ক্ষমতায় থাকতে আসিনি, দায়িত্বপালন করে চলে যাব : শফিকুল আলম
Shafiqul Alam Interview: নতুন বাংলাদেশ কি পাকিস্তান ঘনিষ্ঠ? জামাত-রাজনীতি, সেনার ভূমিকা, বাংলাদেশে সাংবাদিকের সামাজিক সুরক্ষা নিয়ে কী বলছেন প্রেস উপদেষ্টা? শফিকুল আলমের মুখোমুখি অর্ক দেব।
শফিকুল আলম। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহম্মদ ইউনূসের প্রেস উপদেষ্টা। এর আগে বাংলাদেশে কোনও প্রেস উপদেষ্টার এমন রাজনৈতিক 'মহিমা' পরিলক্ষিত হয়নি। প্রশ্ন উঠছে, প্রেস উপদেষ্টা কি রাজনৈতিক পদ? বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটকে কীভাবে দেখছেন শফিকুল? পাকিস্তান ঘনিষ্ঠতা প্রশ্নে কী অভিমত তাঁর? জামাত-রাজনীতি, সেনার ভূমিকা, বাংলাদেশে সাংবাদিকের সামাজিক সুরক্ষা নিয়ে কী বলছেন প্রেস উপদেষ্টা? ঢাকায় বসে শফিকুল আলমের সঙ্গে কথা বললেন অর্ক দেব।
অর্ক: ৩২ ধানমন্ডি রোডে শেখ মুজিবের স্মৃতিধন্য বাড়ি ভাঙা পড়ল আর রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা তা প্রতিহত না করে চুপ করে দেখল?
শফিকুল: এই ঘটনা যে এদিকে মোড় নেবে বুঝিনি। সেনা পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেনা ব্যবস্থা নিলে প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তা নিয়ে আশঙ্কা ছিল।
অর্ক: কিন্তু বাধা না দিয়ে কি অশান্তি এড়ানো গিয়েছে?
শফিকুল: আমরা বিবৃতিতে বলেছি এই ঘটনা অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্খিত। প্রফেসর ইউনূস বারবার সবাইকে শান্ত থাকার কথা বলেছেন। ক্রমে অবস্থা শান্ত হয়েছে। দু'একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে।
অর্ক: গাজীপুরের ঘটনা বিচ্ছিন্ন?
শফিকুল: ওই একটাই। ওখানে তো ছাত্ররাই মার খেয়েছে। তারপরে তেমন কিছু ঘটেনি। আমরা তো চাই অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে। শেখ হাসিনা বা তাঁর লোকজন যেভাবে বারবার সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করছেন, ক্রোধ জিইয়ে রাখছেন, এর একটাই লক্ষ্য, অশান্তি তৈরি করা, প্রমাণ করা, যারা বিপ্লব করল তারা জঙ্গি। আমাদের বারবার প্রমাণ দিতে হবে। এর সঙ্গে ভারতীয় গণমাধ্যমও জড়িত। আমরা বারবার বলছি, আসুন, ঘুরে দেখে যান, পনেরো দিন থাকুন। এই জায়গাটাকে তো চেনা উচিত, নাহিদ কেমন, মাহফুজ কেমন, প্রফেসর ইউনূস কেমন চালাচ্ছেন, হাতেকলমে দেখা উচিত। এই সমাজে অনেক ভাগ আছে। লিবারেল, ধার্মিক, আওয়ামী ঘেঁষা, প্রো-বিএনপি, জামাত ঘেঁষারা কী ভাবছে জানা উচিত। তা না করে ক্রমে অনলাইনে ক্রোধ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
অর্ক: অনলাইনে ঘৃণা ছড়ানোর প্রশ্নে আপনারা পিনাকী ভট্টাচার্যদের সতর্ক করার কথা ভেবেছেন? অনেকেই অভিযোগ করছেন, পিনাকী ভট্টাচার্যরা 'মব' সংগঠিত করছেন দূরে বসে। বুলডোজার নিয়ে ৩২ ধানমন্ডি যাওয়ার ডাক তো পিনাকীই দিয়েছিলেন। তাহলে কি মেনে নিতে হবে দেশ চালাচ্ছেন পিনাকীই?
