কলকাতার রাস্তার মতো পানশালা আর কোথাও নেই...

Bars of Kolkata: যারা এখন সাহিত্যের, কবিতার অগ্রপথিক, আমার ধারণা তাঁরা মালটাল খান না (হাসি)। খেলে বাংলা কবিতার চেহারা হয়তো অন্যরকম হতো।

অর্ক – আমাদের আলোচনাটা মূলত পানশালা নিয়ে। কয়েক বছর আগে তোমার একটা বই বেরিয়েছিল, ‘ময়দান ও পানশালা’। এই বইটিতে তোমার পানশালা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আছে। একটা পানশালা-দর্শন রয়েছে। নিছক মদ খাওয়া নয়, পানশালার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া ধরা রয়েছে। সেই বোঝাপড়ার জায়গাটা দিয়েই যদি শুরু করি। কলকাতার পানশালাগুলিকে তুমি কীভাবে দেখো? কীভাবে তোমার কাছে ধরা দেয় পানশালার আলো অন্ধকার, সেটা যদি একটু বলো।

রাহুল – এখন হয়তো এটা আমার পক্ষে বলা কিছুটা সহজ। কারণ, এখন আমি পান থেকে অনেক দূরে। যখন মদ্যপান করতাম, তখন পানের থেকেও পানশালাগুলি অনেক বেশি নেশার কারণ ছিল। আসলে এক একটা পানশালার এক এক রকম চরিত্র। তার মানুষগুলি এক এক রকম। তাঁদের এক এক সময় নিজের আত্মীয়ের মতো মনে হতো। আমি এখন লক্ষ্য করি, যতটা না মদ খাওয়ার জন্য গিয়েছিলাম, তার থেকে অনেক বেশি গিয়েছি আড্ডা মারতে। সেই লোকগুলো অনেক দূর থেকে আসতেন। কেউ হয়তো রানাঘাটে থাকেন। অবসর নিয়ে নিয়েছেন। তিনি প্রতি মঙ্গলবার দুপুর দুপুর সিসিলে আসতেন আড্ডা দিতে। সেই যে লোকটা, এরকম বিচিত্র সব মানুষ পানশালার মধ্যে ছড়িয়ে আছে। এখানে কলকাতার মধ্যবিত্ত পানশালাগুলির কথাই বলছি। উচ্চবিত্ত জায়গার অভিজ্ঞতা খুব বেশি নেই। মধ্যবিত্ত মানুষের যে দৈনন্দিনতা, সেটা খুব অদ্ভুতভাবে ধরা পড়ত এই পানশালাগুলিতে। মদ খাওয়ার পর তো অনেক মানুষ সহজ হয়, অনেকে জটিল হয়। তবে আমি বেশিরভাগ সহজ মানুষের সঙ্গেই মিশেছি।

এমনও হয়েছে যে, কারও সঙ্গে বছরে একদিন দেখা হয়েছে। কোনও একটা নির্দিষ্ট দিনে তিনি আসবেন। তাঁর স্ত্রীর জন্মদিন, সেদিন এসে তিনি মদ খাওয়াবেন। তারপর আর কোনও যোগাযোগ নেই। এক বছর পর ঠিক সেই দিন, সেই সময় আমি উপস্থিত হয়ে দেখি তিনিও এসেছেন। খাইয়েছেন, অনেক আড্ডা মেরেছি। এই যে মানুষ, মানুষ আর মানুষ... বিভিন্ন রকম মানুষের সঙ্গে মেলামেশার একটা বিরাট জায়গা হল পানশালা। শুধু যারা খেতে আসেন তাঁরা নন। যারা পরিবেশন করেন, তাঁরাও।

মনে আছে, আমরা একদিন দুপুরবেলা অলিম্পিয়াতে শক্তিদার (কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়) জন্মদিন পালন করেছিলাম। সেই আসরের সভাপতি ছিলেন কবি তুষার চৌধুরী। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল লালুদা’র গানে। লালুদা ওড়িয়া ভাষায় একটা গান করেছিলেন। তিনি ওখানে পরিবেশন করতেন। লালুদা পরে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন, “কী আর বলব! দাদাকে বলতাম, আর খাবেন না। এবার বাড়ি যান। আর দাদা বলতেন, আর একটা দাও, এটাই শেষ। সেটা দিলে বলতেন, আরও একটা। তারপর আমি নিজে লুকিয়ে পড়তাম, দাদাকে দিতাম না।” অনেক সময় আমাদেরও বলেছেন, আর খাবেন না। রাত হয়ে গেল, এবার বাড়ি যান। এই কথাগুলোর মধ্যে অদ্ভুত একটা আন্তরিকতার ছোঁয়া আছে। যেগুলি সাধারণ মানুষের মধ্যে পাই না। মদই যদি খেতই হতো, বাড়িতে বসেই খাওয়া যেত। কোনও সমস্যাও ছিল না আমার। কিন্তু ওই সন্ধ্যা, আমি অবশ্য দুপুরবেলাতেও চলে যেতাম। যেমন ব্রডওয়ে দুপুরে আমায় হাতছানি দিত। গরমের দুপুর, লম্বা লম্বা শসা বিনা পয়সায়, অনেক সময় ওই শসা খেয়ে পেট ভরে যেত। অদ্ভুত একটা আবহাওয়া। এখন এমনি আড্ডা মারতে মারতে যাই। মিস করি।

অর্ক – একটা কথা বলো, চল্লিশ থেকে ষাট- এই দশকের কলকাতায় পানশালা বলতে যা বোঝায়, সেখানে দু'তিনটে জায়গার কথা বারবার ঘুরে আসত। খালাসিটোলা বা কেটি, ঋত্বিক-কমলকুমারদের সুবাদে লোকজন বারবার নাম করত। তারপর তৃপ্তি বা এই ধরনের বারগুলো। তোমার বিচরণের জায়গা যদি আশির দশক ধরি…

রাহুল – আশির শেষ…

অর্ক – হ্যাঁ। তোমাদের কি চুম্বকটা পাল্টাল? সেটা কি অলিপাব বা অলিপাব সদৃশ ওই জায়গাগুলোয় চলে গেল?

