২৬,০০০ চাকরি বাতিলের ধাক্কা! বন্ধ হবে রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলি?
SSC Recruitment Verdict: অর্জুনপুর হাই স্কুলের ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা দশ হাজারের কাছাকাছি। এমনিতেই ২০০-র উপর শিক্ষক-শিক্ষিকা থাকার কথা। ছিল মাত্র ৬৭ জন। তাঁদের ৩৬ জনের চাকরি বাতিল হয়েছে।
৩ এপ্রিল, ২০২৫! পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাসে কালো দিন। শীর্ষ আদালতের নির্দেশে বাতিল হয়ে গেছে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর নিয়োগ। এই রায় শুধু সংখ্যাতত্ত্বের নিরিখে বিশাল নয়, এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে রাজ্যের শিক্ষায় এবং সমাজে। এটি একটি মানবিক বিপর্যয়, যা রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। আদালতের এই রায় নিঃসন্দেহে দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে এক কঠোর পদক্ষেপ কিন্তু এর পাশাপাশি বহু যোগ্য ও নিরপরাধ শিক্ষকের জীবনকেও অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থার মূল স্তম্ভ সরকার পোষিত মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলি। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে স্থানীয় ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে এই স্কুলগুলিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতো, যেখানে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব ছিল নিয়োগের প্রধান মাপকাঠি। এই সময় স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধি ও আপগ্রেডেশনের ফলে নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হলেও, নিয়োগে স্বজনপোষণ নিয়ে দলের অন্দরে অসন্তোষ দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যে তৈরি হয় স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)। গোটা রাজ্যকে চারটি অঞ্চলে ভাগ করে নিয়োগ শুরু হয়। বাম জমানায় বিচ্ছিন্ন কিছু অভিযোগ উঠলেও, সাধারণভাবে প্রতি বছর এই নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছতার সঙ্গেই সম্পন্ন হতো। এটি ছিল বাম সরকারের এক উল্লেখযোগ্য সাফল্য এবং শিক্ষিত যুবসমাজের কাছে চাকরির এক বিশেষ পছন্দের জায়গা।
২০১১ সালে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্থায়ী নিয়োগের ক্ষেত্রে এক অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেছিলেন যে, এসএসসি দুর্গাপুজো নয় যে প্রতি বছর আয়োজন করতে হবে। তৃণমূল আমলে এসএসসি ও প্রাথমিকের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়মিত হয়নি এবং যেটুকু হয়েছে, তাতে চূড়ান্ত দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
আরও পড়ুন- ২৬ হাজার চাকরি বাতিলই! বিধানসভা নির্বাচনে অশনি সংকেত হবে শিক্ষকদের কান্না?
এবার যে প্যানেলটি বাতিল হলো, তার বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছিল ২০১৬ সালে এবং নিয়োগ হয় ২০১৯ সালে। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের একসঙ্গে নিয়োগ এই প্যানেলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল। তবে শুরু থেকেই এই নিয়োগ নিয়ে একাধিক অভিযোগ উঠতে থাকে। এলাকায় শাসকদল ঘনিষ্ঠ দালালরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর ঘনিষ্ঠ আধিকারিকদের চক্র, শাসকদলের ছোট-বড় নেতা এবং এসএসসি আধিকারিকরা এই দুর্নীতিতে সরাসরি জড়িত ছিলেন। পরীক্ষার তিন বছর পর নিয়োগ আসলে ছিল দুর্নীতির সুযোগকে প্রসারিত করার একটি কৌশল।
সিবিআই তদন্ত শুরু করলে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসতে থাকে। সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি পাওয়া, ওএমআর শিট কারচুপি, মেধা তালিকা পরিবর্তন এবং দুর্নীতিগ্রস্তদের চাকরি দেওয়ার জন্য মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার পর নতুন পদ সৃষ্টি – এই সবই ছিল দুর্নীতির নমুনা। তদন্ত চলাকালীন ইডির অভিযানে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবীর ফ্ল্যাট থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার এবং পরবর্তীতে এসএসসির একাধিক কর্মকর্তার গ্রেফতারি মামলাটিকে নতুন মাত্রা দেয়।