শফিকুল: দেশ আমরাই চালাচ্ছি। আসলে মানুষের খবর সংগ্রহ করার প্যাটার্ন অনেক বদলে গিয়েছে। মার্কিন নির্বাচনকে এবার ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করেছেন ইউটিউবাররা, পডকাস্টরা।
অর্ক: তাহলে এর শেষ কোথায়?
শফিকুল: আমি সত্যিই জানি না। আপনার এই প্রশ্নে আমি মন্তব্য করতে চাই না। শুধু বলব আমরা নতুন তথ্যের বাস্তুতন্ত্রে ঢুকছি।
অর্ক: তাহলে তো রাষ্ট্রকাঠামো যে কোনও দিন ভেঙে পড়বে?
শফিকুল: না ভাঙবে না। গাজীপুরের ঘটনার পর আর বড় কিছু ঘটেনি। আপনি তো ক'দিন এখানেই আছেন, আপনি কিছু শুনেছেন? আমরা আমাদের কাজ করছি। স্পর্শকাতর জায়গায় নিরাপত্তা বাড়িয়েছি।
অর্ক: বাংলাদেশে কি সামরিক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা রয়েছে?
শফিকুল: না, আমার তা মনে হয় না। বাংলাদেশে সেনাবাহিনী এখন অনেক বেশি হিউম্যান রাইটস নিয়ে ফোকাসড। আপনি যদি পাহাড়ের বিষয়ও দেখেন, দেখবেন সেনাবাহিনী দৃষ্টান্তমূলক ভাবে ভালো কাজ করছে, ইউএন পিস রিপোর্টও তাই বলছে। আগে ভোটের সময় সেনা মোতায়েন হতো দু'তিন সপ্তাহের জন্য। তারপর তারা ব্যারাকে ফিরে যেত। এখন সেনাকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেওয়া হয়েছে। ছ'মাস আছে তারা। দেশে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার্থে ওরা খুবই ভালো কাজ করছে। দুর্গাপুজোর সময় হিন্দু কমিউনিটির মনে আশঙ্কা ছিল, নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে বাহিনীই। এমন সময় কাজ করছে সেনাবাহিনী যখন পুলিশ কনফিডেন্স ফিরে পায়নি। নির্মোহভাবে দেখলে, ওরা ভাল কাজ করছে। প্রচুর গুজব ছড়াচ্ছে, তার দায় ভারতীয় মিডিয়ার। তারা সেনাপ্রধানকে নিয়ে কিছু অসঙ্গত রিপোর্ট করেছিল। একটা দেশের বিরুদ্ধে একটা তথাকথিত ভালো পত্রিকার হয়ে কীভাবে বছরের পর বছর মিথ্যে রিপোর্ট করা যায় আমি জানি না। মাল্টিপল সোর্স বলে এসব খবর করা হয়।
অর্ক: আপনি সেনার প্রশংসা করছেন, তাহলে সেনা হেফাজতে কেন তৌহিদুল ইসলামের মৃত্যু হলো?
শফিকুল: দু'একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। আমরা শূন্যে নামিয়ে আনতে চাই। চেষ্টা করছি।
(৯ ফেব্রুয়ারি বিবিসি-তে তাফসির বাবুর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে: বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে দেখা যায়, ২০২৪ সালে নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে যে ২১টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে ১২টিই হয়েছে গত সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর এই চার মাসে)
আরও পড়ুন- একাত্তর আঁকড়েই এগোবে চব্বিশ: নাহিদ ইসলাম
অর্ক: আপনি দাবি করছেন ভারত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে ইউনূস সরকারকে কালিমালিপ্ত করতে। আপনার কাছে কোনও তথ্যপ্রমাণ আছে?