রাহুল – না, সেটা পাল্টায়নি। খালাসিটোলায় আমি যেতাম। জয়দেব (কবি জয়দেব বসু) খালাসিটোলা পছন্দ করত না। সেখানে পৃথ্বীশদাকে কেন্দ্র করে একটা আড্ডা ছিল। সে খুব মজার আড্ডা। আর আমরা যারা পার্ক স্ট্রিটের আশেপাশে চাকরি বাকরি করতাম, তাঁকে কেন্দ্র করেই জড়ো হতাম বিভিন্ন জায়গায়। যেমন, অলিম্পিয়া। তখন সবচেয়ে সস্তার বার। অলিম্পিয়াতেই জড়ো হতে শুরু করলাম। তারপর দেখা গেল, আশেপাশের যত অ্যাড এজেন্সি আছে, মিডিয়ার লোকজন, অধ্যাপক কবি-লেখকরা আছেন, সবাই এসে এই অলিম্পিয়ায় জড়ো হন। আগেও এখানের একতলায় শক্তিদাকে ঘিরে বিরাট আড্ডা ছিল। আমরা দোতলায় বসতাম। অলিম্পিয়ার আড্ডা আমরা শুরু করিনি। অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। ইংরেজি মহলের আড্ডা যদি বলো… অলিম্পিয়া কিন্তু প্রাচীনতম ছিল। এটা মূলত ছিল জুয়াড়ি ও জকিদের পানশালা।

ওখানে তখন ম্যানেজার ছিলেন হক সাহেব। আমাদের সঙ্গে দারুণ ভাব ছিল। একটা সময় দিনের পর দিন বিলে সই করে বাকিতে খেয়ে আসতাম। তখন বিনে পয়সায় মাল খাই বলে নিজেদের মধ্যে একটা বীরত্ব তৈরি হতো। ফলে এরকম অনেক মুহূর্ত তৈরি হয়েছিল। আমরা যে সময় গিয়েছি সে সময়ে তুষার চৌধুরী আছেন। তুষারদা কথাবার্তায় অসাধারণ; কবিতার জ্ঞান, ব্যুৎপত্তি, কবিদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গল্পের সম্ভার। সেসব নিয়েই আড্ডা চলত। উৎপলকুমার বসু অনেক সময় দুপুরে অলিম্পিয়ায় যেতেন…

আরও পড়ুন- মদ না খেয়েই মাতাল! জানেন কোন কঠিন অসুখ বাসা বাঁধছে আপনার শরীরে

অর্ক – এখানে একটা প্রশ্ন করি। এই উৎপলকুমার বসু তো আবার কফি হাউজেও যেতেন। আমাকে এটা একটু ভেবে বলো যে, ক্যাফে কেন্দ্রিক আড্ডা আর বার বা এই ধরনের ঠেককেন্দ্রিক আড্ডা – এই দুটোর মধ্যে চরিত্রগত ফারাক কোথায়? বহু মানুষ স্রেফ কফিহাউজেই কাটিয়ে দেন জীবনটা...


রাহুল – বারকেন্দ্রিক আড্ডায় নেশা একটা প্রধান জিনিস। নেশা, যেখানে ঘোর লাগে। কারও যদি কফিতে নেশা হয়, তাহলে আমার কিছু বলার নেই। আমার নিজের কোনওদিন তাতে নেশা হয়নি। নেশার একটা অন্যরকম বাতাবরণ আছে। তার পরিবেশ, আবহাওয়া, লোকগুলো… মারামারি, ঝগড়া, ভালোবাসা, আনন্দ দুঃখ – এই যে সব মিলিয়ে একটা ব্যাপার। অলিম্পিয়ার দারোয়ান থেকে শুরু করে ম্যানেজার – প্রত্যেকের কাছে আমাদের অবারিত দ্বার। একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। দর্শন বলতে আমার এটাই মনে হয়। এই পানশালাগুলো ব্যক্তি মানুষের সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি করে।

অর্ক – আর পানশালার খাওয়া দাওয়া? ছোটমাছ, আদা কুচোনো...

রাহুল – খাওয়া দাওয়া তো কলকাতা শহরের উৎকৃষ্ট। আমার মনে হয়, বড় বড় রেস্তোরাঁর থেকেও ভালো খাবার পাওয়া যায় এই পানশালাগুলিতে। অলিম্পিয়ার বিফ স্টেক তো বিখ্যাত। এছাড়াও আছে মেটেভাজা। পরবর্তী সময় প্রেস ক্লাবে আড্ডা মারতাম দামে সস্তা বলে। সেখানকার খাবারও খুবই ভালো ছিল। আড্ডা হয়তো পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু এখনও সেখানে ভালো খাবার দাবার পাওয়া যায়। সব বারগুলিতেই আড্ডার চরিত্র বদলেছে। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে এই বদলটা এসেছে। বারগুলোতে গান শুরু হল। সেগুলো আর বার রইল না, গানের আখড়া হয়ে উঠল। অন্য ধরনের লোক আসতে শুরু করল।

আমাদের সময়ের খুব ইন্টারেস্টিং একটা বার ছিল মেট্রো বার। প্রেস ক্লাব বন্ধ থাকলে সেখানে যেতাম। মেট্রো ক্লাবে আমাদের একটা ছোট গোষ্ঠী মতো তৈরি হয়েছিল। অধীর দাস, আমি, অতীশ, বিপ্লানু, প্রদোষ, প্রবীর ভৌমিক। যখন গান শুরু হল, তখন মালিক তিনতলায় একটা ঘর করে দিলেন। ওখানে গান টান হবে না। ওখানেই ২৫ বৈশাখ উদযাপন করেছি।

