ধর্মের ভয় উড়িয়ে জয় মেয়েদের! বাংলাদেশের রাজপথে নজিরবিহীন সম্মান ফুটবলের রানিদের!
Bangladesh Women's Football Team: মেয়েদের খেলা রুখতে উগ্রবাদীদের একটি দল কলসিন্দুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অফিসঘরে রাখা আন্ডার-১৯ দলের জেতা মেডেল ও শংসাপত্র নির্মমভাবে জ্বালিয়ে দেয়।
ইতিহাস রচিত হল ঢাকার রাজপথে! গত বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর ছাদখোলা বাসে চেপে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনায় ভাসলেন দেশের জাতীয় দলের মহিলা ফুটবলাররা। এ সম্মান বাংলাদেশে এতদিন পুরুষ ক্রিকেটার বা তারকারাই পেতেন। তবে এদিন এক অন্য ধারার সূচনা হল। আসলে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বিএফএফ) ১৯৭২ সালের ১৫ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হলেও, ৩৫ বছরের দীর্ঘ সময় পর ২০০৭ সালের নভেম্বরে ভিশন এশিয়া কর্মসূচির আওতায় জন্ম হয় বাংলাদেশ মহিলা ফুটবলের। একদিকে যেখানে ভারত, নেপাল ও ভুটানের মতো দেশগুলিতে মহিলা ফুটবলের আবির্ভাব প্রায় ৫০ বছর আগে, সেখানে বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল গঠনের প্রায় ১৫ বছরের মাথায় সাউথ এশিয়ার ৪ টি দেশকে শূন্য গোলে হারিয়ে সাউথ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশন (সাফ) চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২২ ট্রফি জিতে রীতিমতো ইতিহাস গড়ল বাংলাদেশ।
অনেক অপেক্ষার পর বাংলাদেশের ঝুলিতে এত বড় প্রাপ্তি। প্রায় সবগুলো ম্যাচেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে বাংলাদেশের বাঘিনীরা প্রতিপক্ষ দলগুলিকে নিমিষেই গুঁড়িয়ে দিয়ে জয়ী হয়। দিনটা ছিল ১৯ সেপ্টেম্বর, পুরো মাঠ ভর্তি দশকের টান টান উত্তেজনায়। ফাইনালে নেপালকে হারিয়ে বাংলাদেশ মহিলা জাতীয় দল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২২ জয় করে। গ্রুপ পর্বের ম্যাচে বাংলাদেশ ৩-০, ৬-০ এবং ৩-০ গোলে যথাক্রমে মালদ্বীপ, পাকিস্তান এবং ভারতকে উড়িয়ে দিয়ে সেমিফাইনালে ওঠে। সেমিফাইনালের ম্যাচে ভুটানকে ৮-০ গোলের বিশাল ব্যবধানে হারায় বাংলাদেশ। ফাইনালে নেপালের মাটিতে নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে জিতে নেয় সাফ ২০২২ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি।
শুধু ট্রফি নয়, দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতেন। এছাড়াও টুর্নামেন্টে ৮টি গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারও জিতে নেন তিনি। অন্যদিকে দলের গোলরক্ষক রূপনা চাকমা ৪টি ক্লিন শিট সহ সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার জিতে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা গোলরক্ষকের সম্মান অর্জন করেন।
নেপালের দশরথ স্টেডিয়ামে ঐতিহাসিক এই জয়ের পর বাংলাদেশের মহিলা ফুটবলাররা গত ২১ সেপ্টেম্বর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, গোল্ডেন বুট, গোল্ডেন বলের মতো মূল্যবান সম্মান নিয়ে বাংলাদেশে ফেরেন। ইতিহাসের পাতায় দুর্দান্ত এই সাফল্য অর্জনের গল্প স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখতে বাংলাদেশ ন্যাশনাল কারিকুলাম অ্যান্ড টেক্সটবুক বোর্ড (এনসিটিবি) ইতিমধ্যেই পদক্ষেপ করেছে। একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণির ২০২২ সালের সংশোধিত সিলেবাসের ইংরেজি পাঠ্যপুস্তকে “ইয়ুথফুল অ্যাচিভার্স” ইউনিটের অধীনে “দ্যা আনবিটেন গার্লস” শিরোনামে বাংলার এই সোনার মেয়েদের নিয়ে একটি সম্পূর্ণ অধ্যায় রচনার কথা জানানো হয়েছে।
আরও পড়ুন- উদ্বাস্তু হচ্ছে বাঘও! কেন বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে আসছে বাঘের দল?