শফিকুল: এটা তথ্যপ্রমাণের বিষয় নয়। ভারতীয় পত্রিকা তো টাকার বিনিময়ে খবর ছাপে।
অর্ক: আপনি দাবি করছেন এই সংস্কৃতি বাংলাদেশে নেই?
শফিকুল: এখানে এমনটা হলে স্ক্যান্ডল হবে। এত মিথ্যে আসছে কেন? আমরা বারবার সবাইকে বলছি আসুন এসে বাংলাদেশে থেকে যান। ঢাকা সস্তা শহর। আমাদের খাদ্যাভ্যাসও এক। ভেজ-নন ভেজ খাওয়ার পাওয়া যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা মূলগত পরিবর্তন এসেছে। মনগড়া কথা না বলে জানা তো দরকার। নাহিদ কেমন কাজ করছে? মাহফুজ কি সত্যিই হিজবুত তাহারিরের অংশ নিজেই যাচাই করে দেখুন না।
অর্ক: শেখ হাসিনাকে হাসিনাকে চুপ করাবেন কী করে? তিনি তো আবার বিবৃতি দিতে পারেন। তার মানে আবার ভাঙচুর?
শফিকুল: দেখুন, এই নিয়ে ভারতের সঙ্গে কথা হয়েছিল। ভারত সরকার বলেছে, তিনি তো প্রাইভেট সিটিজেন, রিফিউজ নিয়েছেন, সরকার কোনও আলাদা সহযোগিতা করেনি। কিন্তু ফ্যাক্ট হলো, তিনি তো কথা বলছেন। তিনি ডিনায়ালের মধ্যে আছেন। যে ধরনের অন্যায় করেছেন তা নিয়ে তিনি ভাবিত নন। এর ফলে মানুষের মধ্যে ক্রোধ তৈরি হচ্ছে। যখনই তিনি কথা বলছেন তখনই তরুণ-তরুণী, মধ্যবয়সিরা ক্রুদ্ধ হচ্ছেন।
১৯৭১ সালের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিল রিফিউজি শেল্টারগুলিতে। সেখানে বেশি নিম্নবর্ণের হিন্দুরা। তাদের যে বর্ণনা আমি শুনি, কারও হয়তো মা ভাই মারা গেছে কলেরায়৷ ট্রাকে লাশ তুলে দেওয়া হয়েছে, সেই লাশ ট্রাক থেকে পড়ে গেছে, তখন কুকুর সেই দেহ খেয়েছে। ঠিক এমনটাই সবার স্মৃতিতে দগদগে জুলাই কিলিং কিন্তু ওদের মধ্যে কোনও শোক, অনুতাপ নেই। মানুষের ক্রোধ আজও পুঞ্জীভূত হয়ে আছে।
অর্ক: আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের সুযোগ দেওয়া হবে না?
শফিকুল: আপনি যদি প্রফেসর ইউনূসের প্রথমদিকের ভাষণ শোনেন, দেখবেন তিনি বলছেন, আমরা বড় পরিবারের অংশ। আমাদের তর্ক আছে, ঝগড়া হবে, ভাবনার ফারাক থাকবে কিন্তু শত্রু নই আমরা। এর মূল কথাটা ছিল, সবাইকে এক জায়গায় আনা। আওয়ামী লীগের মধ্যে যারা এসবে জড়িত ছিল না, তারা যেন একটা সুযোগ পায়। কিন্তু ওরা তো এই সদিচ্ছায় সাড়া দেয়নি। আপনি কি কোনও আওয়ামী লীগের নেতাকে দেখেছেন তাঁদের নেত্রীকে অস্বীকার করতে? ইউএনএ রিপোর্ট দেখলেন তো, জাতিসংঘ তো স্পষ্ট বলছে বলপূর্বক হত্যা করা হয়েছে।
অর্ক: নতুন বাংলাদেশ পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়ছে?