দুপুরবেলা ওই ঘরটায় লেখাপড়াও করা যেত। মাঝে আমার দীর্ঘদিন চাকরি ছিল না। বাড়িতে বলতে পারিনি। হয়তো বই-খাতা-ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এবার কোথায় যাব? চলে যেতাম মেট্রোর তিনতলায়। কেউ ডিস্টার্ব করবে না, লেখাপড়া করতে পারব বসে। একটা মদ নিয়ে কথা বলতে পারব… এই ধরনের জিনিস ছিল আর কী। শারীরিক কারণে এখন যেতে পারি না। কিন্তু এই পানশালার জীবনটা এখনও আমায় খুব হাতছানি দেয়।

অর্ক – শ-বারের কথাটা বলো? তোমার কম বয়সের একটা অভিজ্ঞতা শুনেছিলাম…

রাহুল – শ-বারের যিনি মালিক, তিনি ছিলেন আমার বাবার পরিচিত। প্রথম যখন শ-বারে যাই, বাবা তখন বেঁচে। কলেজে পড়ি তখন, খুব একটা মদ টদ খেতাম না। বাড়িতে আসার পর খুব মার খাই। রাতে মা জিজ্ঞেস করল, মারলে কেন? বাবা বলল, শ্রীমানের পাখা গজাইসে। মধুবাবুর দোকানে যান, ঘনঘন। অথচ একদিন মাত্র গিয়েছিলাম (হেসে)। তারপরও অনেকবার গিয়েছি। তখন তো একেবারে মদের হাট, সেটার আবার অন্য নেশা আছে। এত মানুষ, এত লোক… সেখানে ঘুরে ঘুরে মদ্যপান করছো। লোকজন খাবার নিয়ে আসছে, খাবার বিক্রি হচ্ছে। যেন মাছের বাজার বসেছে! কলকাতার একটা দর্শনীয় স্থান মনে করি এই শ-বারকে। পানশালায় অনেকে বিভিন্ন কারণে যান। কিন্তু আমি যেতাম কারণ, আমার সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। পানশালা, তার দারোয়ান, মালিক, ম্যানেজার, চেয়ার-টেবিল… একটা নির্দিষ্ট জায়গায় না বসলে আমার ভালো লাগত না।

অর্ক – তোমার কাব্য ভাবনার সঙ্গে এটা কীভাবে জড়িয়ে আছে?

রাহুল – একটা সময় যখন মদ্যপান করতাম, তখন বাড়ি এসে হয়তো লিখতাম। সেটা যে খুব সজ্ঞানে লিখতাম তা নয়। পরেরদিন সকালে এসে যখন দেখতাম লেখাগুলোকে, অনেক সময় দেখতাম খুব অর্থহীনতায় ভরা। অবশ্য অর্থহীনতাকে সবসময়ই আমি খুব সম্মান করি। লেখাগুলো তখন সেভাবেই থেকে যেত হয়তো। অনেকদিন পর হয়তো আবছা একটা অর্থ খুঁজে পেলাম… বা পেলাম না। কিন্তু আমার মনে হতো যে, নেশা আমার অবচেতনকে শাসন করে। নেশা আমার অবচেতনকে দিয়ে অনেক কিছু করায়, অনেক কিছু বলায় যেগুলো আমি বলতে চাই। ফলে আমি সুস্থ অবস্থায় যেটা বলতে চাই না, সেটা নেশা আমায় দিয়ে বলিয়ে নেয়।

অর্ক – তোমার পূর্বতন অফিসটা যখন পোদ্দার কোর্ট থেকে সরে গেল, সেই সময় থেকে প্রায় ১২-১৪ বছরের বেশি হয়ে গেল। এখন সল্টলেকে তোমার নিয়মিত যাতায়াত হয়েছে। সল্টলেক তো বার দিয়ে ঘেরা। কিন্তু কসমোপলিটান কলকাতার বারের চরিত্রের সঙ্গে তার একটা বিরাট পার্থক্য রয়েছে।

রাহুল – আমরা তিনজন বন্ধু ছিলাম। আমাদের মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়; অঞ্জন এখন আর নেই, সুদীপ্ত সেনগুপ্ত আর আমি। আমরা সারাদিনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বারে যেতাম। একটা বার আছে, দ্য ম্যুর। সিসিল বলে একটা বার আছে। এক একটা জায়গার চরিত্র এক এক রকম। দ্য ম্যুরে যেমন পাসপোর্টের দালালরা আসেন। সিসিলে পুলিসের খোচর থেকে শুরু করে ইনকাম ট্যাক্সের লোকজন আসেন। মন্টিকার্লোয় আমি আর সুদীপ্ত যেতাম। বিভিন্ন রকম মাছ পাওয়া যায় ওখানে। এই সিসিলে এক ভদ্রলোক আসতেন, ঘোষবাবু। তিনি রিটায়ার করে গিয়েছিলেন। সোদপুরে থাকতেন; কিন্তু মদ খাওয়ার জন্য, আড্ডা মারার জন্য প্রতি দুপুরে সেখানে যেতেন। অঞ্জন আর সুদীপ্তকে প্রশ্ন করতেন, একটা কথাই শুধু ভাবি যে, আপনারা টাই পরে কী করে মিথ্যা কথা বলেন? ওরা তখন খবর পড়ত, অ্যাঙ্করিং করত।

সেক্টর ফাইভে অঞ্জন কিছুদিন ছিল। তখন আমি মদ্যপান করি না। অঞ্জনের সঙ্গে সেখানকার বারে যেতাম। সেই পানশালাগুলো আমায় টানত না। এই যে মধ্য বা উত্তর কলকাতার যে পানশালাগুলো, তার চরিত্রই ছিল অন্য রকম। অলিম্পিয়াও একসময় ছিল, কিন্তু এখন গিয়ে...