এই পরিস্থিতিতে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায়ে প্রথমবার পুরো প্যানেলটি বাতিল হয়। তবে এই রায় বহু বিতর্কের জন্ম দেয়। ন্যাচারাল জাস্টিসের মূল নীতি হলো, একজনও নিরপরাধের শাস্তি হওয়া উচিত নয়। এই প্যানেলের একটি অংশ দুর্নীতিগ্রস্ত হলেও, বহু যোগ্য প্রার্থী তাঁদের মেধার ভিত্তিতে চাকরি পেয়েছিলেন। তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের দায়িত্ব ছিল অযোগ্যদের চিহ্নিত করা এবং দুর্নীতি চক্রের মূল পাণ্ডাদের গ্রেফতার করে কঠোর শাস্তি দেওয়া। কিন্তু আদতে তা হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে শিক্ষকরা সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন। এই পর্যায়ে এসএসসি ও রাজ্য সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু তারা কোনও সহযোগিতা করেনি, এমনকী কতজন অযোগ্য তা নিশ্চিত করেনি। তবুও আদালতের শুনানির সময় অযোগ্যদের একটি তালিকা পেশ করা হয়েছিল। ৩ এপ্রিলের রায়ে বলা হয়েছে, যারা দুর্নীতিগ্রস্ত, তারা এতদিন ধরে পাওয়া টাকা ফেরত দিতে বাধ্য থাকবেন। কিন্তু যারা অভিযুক্ত নয়, অর্থাৎ সম্ভাব্য অযোগ্য তালিকায় নেই, তাদের টাকা ফেরত দিতে হবে না। এটিও এক ধরনের পৃথকীকরণ। তাহলে কি এদের যোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা যেত না? তবুও কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছেন যাঁরা অন্য সরকারি দফতর থেকে এসেছিলেন। তাঁরা সম্ভবত তাঁদের পুরনো চাকরিতে ফিরে যেতে পারবেন।
মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলনে প্রকৃত অর্থেই দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি দোষ চাপিয়ে দিয়েছেন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির ঘাড়ে কিন্তু যাদের জন্য এই বিপুল সংখ্যক মানুষ চাকরি হারালেন সেই দুর্নীতিবাজরা সম্ভবত পর্দার আড়ালেই থেকে যাবেন। আর যারা অভিযুক্ত নন, তাদের ভবিষ্যৎ কী? চাকরি হারানো জনৈক শিক্ষকের কথাতেই তা স্পষ্ট। তিনি বলছেন,
"সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আমার জীবনটা থমকে গেল। দীর্ঘ সাত বছর ধরে মানুষ গড়ার চেষ্টা করেছি। ভেবেছিলাম, এই শিক্ষকতা আমার ভবিষ্যৎ। কিন্তু আজ এক মুহূর্তে সব শেষ হয়ে গেল। বিনা অপরাধে আমাকে এই শাস্তি পেতে হচ্ছে। আমার একটা ছোট বাচ্চা আছে। তার মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। কী বলব তাকে?”
আরও পড়ুন- সন্দেহভাজন প্রার্থীদের তালিকা থাকা সত্ত্বেও কেন যোগ্য-অযোগ্যদের আলাদা করা গেল না?
দুর্নীতির বিরুদ্ধে আদালতের এই কঠোর অবস্থানকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। কিন্তু পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে, এই দুর্নীতিতে জড়িত মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের জন্য কেন হাজার হাজার যোগ্য ও নিরপরাধ শিক্ষক তাঁদের জীবন বিপন্ন করবেন? সরকারের উচিত ছিল শুরু থেকেই নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ রাখা এবং দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া। তা না করে দীর্ঘসূত্রিতা এবং উদাসীনতা পরিস্থিতিকে এই পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, এই বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকার কী পদক্ষেপ করবে? নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতেও সময় লাগবে। তবে সেই প্রক্রিয়া কতটা স্বচ্ছ হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। একইসঙ্গে, যে সমস্ত শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী চাকরি হারালেন, তাঁদের প্রতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখানো এবং তাঁদের পুনর্বাসনের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ করাও জরুরি।
সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের ফলে রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থায় এক বিশাল শূন্যতা তৈরি হলো। বহু স্কুলে শিক্ষকের অভাব দেখা দেবে, যার সরাসরি যার প্রভাব পড়বে পঠনপাঠনের উপর। দৃষ্টান্ত হিসাবে ফারাক্কার অর্জুনপুর হাই স্কুলের কথা বলা যেতে পারে। যাদের ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা দশ হাজারের কাছাকাছি। এমনিতেই ২০০-র উপর শিক্ষক-শিক্ষিকা থাকার কথা। ছিল মাত্র ৬৭ জন। তাঁদের ৩৬ জনের চাকরি বাতিল হয়েছে। স্কুলের পরিচালন সমিতির সভাপতি চিন্তিত, কীভাবে আগামী দিনে স্কুল চলবে। এ থেকে পরিষ্কার রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ এক গভীর অনিশ্চয়তার মুখে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সরকার, শিক্ষক সম্প্রদায়, আইনজীবী এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষকে একযোগে কাজ করতে হবে। দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া যেমন জরুরি, তেমনই এই সংকটের মানবিক দিকটির প্রতি সংবেদনশীল হওয়াও প্রয়োজন। অন্যথায়, এই অন্ধকার আরও গভীর হবে যার বিষাক্ত প্রভাব আগামী প্রজন্মকেও বহন করতে হবে।