শফিকুল: আমরা আমাদের মতো হব। বাংলাদেশ বাংলাদেশের মতো হবে। বাঙালি মুসলমান বাঙালি মুসলমানের মতো হবে। বাঙালি হিন্দু বাঙালি হিন্দুর মতো হবে। পাকিস্তানের ভূগোল আর আমাদের ভূগোল তো এক নয়। আমরা চিন্তা-ভাবনায় স্বতন্ত্র। সেই চিন্তায় আমাদের মাটির গন্ধ আছে। আমাদের নদীর গন্ধ আছে। আমাদের চিন্তায় আমরা যাঁদের লেখা পড়ে বড় হয়ে উঠেছি, তাঁরা আছেন। নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র আছেন। লালন ফকির আছেন। আমি ভাবতাম, আমার ছেলে শুধুমাত্র পাশ্চাত্যের গান শোনে। আজকাল দেখছি, সে লালন শোনে। সে নিজের দেশকে এক্সপ্লোর করছে। ইংরেজি স্কুলে পড়েছে, ভালো বাংলা লিখতে পারে না কিন্তু তাঁর মাটির টান আছে তো।
অর্ক: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৬ মাস পূর্ণ হওয়ার দিনটা তো পাকিস্তান নিজেদের বিজয় হিসেবে দেখবে?
শফিকুল: আমরা সার্কভুক্ত সমস্ত দেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চাই। ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চাই। ভারতের অর্থনীতি দ্রুত গতিতে বাড়ছে, আমাদের ভৌগলিক-ভাষিক-পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। আমরা বিচ্ছিন্ন নই। ভারতের বিকাশ মানে আমাদেরও বিকাশ। আমরা একসঙ্গে বাড়তে চাই। বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান সবাই বিকাশ চায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যদি উন্নত হতে পারে, তবে আমরাও পারি। প্রফেসর ইউনূস ভালো সম্পর্কের পক্ষে। তাঁর একটা প্রস্তাব, ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটান নিয়ে একটা দক্ষিণ এশিয় গ্রিড তৈরি করা।
আমরা এবং ভারত ফসিল ফুয়েল পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি। আমরা কমিয়ে এনে নেপাল-ভুটান থেকে হাইড্রোইলেক্ট্রিসিটি নিতে পারি। এক্ষেত্রে নেপাল আর ভুটান বিক্রেতা, আমরা এবং ভারত ক্রেতা। এখানে ভারতের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভারতের মধ্যে দিয়েই এই হাইড্রোইলেক্ট্রিক আসবে। এই নিয়ে প্রফেসর ইউনূস দফায় দফায় অনেকের কথা বলেছেন। সবাই একসঙ্গে বিকশিত হোক।
আমাদের দেশ নদী দিয়ে ঘেরা। এই বাস্তুতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হবে। আমাদের নদী ভয়াবহ দূষিত, বাতাসের একিউ লেভেল বাড়ছে। ঢাকা, দিল্লি দুইয়েরই বাতাসের অবস্থা খারাপ।
ভারত বাংলাদেশকে দেখছে পাকিস্তানের প্রিজমে। আমরা ইতিহাসের দায়-দেনার কাছে বন্দি হয়ে যাচ্ছি। ফ্রান্স জার্মানিকে আক্রমণ করেছিল। ফ্রান্সের সঙ্গে জার্মানির সম্পর্ক আর কখনও ভালো হবে না? আমরা সার্কভুক্ত দেশ, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো হলে তাতে অন্যায় কী? আমরা স্বাধীন দেশ, সার্বভৌম দেশ, সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই। আমাদের সেনাপ্রধান বলেছেন, আমরা এমন কিছু করব না, যা ভারতের কৌশলগত নীতির বিরুদ্ধে যায়।
অর্ক: ইতিহাসে বাইশ পরিবার তত্ত্বের কথা পড়েছি। হাসিনা যে অলিগার্কদের সাহায্য করেছেন, তারা দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করেছেন, ইউকে-তে রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ করেছেন। এই টাকা ফেরাবেন কীভাবে? আপনাদের কোনও পরিকল্পনা আছে?
