সন্দেহভাজন প্রার্থীদের তালিকা থাকা সত্ত্বেও কেন যোগ্য-অযোগ্যদের আলাদা করা গেল না?
SSC Supreme Court Verdict: স্কুল সার্ভিস কমিশন নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলেও উত্তরপত্রের কোনও হার্ডকপি নিজেদের কাছে রাখেনি। ওএমআর শিটের মিরর ইমেজও এসএসসির সার্ভারে পাওয়া যায়নি।
হাইকোর্ট গতবছরই প্রায় ২৬ হাজার জনের চাকরি বাতিল করে দিয়েছিল। তৃণমূল সরকার সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে শীর্ষ আদালতে যায়। আদালত এসএসসির মামলার শুনানিকালে এই নিয়োগ বাতিলের উপর স্থগিতাদেশ জারি করে। তারপর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবারও চরম অনিশ্চয়তার মুখে বাংলার ২৬ হাজার শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মচারী। সুপ্রিম কোর্টে এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ২৫ হাজার ৭৫২ জনের চাকরিই বাতিল করে দিয়েছে। আর এই ২৬ হাজারের মধ্যে যারা কোনও দুর্নীতি না করে, ঘুষ না দিয়ে, সাদা খাতা জমা না দিয়ে নিজের যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের কী হবে? সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, এসএসসি নিয়োগে যে পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে, অনিয়ম হয়েছে তাতে যোগ্য আর অযোগ্য আলাদা করাই যাচ্ছে না। তাই সকলের চাকরিই বাতিল করা হয়েছে। ওএমআর শিটে পরীক্ষা দিয়েছেন প্রার্থীরা। ১০ বছর হতে চলল সেই নিয়োগের। এতদিন পরে হঠাৎ একদিন পায়ের তলা থেকে জমি সরে গেল যাঁদের, তাঁদের প্রশ্ন, চাকরি বাতিলের ক্ষেত্রে যোগ্য ও অযোগ্য নির্ধারিত করা আসলে কার দায়িত্ব ছিল? সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার তদন্ত করছিল সিবিআই। এতদিন ধরে কেন দুর্নীতিতে যুক্ত আর দুর্নীতি মুক্তদের আলাদা করাই গেল না?
শীর্ষ আদালত জানিয়েছে, যাঁদের চাকরি পাওয়ার ন্যায্যতা নিয়ে সন্দেহের যাবতীয় উপাদান মজুত রয়েছে, তাঁদের চার বছরের বেতনের টাকা ফেরত দিতে হবে। জানা যাচ্ছে এখনও অবধি এই সন্দেহের তালিকায় থাকা প্রার্থীদের সংখ্যা ৫,৪০০ জনের মতো। তাহলে প্রশ্ন উঠছে, একদিকে শীর্ষ আদালতই এই প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার প্রার্থীকে সন্দেহের তালিকায় রাখছে, তাহলে বাকি প্রায় ২০ হাজার মানুষের চাকরি গেল কেন? যদি সাদা খাতা জমা দেওয়া বা ঘুষ দিয়ে চাকরি পাওয়াদের মোটামুটি আন্দাজও পাওয়া গিয়ে থাকে, তাহলে সিবিআই কেন আরও কঠোর তদন্ত করে সেই তালিকা নিশ্চিত করতে পারল না? কেন সৎভাবে চাকরি পাওয়া মানুষদেরও বইতে হচ্ছে সেই অপরাধের ভার, যা তারা করেননি?
আইনজীবীদের একাংশের বক্তব্য, এভাবে সন্দেহভাজনদের তালিকা ধরে যোগ্য প্রার্থী বা দুর্নীতিগ্রস্ত প্রার্থীদের ভাগাভাগি করা সম্ভব নয়। সূত্রের খবর, তিনটি বিভাগ থেকে এই সন্দেহভাজন প্রার্থীদের চিহ্নিত করা হয়েছে।
১) প্যানেলের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর যাঁরা চাকরি পেয়েছেন,
২) তালিকা বহির্ভূত প্রার্থী যাঁরা চাকরি পেয়েছেন,
৩) সিবিআইয়ের উদ্ধার করা ওএমআর শিটে যাঁদের নম্বর বাড়ানো হয়েছে।
আরও পড়ুন- ২৬ হাজার চাকরি বাতিলই! বিধানসভা নির্বাচনে অশনি সংকেত হবে শিক্ষকদের কান্না?
