পাকিস্তানের মানববোমা আসলে কোন রহস্যময়ী নারী! ভয়ে কাঁপবে চিনও

২৬ এপ্রিল ভয়াবহ বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। সূত্র মারফৎ জানা যাচ্ছে, বিস্ফোরণের ফলে মৃত্যু হয়েছে অন্তত পাঁচ জনের, আহতের সংখ্যা দুই। সংসদের ভোটাভুটিতে ইমরান খানের পরাজয়কে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিবেশ কিছুটা উত্তপ্ত ছিল, তার ওপর এই ঘটনা পরিস্থিতিকে যেন আরও বেসামাল করে তুলেছে। প্রাথমিকভাবে ঘটনার দায় স্বীকার করে বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)। তারা জানিয়েছে, শারি বেলুচ নামে ৩০ বছর বয়সি এক মহিলা ‘স্যুইসাইড বম্বার’ হিসেবে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। কিন্তু তার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সামনে আসায় কিছুটা আশ্চর্যই হচ্ছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ। তার কারণ, অতীতে কোনওরকম জঙ্গি কার্যকলাপে জড়িত থাকার ইতিহাস নেই শারি-র।

পাকিস্তানের উচ্চশিক্ষিত পরিবারের মেয়ে শারি। জুলজিতে স্নাতকোত্তর এবং এমফিল শেষ করে সে শিক্ষক হিসেবে নিজের কর্মজীবন শুরু করে। সাংবাদিক বশির আহমেদ গখ জানাচ্ছেন, বছরদুয়েক আগে বিএলএ-র কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় শারির। সেই থেকেই তার জঙ্গিদের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি হয় বলে মনে করছেন তিনি। সাম্প্রতিক ঘটনার পর শারি-র স্বামী হবিতন বশির বেলুচ নিজের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে লেখেন, "শারি জান, তোমার আত্মবলিদান আমাকে গর্বিত করেছে। মেহরুচ এবং মীর হাসান বড় হয়ে জানতে পারবে তাদের মা কত বড় মাপের মানুষ ছিল। তুমি আমাদের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে থেকে যাবে।" শারি-র কার্যকলাপকে কেন্দ্র করে প্রশ্ন তুলছেন বহু মানুষ। ইতিপূর্বে যে কোনওরকম জঙ্গি কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত ছিল না, সে আজ হঠাৎ করে এমন ঘটনা ঘটাল কেন? তবে কি পাকিস্তানের প্রশাসনের বিরুদ্ধে বেলুচদের অসন্তোষ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে?

বেলুচদের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রশাসনের সংঘাতের ঘটনা নতুন নয়। বহু যুগ ধরে পাকিস্তানের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে ঘটে চলেছে এমন ঘটনা। বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দাবি, পাকিস্তান গড়ে ওঠার পর থেকেই নানানভাবে তারা বঞ্চিত হয়ে এসেছে। তাদের অভিযোগ, সমগ্র পাকিস্তানের তুলনায় বেলুচিস্তান অঞ্চলে উন্নয়নের হার অনেকটাই কম। সেই কারণেই তারা সেই অঞ্চলের তেল, কয়লা, সালফার, ফ্লোরাইড এবং সোনার ওপর সম্পূর্ণ মালিকানা বজায় রাখার দাবি জানিয়েছিল, কিন্তু পাকিস্তানের প্রশাসন তাতে কর্ণপাত করেনি।

আরও পড়ুন: ইদের আগে রক্তে রাঙা আফগানিস্তান, নির্বিচারে গণহত্যায় দায় কার?

২০০০ সালে গড়ে ওঠে ‘বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি’। পাকিস্তানের বহু সাংবাদিক, প্রশাসনিক কর্তা এবং পড়ুয়াদের তারা হত্যা করে। এর প্রায় এক দশক পর বিএলএ ছাড়াও বেলুচিস্তানে গড়ে ওঠে ‘লস্কর-এ-বেলুচিস্তান’ এবং ‘বেলুচিস্তান লিবারেশন ইউনাইটেড ফ্রন্ট’ নামে আরও দুটো সংগঠন। অচিরেই তাদের ‘জঙ্গি’ তকমা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউনাইটেড কিংডম এবং পাকিস্তানের প্রশাসন। ২০১৬ সালে বিএলএ জঙ্গিদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনার ব্যাপক সংঘাত ঘটে। ঘটনার জেরে মৃত্যু হয় অন্তত ৬০০ জঙ্গির, ১০২৫ জন সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

২০১২ সালের এক সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, পাকিস্তানের অন্তত ৩৭ % বেলুচ ‘মুক্ত বেলুচিস্তান'-এর দাবিকে সমর্থন করেন। তাঁরা নিজেদের পাকিস্তানে ব্রাত্য বলে মনে করেন। তাঁদের বিশ্বাস, পাকিস্তান থেকে আলাদা না হওয়া পর্যন্ত বেলুচিস্তানের কোনওরকম উন্নতি সম্ভব নয়। পাকিস্তানের সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রধান কূটনৈতিক সঙ্গী চিনের প্রতিও বেলুচদের একাংশ ইতিপূর্বে অনাস্থা জানিয়েছেন। ২০২১ সালে বিএলএ জঙ্গিরা হুয়াই, নেটকম, এক্সেলেরন এবং জেডটিই-র মতো কিছু চিনা তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মীদের অপহরণ করে। তাদের অভিযোগ ছিল, এই সংস্থাগুলো এক বিশেষ ধরনের যোগাযোগ মাধ্যম তৈরি করার চেষ্টা করছে, যার মধ্য দিয়ে বেলুচিস্তানের মানুষদের ওপর নজরদারি চালানো হবে। অতীতে বেলুচিস্তানে বেশ কিছু চিনা কর্পোরেট সংস্থা বিনিয়োগ করার চেষ্টা করে, কিন্তু বেলুচদের একাংশ তার বিরোধিতা করে।

সাম্প্রতিক বিস্ফোরণেও নিহতদের তালিকায় অন্তত তিনজন চিনা নাগরিক ছিলেন। ঘটনার ঠিক পরেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তাঁদের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করার উদ্দেশ্যে চিনা দূতাবাসে যান। চিনের প্রশাসনও সামগ্রিক ঘটনার দ্রুত তদন্তের জন্যে তাঁর ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। সমগ্র পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, পাকিস্তানের এবং চিনের প্রতি বেলুচদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। অবিলম্বে যদি পাকিস্তান সরকার তাদের সঙ্গে কথোপকথনের প্রক্রিয়া শুরু না করে, তাহলে এই ক্ষোভ ভবিষ্যতে বৃদ্ধি পেতে পারে, এমনটাই মনে করছেন তাঁরা।

বিস্তর নাটকীয়তার পর পাকিস্তানে ক্ষমতায় এসেছে নতুন সরকার। সেদেশের মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তাদের কাছ থেকে সুশাসনের আশা করবেন। এমতাবস্থায় দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অসন্তোষের ফলে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হলে তার সুযোগ কি নিতে পারে পশ্চিমা দেশগুলো? রাজনৈতিক মহলে এখন প্রশ্ন এটাই। 

 

 

More Articles