শফিকুল: আমাদের সামনে অ্যাঙ্গোলার উদাহরণ রয়েছে। ওরা ১৪ বিলিয়ন ডলার ফিরিয়েছে। আমরা প্রথমে কী পরিমাণ টাকা বাইরে পাচার হয়েছে তার তথ্য পরিষ্কারভাবে সামনে আনতে চেয়েছিলাম। এই তথ্য আমরা দু'ভাবে পাচ্ছি। আমরা ব্যাঙ্কিং সেক্টর অডিট করেছি। ডক্টর দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এবং তাঁর সহকর্মীরা শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছেন। সেই হিসেবে দেখা যাচ্ছে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে চলে গেছে।
অর্ক: কীভাবে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা পাচার হলো?
শফিকুল: ওরা প্রথমেই ব্যাঙ্কের বোর্ডটা দখল করে ফেলত। বোর্ডে বসার সঙ্গে সঙ্গে তারা বেনামে কোম্পানি খুলত। এস আলম বিভিন্ন শেল কোম্পানি করেছেন। ইসলামী ব্যাঙ্ক ছিল বাংলাদেশের বৃহত্তম বেসরকারি ব্যাঙ্ক। সেই ব্যাঙ্ক সে দখল করল ডিজিএফআই দিয়ে। এই নিয়ে ইকনোমিস্ট ২০১৭ সালে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বোর্ড মেম্বারদের সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত হোটেলে নিয়ে গিয়ে বাধ্য করা হয়েছিল সই করে সরে যেতে। এভাবে ব্যাঙ্কের দখল নেওয়া হয়। দখল নেওয়ার পর, ওই বোর্ড দিয়ে বিভিন্ন শেল কোম্পানি দিয়ে সে টাকা তুলতে থাকে। এস আলম একাই বিভিন্ন শেল কোম্পানি ব্যবহার করে ছ'-সাতটা ব্যাঙ্ক থেকে একাই তুলে নিয়েছে এক লক্ষ পঁচিশ হাজার কোটি টাকা। তখনকার হিসেবে পনেরো বিলিয়ন ডলার মতো। সে সময় তিনি সিঙ্গাপুর, লন্ডনে সম্পত্তি করেছেন। আওয়ামীপন্থী সাংবাদিকরা তা প্রচার করেছে। একটা প্রচার করা হয়েছিল, যে এই বিগ ক্যাপিটাল দেশের জন্য ভালো করছে। দক্ষিণ কোরিয়া গঠনে স্যামসং-এর ভূমিকা আছে। কিন্তু এরা তো চুরি করে টাকা পাচার করেছে। আমরা কেপিএমজি-সহ কিছু প্রতিষ্ঠানকে ডেকেছি, সব দেশে টাকা পাচার হয়েছে তাদের এজেন্সিগুলির সহায়তা নিচ্ছি। আমাদের আন্তর্জাতিক আইনি পরিকাঠামোয় কাজটা করতে হবে। কালই এ কাজ হবে না। আমরা চাইছি দ্রুত কাজটা নিষ্পত্তি করতে। ফিলিপিন্সে মার্কোজের টাকা অনেক অনেক বছর পরে এসেছিল। আমাদেরও সময় লাগতে পারে।
অর্ক: আদানি-হাসিনা চুক্তিও তো জনবিরোধী। শ্রীলঙ্কা সেই চুক্তি খতিয়ে দেখছে। আপনারা এ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারলেন?
শফিকুল: এটা তো আন্তর্জাতিক চুক্তি। আমরা আইনি সংস্থার সঙ্গে কথা বলে চুক্তি খতিয়ে দেখছি।
অর্ক: রামপাল চুক্তিও খতিয়ে দেখা হবে?