অর্ক – এখানে একটা প্রশ্ন ঢুকিয়ে দিতে চাইছি। এই যে তুমি ‘এখন গিয়ে’ বলে একটা পজ নিচ্ছ… তার মানে এখন গিয়ে পরিস্থিতিটা বদলে গিয়েছে। কসমোপলিটান চরিত্র একটা ছিল কলকাতা শহরের। ২০০০ সাল অবধিও তার চরিত্রগুলোকে রাখা গিয়েছে। কিন্তু তা অন্য সব শহরের মতো হয়ে উঠতে লাগল। মানে এই যে সল্টলেক, আইটি সেক্টর, সিলিকন ভ্যালিরই মিনিয়েচার…

রাহুল – একদম…

অর্ক – হ্যাঁ। সেটাই কি কলকাতার পানশালাকে গিলে নিচ্ছে?

রাহুল – না, ঠিক গিলে নিচ্ছে না। ছায়া ফেলছে। গেলা অত সহজ নয়। আমি একটা উদাহরণ দিই, যেমন চাংওয়া। আমাদের পরিচিত একজন এখানকার লিজ নিয়েছিলেন। আমরা চাংওয়াতে আড্ডা মারতে যেতাম। এখানে একটা বিশ্বাসের প্রশ্ন আছে… বিশ্বাস। চাংওয়াতে আড্ডা মারতে ঢুকতাম। কোনওদিন কেউ পয়সা মারেনি, বা ভয় পায়নি যে এ টাকা না দিয়ে চলে যাবে। কিছুদিন আগে আমি আবার চাংওয়াতে যাই। গিয়ে টেবিলে একটা অদ্ভুত কার্ড দেখি। সেখানে লেখা, তিন-চারজন মিলে যদি একসঙ্গে মদ খান, তাহলে বাইরে সিগারেট খেতে যেতে হলে অন্তত একজনকে বসিয়ে রেখে যাবেন। কারণ, এই যে চারজন বেরোচ্ছে, তারা নাও ফিরতে পারে। বিশ্বাসের জায়গাটা নড়ে গিয়েছে। ফলে এই যে পানশালাগুলোর সঙ্গে আমাদের একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, সেসব এখনও মজবুত আছে কিনা, এটা আমার একটা প্রশ্ন… সংশয়।

অর্ক – আবার এটাও একটা দিক যে, একটা কম্পিটিটিভ জায়গাও তো রয়েছে। মানে সল্টলেকের বারগুলির যে বার্ষিক আয়, তার সঙ্গে লড়তে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, বারগুলো নিজেদের অঙ্গসৌষ্ঠব বদলে ফেলছে। ব্রডওয়ে নিজেকে বদলে ফেলেছে। তৃপ্তি, অলিপাব… সবাই নিজেদের বদলে ফেলেছে। এই বদলটা অনেকটা কলকাতা শহরের পুরনো বাড়ি বদলের মতো। বদলটা ততক্ষণই সুন্দর, যতক্ষণ তার কোর এসেন্সটাকে রাখা যায়। সেটা কি হয়েছে? তুমি কী মনে করো?

রাহুল – না, আমার এটা মনে হয় না। কারণ, এখন আমার ঢুকতে গেলে পা কাঁপে। মনে হয়, এ আমার পরিচিত অলিম্পিয়া নয়। কিছু কিছু আগের মতো রয়েছে। অধিকাংশের ধাঁচ পাল্টে গিয়েছে। লোকজন তো বদলেছেই, সেই সঙ্গে আদবকায়দা পাল্টেছে। তাদের খাবার, পরিবেশ, দেওয়াল পাল্টেছে। এবং এই কর্পোরেট জগতের যে একটা প্রভাব, সেটা কেবল সেক্টর ফাইভের মধ্যে পড়েছে এমনটা নয়। সেটা আশেপাশেও ছড়িয়ে পড়েছে কিন্তু। তারাও তো প্রতিযোগিতায় আছে।

একটা জিনিস মনে হয়, সন্ধেবেলা যখন অফিস থেকে বেরোই, তখন মনে হয় আমি আমেরিকায় আছি। আলো জ্বলছে, এই হচ্ছে, সেই হচ্ছে… অন্যরকম পানশালা। তখন নিজেকে মনে হয়, খুব যেন এগিয়ে চলেছি। দারুণ একটা সভ্যতা। কিন্তু এই সভ্যতা আমাদের গিলেও খাচ্ছে। তখন নিজের ওই বারটাকে খুঁজি; যেখানে চুপচাপ অন্ধকারে বসে একটা বোতল নিয়ে বই পড়ছি বা লিখছি। তিন-চারজন বন্ধু বসে যতক্ষণ ইচ্ছে আড্ডা মারছি। কেউ আমাদের তুলছে না। সবার সঙ্গে অন্যরকম একটা সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। এই বারটাকে আমি খুঁজি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আর পাই না।

আরেকটা জিনিস, তখন ঠেক ছিল। বার নয়, একটা আড্ডা। কারও একটা ঘরে মদ কিনে নিয়ে গিয়ে খাওয়া যেত। এরকম কত ছড়িয়ে রয়েছে! অমুক জায়গায় বসে একটু মদ খেলাম। ভাড়ায় টাকা দিলাম… ৫০ টাকায় এক ঘণ্টা। আমার বন্ধু ছিল অলীক; ওর কাছে সমস্ত ঠিকানা ছিল। খিদিরপুরের আশেপাশে, ধর্মতলায়, শ্যামবাজারে এরকম বিভিন্ন ঠেক ছিল। এখন জানি না এগুলোর কী অবস্থা হয়েছে। আমার মনে হয় এগুলো আর নেই।

অর্ক – এটা রাখার দায় কার? এখানে একটা কথা আছে… চল্লিশের দশক থেকে তোমাদের সময় অবধি আমরা এই বারগুলোর কথা শুনে আসছি। আমি নিজেও এসব জায়গায় যাই। কিন্তু এই যে আমরা এত নেই নেই বলছি… সেই সময়ের যিনি তরুণ, তাঁর হাতেই তো এর মালিকানা ছিল। আমি তরুণদের মদ খাওয়ার জন্য স্বাগত জানাচ্ছি না। কিন্তু আজকের তরুণদের মধ্যে এই ঠেকে জোট বাঁধার ব্যাপারটা কম? সে অনেক বেশি কেরিয়ার সচেতন?