নতুন এই অধ্যায়ের মাধ্যমে একশো বছর পরেও বাংলাদেশের স্কুলপড়ুয়ারা এই বাঘিনীদের গর্জন শুনতে পাবে, উৎসাহিত হবেন তরুণরাও। এই যোদ্ধা খেলোয়াড়দের ফুটবলের সঙ্গেই রচিত হবে দেশের লড়াইয়ের এক অন্য কথা, এমনটাই আশা দেশের।
দলের খেলোয়াড় তহুরা খাতুনকে বাংলাদেশের কলসিন্দুর গ্রামে ‘মেসি’ বলে ডাকা হয়। তহুরা বলেন। “আমি এখন একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হব আর কলেজে নিজের সম্পর্কে বইয়ে পড়ব, আবার পরীক্ষায় এ বিষয়েই লিখব এটা ভেবেই ভালো লাগছে।” উল্লেখ্য, তহুরা খাতুন কলসিন্দুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে দশম শ্রেণি উত্তীর্ণ হয়েছেন এবং বর্তমানে বাংলাদেশ আন্ডার ২০-র জন্য খেলছেন।
কিন্তু এই জয়, স্বীকৃতি পেতে ঠিক কতটা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁদের?
বাংলাদেশের ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী উপজেলা ধোবাউড়ার হিন্দু নামের গ্রাম কলসিন্দুর থেকে শুরু হয় মহিলা ফুটবলারের যাত্রা। মহিলা ফুটবল ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও কোনও প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও ক্লাব না থাকায় স্পন্সরশিপের অভাবে ফুটবল খেলার আয়োজন সম্ভব হয়নি অনেক বছর। ২০১১ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে প্রথমবার শুরু হয় বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ টুর্নামেন্ট।
ঠিক তখনই (২০১১ সালে) কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মফিজ উদ্দিন সদ্য ঘোষিত বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টের কথা জানতে পারেন এবং এই আয়োজনে তাঁর বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের অংশগ্রহণের উদ্যোগ নেন।
চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী, সানজিদা আক্তার ছিলেন সেই স্কুলের মহিলা ফুটবল দলের প্রথম যোগদানকারী। একই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ুয়া মারিয়া মান্দা, শিউলি আজিম, মারজিয়া আক্তার, শামসুন্নাহার, তহুরা খাতুন, সাজেদাও একে একে যোগ দেন দলে। কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফুটবল দলের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করা গ্রামের খেলোয়াড়রা বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল জাতীয় দলের বড় অংশ। দলের আটজনই কলসিন্দুর গ্রামের।
কলসিন্দুরের এই আট মেয়ের বাড়ি গিয়ে বাবা-মা কে রাজি করানো থেকে শুরু করে মেয়েদের ফুটবল খেলায় উদ্বুদ্ধ করার দায়িত্ব নেন মোহাম্মদ মফিজুদ্দিন। দল গঠনের পর দলের কোচও হন তিনি, ছোট মেয়েদের মাঠে নিয়মিত অনুশীলন করাতেন। তখন কেউ পড়ত দ্বিতীয় শ্রেণিতে, কেউ তৃতীয়, কেউ বা চতুর্থ শ্রেণিতে। বর্তমানে এশিয়া মহাদেশে মহিলা ফুটবল র্যাঙ্কিংয়ে সপ্তম স্থানে রয়েছেন সানজিদা যাঁর বাবা একজন কৃষক। ২০১১ সালে সানজিদা যখন প্রথম ফুটবল খেলেন তখন বলে লাথি মারতেও পারতেন না। “মূলত শিক্ষকদের শাসনের ভয়েই তখন মাঠে নামতে বাধ্য হয়েছিলাম,” সানজিদা জানান।