শফিকুল: না। রামপালে কেন ওই চুক্তি হলো সেটা নিয়ে আমাদের প্রশ্ন আছে কিন্তু অন্য চুক্তিগুলি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
অর্ক: নির্বাচন নিয়ে এত গড়িমসি কেন?
শফিকুল: আমি তো জানেন প্রফেসর ইউনূস দুটো তারিখ দিয়েছেন। একটা ডিসেম্বর, অন্যটা আগামী বছরের মাঝামাঝি। আমরা অনেকগুলি সংস্কার কমিশন করেছি৷ আগামী ছ'মাসে তা নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের কথাবার্তা শেষ হবে। আমর একট ঐক্যমতে পৌঁছব আশা রাখি। যে মূল কথাগুলি উঠে আসবে সবার সম্মতিতে, তার নাম জুলাই চার্টার। ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে দেখতে হবে জুলাই চার্টারের কতটা আমরা কার্যকর করতে পারলাম।
আমাদের কাছে প্রস্তাব আছে স্বাধীন তদন্তকারী সংস্থা গড়ার৷ প্রস্তাব আছে স্বাধীন আইনি পরিকাঠামো তৈরি করার। এগুলি সময়সাপেক্ষ কাজ। যেগুলি তাড়াতাড়ি হবে সেগুলি আমরা করে ফেলতে চাইছি। রাজনৈতিক দলগুলি যদি মনে করে আমরা নিরপেক্ষ, আমাদের সময় দেবে, তেমন হবে। ৩০ জুনের পরে আমরা থাকব না, এটা নিশ্চিত ধরে নেন। বাকিরা আগে চাইলে, আগেই হবে নির্বাচন।
অর্ক: বিএনপি-র সঙ্গে আপনাদের দূরত্বের কারণ কী?
শফিকুল: বিএনপি-র সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো। বাংলাদেশে স্থিতাবস্থা আনার জন্য তারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। এখন নিজেদের সমর্থকদের জন্য ওরা কিছু কথা তো বলবেই।
আরও পড়ুন-লাশ লুকিয়ে রাখার নির্দেশ! ছাত্র আন্দোলনে হাসিনার ভূমিকা নিয়ে কী বলছে জাতিসংঘের রিপোর্ট?
অর্ক: প্রেস সচিব কি কোনও রাজনৈতিক পোস্ট? অতীতে কোনও প্রেস সচিবের এই রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল?
শফিকুল: ধ্রুপদীভাবে ভাবলে এটা নিউট্রাল সরকার নয়। আগে যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছিল তা ছিল প্রকৃতার্থেই নিউট্রাল। এখন আওয়ামী লীগ তো আমাদের বিরোধী পক্ষ ভাবছে। আওয়ামী লীগের সমর্থকের কাছে আমি গণশত্রু। আমায় রাজনৈতিক মন্তব্য করতে হচ্ছে। আমার কর্তব্য আওয়ামী লীগ আমলের অন্যায় অবিচার তুলে ধরা। তারা যা করেছে সবটা মানুষকে জানানো উচিত। এখন বিবৃতি দিলেই ধরে নেওয়া হয়, আমি একটা রাজনৈতিক মন্তব্য করছি। আওয়ামী লীগের আমলে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার হাওয়া হয়ে গিয়েছে। ৩৫০০ লোক গুম হয়েছে। এ কথাগুলি তো আমায় বলতে হবে। কারণ যে বাংলাদেশ চাইছি তাতে এ ধরনের অন্যায় থাকবে না। মানবাধিকারের জায়গা থাকবে। আপনি হিন্দু-বৌদ্ধ-ক্রিশ্চান-নাস্তিক যা খুশি হতে পারেন, যে কোনও লিঙ্গের হতে পারেন, মানবাধিকারই হবে সবচেয়ে বড় কথা। কিন্তু আওয়ামী লীগের বয়ান শফিক পলিটিকাল লোক। আগের প্রেস সচিবকে সমাজমাধ্যম হ্যান্ডল করতে হয়নি, আগের প্রেস সচিবকে অপতথ্যের সঙ্গে লড়তে হয়নি। আমাকে লড়তে হচ্ছে।
অর্ক: আপনাদের মিডিয়া সেলে কতজন আছে?