রাহুল - আমার মনে হয়, ওই যে আবহাওয়াটা ছিল, সেটা ব্যবসার কারণে হোক, অর্থনীতির জন্য হোক…

অর্ক – না, আজকের সৃষ্টিশীল ছেলেমেয়েরা, কবিতা লিখিয়েরা কি এমন বারে যায় না?

রাহুল– আমার ধারণা, যায়। তবে এখন হয়তো কমে গিয়েছে অনেক। সেখানে অর্থনীতিও জড়িয়ে রয়েছে। ধরো, আমি এর মধ্যে এমনি একদিন খালাসিটোলা গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম, তার পরিবেশটা একেবারে বদলে গিয়েছে। আগে দুপুরে বা সন্ধ্যায় গেলে কয়েকজন লেখকের সঙ্গে দেখা হতোই। অন্যরা চিনিয়ে দিতেন, কফি হাউজে আড্ডা মারতে চলে গেলেন। এবার গিয়ে দেখলাম, তেমনটা আর নেই। অনেক সাহেব-সুবো লোকজন এসেছেন, তাঁরা অফিসবাবু। তাঁদের মধ্যে কেউ থাকতেও পারেন… আছেন হয়তো! তবে লেখালেখির সঙ্গে মদের দোকানের কোনও সম্পর্ক নেই। সেখানে যেতেই হবে এমন কোনও কথা নেই।

আমি যেটা বলতে চাইছি, আমাদের সময় যেমন সহজ পরিবেশটা ছিল… ধর কোনও শপিং মলে যদি আমার চটি ছিঁড়ে যায়, তাহলে সেটি পরে হাঁটতে একটু কুণ্ঠিত বোধ করব। এত জাঁকজমক! এখনকার বারগুলিকে দেখে এমনটা মনে হয়। ওইসব জায়গায় খালি পায়ে ঢুকে যেতে পারতাম।

অর্ক – এই সংকটটাই বোধহয় আজকের যুবককে একটা অস্বস্তির মুখে ফেলছে…

রাহুল – করতে পারে। মাঝখানে দেখছিলাম, আমার পরিচিত অনেকেই ব্রডওয়েতে আড্ডা মারতে যাচ্ছেন। হয়তো সেখানে এখনও আড্ডা মারার মতো অবস্থা আছে। হয়তো গান হয় না… এই গানটা এখন বিরাট ব্যাপার।

অর্ক – না, আজকাল ব্রডওয়েতে গান হচ্ছে।

রাহুল – ওহ… এখন গানও হয়?

অর্ক – হ্যাঁ…

রাহুল – গান ঢোকানো মানে আড্ডা শেষ।

অর্ক – এবং আলোর ঝকমারিটাও অন্যরকম করেছে। খুব হতাশাজনক…

রাহুল – কী জানো তো, আরেকটা জিনিস আমার মনে হয় - সম্পর্ক। ডিউক বলে একটা বার ছিল। আমার, জয়দেবের আর সুব্রতর কাছে পয়সা নেই। আমরা জানতাম যে, ছ’টার সময় ওখানে পূর্ণেন্দু পত্রী আর অমিতাভ দাশগুপ্ত মদ খেতে যাবেন। আমরা বিড়ালের মতো গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমাদের দেখে বলতেন, কী করছিস? বলতাম, এই যে মদ খাব, পয়সা নেই। তখন বলতেন, ভিখিরির মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন তাহলে? ভেতরে আয়। একটা হলেও খাওয়াব। সেই একটা দিয়ে শুরু হতে হতে প্রচুর খাওয়া হয়ে গেল। সপ্তাহের দু' তিনদিনই এরকম হয়ে যেত। কিন্তু এই যে একটা সম্পর্ক ছিল… এটা এখন নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। এখন অধিকাংশই হয়ে গিয়েছে ভাগাভাগির। যারা এখন সাহিত্যের, কবিতার অগ্রপথিক, আমার ধারণা তাঁরা মালটাল খান না (হাসি)। খেলে বাংলা কবিতার চেহারা হয়তো অন্যরকম হতো।

অর্ক – তোমরা ‘ময়দান ও পানশালা’ বইটার লেখাগুলি কীভাবে তৈরি হলো?

রাহুল – আমরা একসময় ময়দানে আড্ডা মারতাম। সেই সময় শিলাদিত্য পত্রিকা থেকে দেবজ্যোতি আর সৌরভ ময়দান নিয়ে লিখতে বলে। তখন একটু একটু করে লেখা শুরু হল। একজন ছিলেন মালবাবু, অমিতাভদা, রশিদ খান। পৃথ্বীশদা একদিন এসেছিলেন। চোর, পকেটমার, মাঠবেশ্যা… একটা বিরাট আড্ডা ছিল। দরকার হলে মাঠেই মদ খাওয়া হতো। আমি সামান্যই লিখতে পেরেছি। মাঠের জীবন নিয়ে লিখতে পারলে একটা উপন্যাস হয়ে যায়। সব লেখাগুলোই মোটামুটি অন্যদের লেখা। তারপর ‘এই সময়’ পত্রিকা পানশালা ও মদ নিয়ে একটা সংখ্যা করে। তখন ওরা লিখতে বলে। লিখতে গিয়েও বারবার ওই লোকগুলো ধাক্কা মারত। পানশালার মানুষগুলো, ময়দানে যারা আড্ডা মারতে আসত। ওই মানুষগুলিকে ধরার চেষ্টা করেছিলাম। এখনও লিখতে ইচ্ছা করে, হয়তো লিখব আরও কিছু। তাহলে এই লোকগুলো আর হারিয়ে যায় না, সঙ্গে সঙ্গে থাকে। আমার এক বন্ধু ছিলেন, কবিতা লিখতেন। প্রবীর ভৌমিক। এখন মারা গিয়েছেন। প্রবীরদা বিভিন্ন রকম পানশালা আবিষ্কার করত। একটা পানশালায় দেখত, ভিখিরিরা মদ খায়। মধ্যমগ্রাম ইত্যাদি জায়গায় এমন অনেক ছেয়ে আছে। সেসব জায়গায় একসময় গিয়েছি। শক্তিদা মারা যাওয়ার পরে একটা পানশালায় গেলাম। দেখলাম, এক ভদ্রলোক শক্তিদার একটা ছবি লাগিয়ে নিজে মদ খাচ্ছে, আর শক্তিদার মুখে ছুঁড়ে দিচ্ছে। আর বলছে, “খা শালা, খা। খা।” ওই লোকটার সঙ্গে শক্তিদার আলাপ ছিল। একসময় ওঁর মধ্যমগ্রামের বাড়িতে আসবেন বলেছিলেন। পরে আর যাননি কখনও। শক্তিদা মারা যাওয়ার পর একটি পত্রিকায় ছবি বেরিয়েছিল। সেটি দেওয়ালে টাঙিয়ে বসে মদ খাচ্ছে। এই যে অলৌকিক স্বর্গীয় দৃশ্যপ্রায়, এগুলো কোথায় পাবে? এই মানুষটাকে কোথায় পাবে?

