখর, পলাশী থেকে পার্টিশন: আধুনিক ভারতের ইতিহাস, কলকাতা, ২০০৬।

২২। আহমদ, সালাহউদ্দিন, ইতিহাসের আলোকে, ঢাকা, ২০০৮।

২৩।রায়, অনিরুদ্ধ, মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস, দুই খণ্ড, কলকাতা, ২০০৯।

২৪। নিয়োগী, গৌতম, বাংলায় রাজনীতি, বাঙালির রাজনীতি, কলকাতা ২০১২।

২৫। Chakravarti, Sudeep, Plassey: The Battle that changed the course of Indian History, New Delhi, 2020

More Articles