তাহলে এই ওএমআর শিট মিলিয়ে, যাদের নম্বর বাড়ানো হয়েছে তাদের নিশ্চিতভাবে আলাদা করা যাচ্ছে না কেন? রাজনৈতিক ও আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর দায় পুরোটাই রাজ্য সরকারের। স্কুল সার্ভিস কমিশন নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলেও উত্তরপত্রের কোনও হার্ডকপি নিজেদের কাছে রাখেনি। নিয়োগ স্বচ্ছ রাখতে ওএমআর শিটের মিরর ইমেজ বা বলা যায় ট্রেসিং যত্ন করে রাখা দরকার। সেটিও এসএসসির সার্ভারে পাওয়া যায়নি। সিবিআই গাজিয়াবাদে নাইসার এক আধিকারিকের বাড়ি থেকে উদ্ধার করে কিছু মিরর ইমেজ। সেখানে জানা যায়, ০ পাওয়া প্রার্থীর নম্বর বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫৩! সুতরাং, কার নম্বর বেড়েছে, কার মিরর ট্রেসিং উধাও তা নিশ্চিত নয়। তাছাড়া ইন্টারভিউ, টাইপিং টেস্ট সবেতেই অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে সিবিআই। তাই এটুকু স্পষ্ট যে ওই ৫,৪০০ জনেই দুর্নীতি শেষ নয়। সংখ্যা আরও বেশি। সমস্ত ধরনের দুর্নীতির নির্দিষ্ট পরিসংখ্যানই পাওয়া যায়নি। ফলে সুপ্রিম কোর্ট যোগ্য আর অযোগ্যের ফারাক করতে পারেনি।
বলাই বাহুল্য, এই নিয়োগ বাতিলের বিষয়ে ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে সুপ্রিম কোর্টে বড় ধাক্কা খেয়েছে রাজ্যের তৃণমূল সরকার। তবে মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, এই রায় তিনি মেনে নিতে পারছেন না। যে সন্দেহভাজনদের নিয়ে আলোচনা হয়েছে আদালতে, সেই দুর্নীতিগ্রস্ত প্রার্থীদের তালিকা বিষয়ে মমতা বলছেন, "যাদের ‘Tainted’ বলা হচ্ছে, আমাদের কাছে কোনও তথ্য নেই। আমাদের পড়তে দিলে না হয় খুঁজে বের করতাম। ভুলে যাবেন না, এঁরা সবাই স্কুলে পড়ান। স্কুলগুলির কী হবে, শিক্ষাব্যবস্থাকে ভেঙে দেওয়াই কি বিজেপি-র লক্ষ্য? বাংলাকে আর কত নিশানা করবেন?”
নিজের চেনা পিচ থেকে বেরিয়ে ব্যাটিং করতেই চাননি মুখ্যমন্ত্রী। চেনা ভঙ্গিতেই বিজেপি-সিপিএমকে নিশানা করেছেন। আর আবারও, শিক্ষকদের চরমতম এই দুর্দিনে দাঁড়িয়ে, প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন! মমতা বলছেন, "এখনও ১ লক্ষ শূন্যপদ রয়েছে। এই মামলার জন্য করতে পারছিলাম না। আগে এটার সমাধান হোক। হাতে আরও ১ লক্ষ আছে। রায় মেনে SSC সিদ্ধান্ত নেবে।" যে চাকরি গেল, সেই পরীক্ষা আবার কীভাবে হবে, কী পরিকল্পনা হচ্ছে, সেই নিয়ে কোনও শব্দ উচ্চারণ করেননি মমতা। উল্টে টেনে এনেছেন, মধ্যপ্রদেশের এক দুর্নীতির প্রসঙ্গ! মমতা বলছেন, "মধ্যপ্রদেশে ব্যাপমকাণ্ডে কী হয়েছে? ৫০ জনের বেশি লোক খুন হয়েছে। কী শাস্তি হয়েছে অপরাধীদের? আমাদের এখানে তো প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীকে সিবিআই জেলে রেখে দিয়েছে! আমরা তো কিছু বলিনি সেই নিয়ে! একই অপরাধীর কতবার শাস্তি হয়? একজনের অপরাধে কতজনের শাস্তি হয়? তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই এর মধ্যে দু'-চার জন আছে, যাদের ওরা টার্গেট করেছে। আমরা তদন্ত করে যদি বিশদ তথ্য পাই, নিশ্চয়ই করব। SSC একটি স্বতন্ত্র সংস্থা। তাদের কাজে আমরা নাক গলাই না। আমরা রায় গ্রহণ করছি। ওরা তিন মাসের মধ্যে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বলেছে, করে দেব। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছি। শিক্ষামন্ত্রীকে বলেছি, SSC-কে আমাদের মনোভাব জানাতে। তারা কী করবে, তাদের সিদ্ধান্ত। তবে আমাদের অনুভূতি হল, তিন মাসের মধ্যে চাকরি বাতিল হওয়া ২৫ হাজার এবং সেই সময় যাঁরা আবেদন করেছিলেন, তাঁদের নিয়োগ প্রক্রিয়া যেন হয়ে যায়।"