অর্ক – একটা মজার জিনিস দেখি। বারগুলিতে হ্যাপি আওয়ার বলে একটা জিনিস চালু থাকে। এটা কি তোমাদের সময়ও ছিল?

রাহুল – হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমাদের সময় আরও বেশি করে ছিল। দুপুরবেলা একটু সস্তা হয়ে যেত। তখন খাওয়া যেত আর কী। এই হ্যাপি আওয়ার নিয়ে অনেক মজার গল্প আছে। যখন ২৪ ঘণ্টায় ছিলাম, আমাদের অন্যতম ডিরেক্টর ছিলেন অভীক দত্ত, যিনি ‘গণশক্তি’র সম্পাদক হয়েছিলেন। আমি, অঞ্জন, সুদীপ্ত তো প্রায়ই দুপুরবেলা অফিস কেটে মদ খেতে যেতাম। কেউ ধরতে পারত না; বুঝতে পারত, কিন্তু মাতলামো করতাম না। গন্ধও পেত না, গন্ধ তাড়াবার জন্য বিভিন্ন জিনিসপত্র আমরা আবিষ্কার করেছিলাম। কিন্তু অভীক দত্ত খবর পেয়ে যেতেন। হাতে-নাতে ধরেওছেন। কিন্তু আমরা তো নির্লজ্জ।

তা একদিন অভীকদা আমায় ফোন করলেন। বললেন যে, রাহুল একটা ডকুমেন্টারি তৈরি করো তো। বললাম, কীসের ওপর? “এই দুপুরবেলা পানশালাগুলোতে কি একটা আওয়ার তোলে না!” আমি বললাম, কী আওয়ার? “সে কী! তুমি জানো না? হ্যাপি আওয়ার না কী একটা বলে না?” বললাম, হ্যাঁ হ্যাপি আওয়ার চলে। তখন বলছেন, “ওখানেই তো তোমরা যাও, নাকি?” (হেসে) তখন বুঝতে পারলাম, ধরার জন্য ওই হ্যাপি আওয়ারের জালটা বিস্তার করেছেন। আমাদের সময় অফিসপাড়াতে এটা খুব বেশি ছিল।

অর্ক – আচ্ছা, মফসসলের বারগুলোর কথা যদি একটু বলো? মানে, তুমি বেলঘড়িয়ার লোক। সাবেক কলকাতা বাদ দিলে, তোমার চারদিকের…

রাহুল – আমার এক বন্ধু আছেন, খুব বড় অভিনেতা। সুপ্রিয় দত্ত। নেশাটা যেন ওঁর প্যাশন। শ্যামবাজার থেকে ব্যারাকপুর, কল্যাণী অবধি প্রত্যেকটা বারে ওঁর ফ্যান ক্লাব আছে। মানে, যে কোনও বারে যদি গিয়ে বলি, "আমি সুপ্রিয়র বন্ধু", বিনা পয়সায় মদ খেয়ে আসা যাবে। এতটাই ভালোবাসে ওঁকে। ওঁর সঙ্গে এরকম বেশ কিছু বারে গিয়েছি। এখানে একটা জিনিসই হয়, বারো মাসের খরিদ্দাররা আসেন। রেগুলার কাস্টমার। মদ, খাবার দেয় যে ছেলেটি, তাঁর বোনের বিয়েতে আমরা গিয়েছিলাম। খেয়ে এসেছি। সম্পর্কটা এখানে গিয়ে দাঁড়ায় আর কী।

আরেকটা জিনিস হল, কলকাতা শহরের পথঘাট। সেগুলোও একটা বড় বড় বার। মদের দোকান বলছি না, সেটা ছাড়াও… মদ খাওয়া তো শারীরিক অত্যাচার। যদি জিজ্ঞেস করো, খেয়ে কী হল? আমার মনে হয়, খেয়ে বন্ধু পেলাম… বিভিন্ন ধরনের বন্ধু। তাঁদের একজনের কথা বলি – উতু। উত্তম ঘোষ। এই চিড়িয়ামোড়ে রাতে একজন মদ বিক্রি করত। উতু তাঁর সঙ্গে ব্যবসা করত। আমরা রাতে অফিস থেকে বেরনোর আগে বলতাম, উতু মদ দরকার। ও শুনে মদ টদ সাজিয়ে রেখে দিত। উতুর ছেলে পড়াশোনায় খুব ভালো, এখন সে ভাবায় চাকরি করে। সেই উতু পরে অন্য ব্যবসায় বসে, দোকান দেয়। কিন্তু ওঁর সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি হল আমাদের। সেটা এতই গভীর যে, বছর দু’য়েক আগে যখন অসুস্থ হয়ে পড়ি, উতু ব্যাগে করে চার লক্ষ টাকা নিয়ে আমার বাড়িতে আসে। বলে, এই টাকা আপনার চিকিৎসার জন্য। আমার বাড়ির লোকজনকে বলে, কোনও চিন্তা করবেন না। যখন প্রয়োজন হবে, আমি খরচ করব। দাদার যাতে চিকিৎসায় কোনও সমস্যা না হয়।