দলের আরেকজন খেলোয়াড় শিউলি আজিম বলেন, “মাঠে হ্যান্ডবল খেলা চলছিল। মাঠের পাশে অন্য মেয়েদের সঙ্গে বেঞ্চে বসে খেলা দেখছিলাম। খেলোয়াড়দের বল মারতে দেখে হেসে ফেলি। তাঁরা গিয়ে স্যারের কাছে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। হাসির শাস্তি হিসেবে আমাকে মাঠে নামিয়ে দেওয়া হয়। তখন খেলতে বাধ্য হই। এভাবে ফুটবল খেলার শুরু।”
কলসিন্দুর গ্রামের শামসুন্নাহার সহ অনেকের ঘরেই নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। ফলে ছোটবেলা কেটেছে বৈদ্যুতিক আলোহীন। কলসিন্দুর গ্রামের বাইরের সাউথ এশিয়ার সেরা গোলরক্ষক রূপনা চাকমার ছোটবেলাও কেটেছে ভাঙা ঘরে। দলের অনেক খেলোয়াড়েরই অবস্থা প্রায় এক। গত ২২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য সকল খেলোয়াড়দের ভাঙা বাড়ি নতুন করে তৈরির ঘোষণা করেছেন।
সাবিনা খাতুন কিংবা কৃষ্ণা রানী সরকার, সকলেরই প্রথমবার মাঠে নামা ও সংগ্রামের ভিন্ন ভিন্ন গল্প রয়েছে। তবে মাঠে নামার পর আর পেছনে ফিরে না তাকিয়ে সব ধরনের বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছেন সকলে। ২০১১ সালে ফুটবলের যাত্রা শুরুটা একেবারেই সহজ ছিলনা কলসিন্দুর মেয়েদের। ধাপে ধাপে অনেক বাধা পেরিয়ে আজ তাঁদের এই গরিমা। ছিল ধর্মীয় অনুশাসনের ভয় ও পারিবারিক নিষেধাজ্ঞা। মেয়েরা প্রথম প্রথম প্যান্ট-গেঞ্জির বদলে সালোয়ার কামিজে খেলতে চাইত। বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অনেকভাবে বোঝানোর পর মেয়েরা জার্সিতে খেলার জন্য রাজি হয়েছিল। মেয়েদের খেলার অনুমতি দিতে চাইতেন না তাঁদের বাবা-মারাই।
কলসিন্দুর বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মিনতি রানী শীল ও সহকারি শিক্ষক মফিজ উদ্দিন মিলে বাবা-মা’দের বুঝিয়েছিলেন, “যদি ইরানের মেয়েরা খেলতে পারে তাহলে আমাদের মেয়েরা পিছিয়ে থাকবে কেন”। আরও একটা বড় বাধা ছিল অর্থনৈতিক সংকট। দলটির সকল সদস্যই প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র পরিবারের বাসিন্দা।