শফিকুল: আমরা আছি ছ'-সাত জন।
অর্ক: আপনার কি মনে হয় মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া গুজব রুখতে সাতজন যথেষ্ট?
শফিকুল: আসলে সরকারে সেই পরিকাঠামো নেই। সরকার চলে বিংশ শতাব্দীর মডেলে। একবিংশ শতাব্দীর এই মডেক কার্যকর করা যায়নি। একবিংশ শতাব্দীতে সবাই চলে ধারণায়। সত্য-মিথ্যে যাচাইয়ের দরকার নেই। এখন এটাকে প্রতিহত করতে দুশো লোক লাগবে। প্রফেসর ইউনূস ছোট সরকারে বিশ্বাস করেন। ছোট, যতটুকু লাগবে তাই। এর ফলে, আমাদের কোনও ছুটি নেই। সারাদিন ছুটছি। আমরা চেষ্টা করি প্রধান মিথ্যেগুলি প্রতিহত করতে। সেনা নিয়ে মিথ্যে, ইসলামিস্ট জবরদখলের গল্প আমরা প্রতিহত করেছি। হিন্দুদের অবস্থা ভয়াবহ, এই মিথ্যে আমরা প্রতিহত করেছি।
অর্ক: নির্বাচন হলে তো আপনি দায়মুক্ত। তারপর কী করবেন?
শফিকুল: সাংবাদিকতায় আমার ফেরার ইচ্ছে ছিল কিন্তু ফিরতে পারব কিনা জানি না। ভাইদের টাকাপয়সা আছে। তাদের জাকাতের টাকায় চলতে পারব। অপতথ্য মানুষ খুন করে। রোহিঙ্গাদের তো অপতথ্য দিয়েই বাস্তুচ্যুত করা হলো। আমাদের এক মিলিয়নের বেশি রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব নিতে হয়েছে। ভুল তথ্য দিয়ে স্থিতাবস্থা নষ্ট করে কার লাভ!
অর্ক: আপনি বিএনপি-তে যোগ দেবেন নাকি ছাত্রদের রাজনৈতিক দলের অংশ হবেন? ছাত্ররা তো প্রবীণ অভিজ্ঞ মুখও খুঁজছে।
শফিকুল: আমার স্ত্রীও আমায় ঠিক এই প্রশ্ন করেছে। জামাত ইসলামি করব না, এটুকু বলতে পারি। বাংলাদেশে বিশ্বাসাশ্রয়ী রাজনীতির ভবিষ্যত আছে বলে আমি মনে করি না। নাহিদ আপনাকে যা বলেছে, আমিও তার সঙ্গে একমত। যে যার রাজনীতি করুক, আমি সকলকে সম্মান করি। কিন্তু আমার মনে হয় বিশ্বাসকে রাজনীতিতে আনলে বিশ্বাস ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বহুস্বর চাই, বাংলাদেশে বহুস্বর চাই। আমরা ১৯৯৯ পরবর্তী ইন্দোনেশিয়ার মতো সম্ভাবনাময় রাজনীতির দিকে যাচ্ছি। ইন্দোনেশিয়া দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় গণতন্ত্র। আমরা নতুন নেতা পেয়েছি নানা ফ্রন্টে। শুধু বৈষম্যবিরোধীরাই নয়, বামেদের মধ্যেও নতুন মুখ আছে। বিতর্কের জায়গা তৈরি হয়েছে।
অর্ক: মেয়েদের খেলা বন্ধ করে দেওয়ার নিদানে আপনার সরকার কেন ব্যবস্থা নিতে পারল না?