আমি টাকাটা নিইনি। কিন্তু এই যে একজন বন্ধুকে পাওয়া, এটা একটা বিরাট ব্যাপার। এগুলো রাস্তার পানশালা আমায় দিয়েছে। এই মানুষগুলো না থাকলে আমার লেখাই হতো না। তাঁদের কথা হয়তো স্পষ্ট করে নেই, কিন্তু চিহ্নগুলো রয়ে গিয়েছে। একটা শব্দ দিয়েছে, বা লাইন দিয়েছে।

অর্ক – তার মানে এই পানশালার জীবনটা নিয়ে তোমার কোনও অনুশোচনা নেই…

রাহুল – না না… আমি মন থেকে মিস করি। খুব মিস করি। পানশালা বলতে কোনও বার বলছি না, তামাম কলকাতাকে বলছি। রাস্তার মতো পানশালা নেই কোথাও। সেখানে আরাম করে খাচ্ছ… জয়দেব একটা বার করেছিল রাস্তায়, রবীন্দ্র সদনের উল্টোদিকের ফুটপাতে। বেশ রমরমিয়েই চলত। নাম ছিল রোডসাইড ক্লাব, আরএস ক্লাব। সেখানে কবি, লেখক, পুলিশ, পুলিশের খোচর সবাই আসত। এছাড়াও অলীক দাস, আমাদের বন্ধু, পেইন্টার ছিল। আমাদের প্রিয় জায়গা ছিল রাস্তাঘাট। আমরা রাস্তা দিয়ে হাঁটতাম।

ভবানীপুরের দিকে সার্থক রায়চৌধুরী একটা বারে নিয়ে গেছিল। বার ঠিক নয়… একটা বাড়ির উঠোনে বেঞ্চ পাতা, সেখানে মদ খাওয়ার জায়গা। ওখানে মদ খেতে বসেছি, তার ঠিক উল্টোদিকে লাল আর সবুজ দু’খানা বাল্ব। এক মহিলা ওখানে খাবার দেন। সবুজ বাল্ব জ্বলা মানে এবার পুলিশ আসছে। লাল বাল্বটার মানে, চলে এসেছে। সুইচ রাস্তার মোড়ে রাখা। সেখানে লোক ফিট করা আছে। পুলিস রেইড করলেই ওই বাতিগুলো সিগনাল। একেবারে কুটির শিল্প!

অর্ক – তোমার বন্ধু সোমক দাস। খুব সম্প্রতি আমরা তাঁকে হারালাম। তাঁর সঙ্গে মদ্যপানের স্মৃতি রয়েছে তো তোমার।

রাহুল – সোমকদা আমার ঠিক বন্ধু নন, পরিচিত ছিলেন। ওঁর সঙ্গে মদ খাওয়া মানে ঝুঁকিপূর্ণ। একবার আমরা মদ খাচ্ছিলাম। হঠাৎ সোমকদা বললেন, চলো রাহুল। আমার পিসতুতো বোনের বাড়ি যাব। ওখানে বসে মদ খাই। তো সেই পিসতুতো বোনের বাড়ি যেতে গিয়ে দেখা গেল, সোনাগাছিতে প্রবেশ করছি। আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে কোথায় একটা গেলেন। একটা মদ কিনে পকেটে রাখলাম। একটু পরে ফিরে এসে বললেন, নেই ও। বাড়ি তালা দেওয়া। কোথায় গিয়েছিলেন, কেউ জানে না। শরীর তখন টলছে। ওই অবস্থায় স্কুটারে আমাকে তুলে বললেন, চলো, চিৎপুর দিয়ে বেরোই। যেতে গিয়ে ট্রাম লাইনের উপর স্কুটার পড়ল। আমার পিছনে কাচ ফুটে গেল। সেই অবস্থায় ডানলপ পর্যন্ত এলাম। কখনও বাসের তলায় যাচ্ছি, কখনও গালাগাল খাচ্ছি... সোমকদা খুব বিপজ্জনকভাবে বাঁচত।

অর্ক – আর নবারুণ?

রাহুল – ওঁর সঙ্গে মদ খাওয়ার বিভিন্ন জায়গা ছিল। নবারুণদার সঙ্গে মদ খাওয়া বেশ ইন্টারেস্টিং। আমাদের একসময় একটা আড্ডা ছিল মানবদার বাড়িতে, মানবেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়। সেখানে নবারুণদা আর আমি আড্ডা মারতে যেতাম। সেখানে মদের ব্যবস্থা মোটামুটি নবারুণদাই করত। ওঁর বিভিন্ন ঠেক ছিল। নবারুণদার সঙ্গে আড্ডাটা খুব মিস করি এখন। মদ খেয়ে নবারুণদা কিছু গানও শুনিয়েছিল। খুব উচ্চমার্গের তা নয়, কিন্তু ওঁর লেখার মতোই গান।
একবার উত্তরপাড়াতে একবার কবিতা পড়তে গিয়েছিলাম। সেখানে নবারুণদা ছিলেন। তিনি "এটা পড়, ওটা পড়" করলেন… পরে আমরা গঙ্গার ধারে গিয়ে বসলাম। উনি প্যাকেট থেকে মদ বের করে বললেন, খা। শীতের সকাল, খাচ্ছি। তখন বললেন, শোন। লেখা তখনই টিকে থাকে, যখন তার মধ্যে রাজনীতি পাঞ্চ করা যায়। ওঁর সঙ্গে মদ্যপানের স্মৃতি হিসেবে এটা খুব জ্বলজ্বলে হয়ে আছে।