দু’বছর প্রাথমিক হাতেখড়ির পর ২০১৩ সালে আরেকজন দক্ষ কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের হাত ধরে এই মেয়েরা আন্ডার-১৪, আন্ডার-১৭, আন্ডার-১৯ ও আন্ডার-২০ খেলা শুরু করে এবং লাগাতার টুর্নামেন্ট জেতার সুযোগ পায়। মহিলা ফুটবল জাতীয় দল এবং বয়স স্তরে মেয়েদের দলের দক্ষতা বিকাশ ও বৃদ্ধির জন্য বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ টুর্নামেন্ট এই খেলোয়াড়দের উঠে দাঁড়াতে অনেকটাই সাহায্য করেছে। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গমাতা আন্ডার-১৯ মহিলা আন্তর্জাতিক গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে সবাইকে চমকে দিয়ে একের পর এক ম্যাচ জিতলে তাঁদের মেডেল ও শংসাপত্র দ্বারা পুরস্কৃত করা হয়। মেয়েদের অসামান্য অবদানের জন্য সেসময় সংবর্ধনাসহ আর্থিক অনুদানও দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আরও পড়ুন- কোন পথে কীভাবে বাংলাদেশ যায় এ-দেশের গরু! রইল আসল তথ্য
কিন্তু মেয়েদের খেলা রুখতে সে বছর উগ্রবাদীদের একটি দল কলসিন্দুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অফিসঘরে রাখা আন্ডার-১৯ দলের জেতা মেডেল ও শংসাপত্র নির্মমভাবে জ্বালিয়ে দেয়। তবে তা থামিয়ে রাখতে পারেনি কলসিন্দুরের মেয়েদের। ২০১৬ সালে প্রথমবার সাফে অংশগ্রহণ করে রানার আপ হলেও ২০২২ সালে দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ জাতীয় দলের মেয়েদের স্বপ্নের সাফ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতার ইচ্ছেপূরণ হল। সমগ্র টুর্নামেন্টে ফেয়ার প্লের জন্য সবচেয়ে সুশৃঙ্খল দল হিসেবেও ট্রফি জিতেছে বাংলাদেশ ওমেন্স ন্যাশনাল ফুটবল টিম।
সাফের ফাইনাল ম্যাচের আগের দিন দলের খেলোয়াড় সানজিদা আক্তার ফেসবুকে লিখেছিলেন, “ট্রফি নিয়ে ছাদখোলা বাসে দাঁড়াতে না পারলেও কোনও সমস্যা নেই। আমরা তাঁদের জন্য জিততে চাই যাঁরা সমাজের কটূক্তি উপেক্ষা করে আমাদের সবুজ ঘাস স্পর্শ করতে সাহায্য করেছে। আমাদের সাফল্য কিছু নতুন সাবিনা, কৃষ্ণা এবং মারিয়ার জন্ম দিতে পারে।”
ফাইনালে দলটি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতার পর গৌরবের মিছিলে ভেসেছে বাংলাদেশের মানুষ। রাতারাতি তৈরি হয়েছে ওপেন-টপ বাস। ২১ সেপ্টেম্বর ঢাকা শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে শতশত শুভেছা বার্তা নিয়ে হাজার হাজার লোকের সমাগম হয়। ওপেন-টপ বাসে রাজকীয়ভাবে বরণ করা হয় বাংলার রানিদের।
ছাদখোলা বাসে ঢাকার রাজপথ জুড়ে কয়েক ঘণ্টা ভিক্টরি প্যারেড করে সাবিনা খাতুনের দল। পথে তখন দূর দূরান্ত থেকে আসা উৎসুক মানুষের ঢল নেমেছে। সারা বাংলাদেশে উৎসবের স্রোতে ভেসে উঠেছে জয়ের আনন্দের ঢেউ আর গর্বে ফুলে উঠেছে লাল সবুজ বাংলার বুক।
সোশাল মিডিয়াতে অনেকেই মহিলা ফুটবলারদের সংগ্রাম নিয়েলিখেছেন, কেউ কেউ আবার পুরুষ এবং মহিলা খেলোয়াড়দের বেতন ব্যবধান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্ন উঠছে, “মহিলা বলেই কি তাঁদের পুরুষের তুলনায় কম বেতন দেওয়া হয়? কিন্তু খেলায় নারী পুরুষ কীসের? দেশের জন্যই তো খেলছে। মেয়েরা জয়ও নিয়ে আসছে, তাহলে কেনই বা এই বেতন বৈষম্য?”