শফিকুল: গত একমাসে ২৭০০ টা মেয়েদের খেলা সারা বাংলাদেশ জুড়ে হয়েছে। বাংলাদেশকে আমরা ৬৪টি জেলায় ভাগ করেছি। এই ৬৪টি জেলাকে ৫০০ উপজেলায় ভাগ করা হয়েছে। ২৭০০ খেলার মধ্যে তিনটে খেলায় বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সেই দেখে কেউ যদি বলে বাংলাদেশে মেয়েদের ফুটবলের ভবিষ্যত নেই সেটা অন্যায় না? সামগ্রিকভাবে বিচার করতে হবে। এখানে সবাই থাকবে।
অর্ক: আপনাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আপনারা বহু সাংবাদিকের প্রেস কার্ড বাতিল করেছেন।
শফিকুল: আগের প্রেস অ্যাক্রিডেশনের নীতিমালায় কিছু অনৈতিকতা ছিল। যেমন সরকারের অনুমতি নিয়ে বিদেশে যাওয়া, সরকারের কথা লেখা। আমরা নতুনভাবে শর্ত তৈরি করছি। বাংলাদেশের সব অগ্রগণ্য সংবাদমাধ্যমের অভিমত নিয়ে এই নীতিমালা করা হচ্ছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের লোককেও এখানে রাখা হয়েছে। এ মাসেই এটা শেষ হবে। সবাই নতুন অ্যাক্রিডেশনে জায়গা পাবে। আমার মনে হয় না এটা বড় ইস্যু। আমরা কাউকে সাংবাদিকতা করতে বাধা দিচ্ছি না। কোনও পত্রিকা বন্ধ করিনি, কোনও টিভি স্টেশন বন্ধ করিনি। তারপরেও অনেকের অনেক খারাপ লাগা আছে। বহু খুনের মামলা হয়েছে। কিন্তু এসব কেসের একটাও আমরা দিইনি। এটা দিয়েছে যাদের ছেলেমেয়ে মারা গেছে, যারা মনে করছে এখানে সাংবাদিকদের ভূমিকা আছে তাঁরা। অনেকক্ষেত্রেই হয়তো খুনের মামলা না দিয়ে অন্য মামলা দেওয়া যেত। আমরা সরকারের তরফে একটা কমিটি গড়ে দিয়েছি। ওঁরাই কেসগুলি দেখবেন, পুনর্বিবেচনা হবে। চারজন গ্রেফতার হয়েছে। কেউ বলতে পারবে না আমরা তাদের হয়রান করছি। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। কিন্তু আমরা চাকরি খাইনি। কোনও প্রতিষ্ঠানকে বলিনি চাকরি থেকে সরাতে। প্রমাণ দিতে পারলে আমি পদত্যাগ করব। চাকরি গিয়েছে কারণ মালিকরা নতুন রাজনৈতিক বাস্তবে নতুন করে দল সাজাতে চাইছে। আমরা কারও চাকরি যাক চাইনি। আপনি যে কোনও সংবাদমাধ্যমে কথা বলতে পারেন। বড় পত্রিকা প্রফেসর ইউনূসকে নিয়ে ঢাক পেটালে তিনি বিব্রতই হন। সাংবাদিকদের আমরা বলছি, আমাদের দোষত্রুটি থাকলে ধরিয়ে দিন। ক্ষমতায় থাকলে এক ধরনের অন্ধত্ব কাজ করে। সংবাদমাধ্যম আমাদের ভুল ধরিয়ে দিলে আমরা লাভবান হব। ক্ষমতায় থাকতে তো আসিনি। দায়িত্বপালন করে চলে যাব। এই সাংবাদিকতার দিকেই তাকিয়ে আছি।
(প্রথম আলোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২৯ অক্টোবর ২০ জন এবং নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ২৯ সাংবাদিকের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করেছিল তথ্য অধিদপ্তর। ১০ নভেম্বরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আরও ১১৮ জন সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করেছে তথ্য অধিদপ্তর (পিআইডি)। এ বিষয়ে আমরা আরও বিস্তারিত অনুসন্ধান চালাব)