অর্ক – এক মফসসলের যুবক, রিফিউজি পরিবারে জন্ম। সে নিজের মতো করে বড় হচ্ছে, জীবনে নানারকম ঝুঁকি নিচ্ছে, নড়বড় করতে করতে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আর অসংখ্য মানুষের সঙ্গে মিশছে, মদ্যপানের আয়োজনগুলো সংযোগের বিভিন্ন সেতু হচ্ছে। সে ক্রমে প্রৌঢ় হচ্ছে, মদ তাকে ছেড়ে যাচ্ছে অনিবার্য কারণে। কিন্তু সে তার পিছনে তাকিয়ে মদকে কেন্দ্রে রেখে পৃথিবীটাকে ছুঁয়ে দেখতে চায়। এটা তো উপন্যাসের বিষয়। এটা কি উপন্যাস হয়ে
আসতে পারে?

রাহুল – আসতে পারে কখনও, আমি সেভাবে ভাবিনি। আসলে আমার কাছে তো জীবন্ত পৃথিবী এরা। জীবন্ত পৃথিবী মানে কবিতার পৃথিবী। উপন্যাস বা গল্পের পৃথিবী আমার কাছে জীবন্ত নয়। আমার লেখায় ছিল যে, “কাহিনিরা মৃত/ আর মৃতেরা কাহিনি লিখে যায়।” ফলে এই মানুষগুলো আমার কাছে খুব জীবন্ত। অনেকে নেই, মারা গিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে অনেক সময় আমি কথা বলি। তাঁরা আমায় স্বপ্নে দেখা দেন। যেমন মদ খাওয়ার সময় নবারুণদা উত্তেজিত হয়ে যেত। হাত-পা ছোঁড়া, অত্যন্ত নাটকীয়… লেখালেখি কিস্যু হচ্ছে না এসব বলত…

অর্ক – শুধু তো সাহিত্য নয়, নাটকের লোকজনের সঙ্গেও তো তুমি মদ্যপান করেছ। আমরা বোধহয় সেটা একটু বাদ দিয়ে যাচ্ছিলাম। সেটা না বললে আড্ডাটা শেষ হবে না। একটু নাটকের লোকের সঙ্গে মদ্যপানের অভিজ্ঞতা বলো।

রাহুল – এটা তো আলাদা কিছু নয়। নাটকের লোকজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মদ্যপান করেছি সুপ্রিয় দত্তর সঙ্গে। সুপ্রিয় নিজেই বেশ নাটকীয়… খুব ভালো ছাত্র ছিল। খুব ভালো গদ্য লেখে। এবং খুব ভালো মনের মানুষ।

আমি দেখেছি যে, যারা মদকে ভালোবাসে, তাঁরা খুব কম হারামি হয়। গান গাইবে, পাগলামো করবে, হয়তো একটু পয়সাও মেরে দেবে। কিন্তু ক্ষতিকারক নয়। আমার সবসময় মনে হয়, নেশা আসলে একটা ঘোর তৈরি করে। সেই ঘোর মানুষকে কোথাও তুলে আনে। নিচে নামায় না। নিচে নামে অন্যান্য পারিপার্শ্বিক কারণে। কিন্তু এই ঘোরটা মানুষকে ওপরে তোলে। যেখানে চারপাশ থেকে নিজেকে আলাদা করে দেখতে পারে। শূন্যতার মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করে। এই নেশা মানুষকে আবিষ্কারের সেই সুযোগটা করে দেয়। এটা একেবারে হাতে-কলমের অভিজ্ঞতা। তবে তার বিনিময়ে কিছু দিতে হয়। নেশাও তো চায়, মূলত ধ্বংস চায়। তুমি যে নেশা করে লিখছ, অভিনয় করছ বা ছবি আঁকছ… সেটা তোমার আয়ুর বিনিময়ে। নেশা খুব সৃষ্টিশীল একটা বিষয় বলে মনে হয়।

অর্ক – এই কথাটা কি রবিশঙ্কর বলের ক্ষেত্রেও খাটে?

রাহুল – কিছুটা। রবির লেখা পড়ে দেখবে, ওঁর লেখায় অদ্ভুত একটা ঘোর আছে। ওঁর ভাষায়, শব্দ ব্যবহারে। এগুলো নেশা করে বলে আমার মনে হয়। ধরো ‘দিবারাত্রির কাব্যে’-র ওই নাচের বর্ণনা, সেটা লিখতে গেলে নেশাগ্রস্ত হতে হয়। তা না হলে ওই বর্ণনা লেখা যায় বলে মনে হয় না। একসময় এমনও হতো, আমি লেখা পড়ে বলে দিতাম, উনি মদ্যপান করেন কিনা। নেশা করেই ঘোর হবে, এমন কোনও ব্যাপার না। নেশা না করেও অনেকের সেই ঘোর থাকে। লেখালেখির জন্য নেশা করিনি। আমি মদকে ভালোবেসেছিলাম। মদের মানুষজনকে আরও বেশি ভালোবেসেছিলাম। তাঁদের এখনও খুব আপন লোক বলে মনে হয়। এখনও যখন পানশালার সামনে দিয়ে যাই, মনে হয় একবার উঁকি মারি। আমার সন্তানের জন্মের পর তার বয়স তখন আট মাস কী এক বছর হবে। রাস্তা দিয়ে আসার সময় গাড়ি থামিয়ে ওকে কোলে করে নিয়ে হক সাহেবকে দেখিয়ে আনলাম। মনে হল, নিজের সন্তানকে আত্মীয়ের কাছে আনলাম। এই যে অনুভূতি… এই সম্পর্ক… সেটা পানশালা আমাকে দিয়েছে। সেজন্য ওই লোকগুলোকে ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করি।

More Articles