কোন পাঁচ আইনজীবী সরকারের হয়ে লড়বেন SSC মামলায়? কোন কোন মামলায় সফল তাঁরা?

SSC Recruitment Scam: মমতা বলেছেন, চাকরিহারাদের হয়ে আদালতে লড়বে পাঁচজন বিশেষ আইনজীবীর প্যানেল। কারা থাকছেন এই প্যানেলে?

শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির জেরে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল হয়েছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেছেন চাকরিহারাদের একাংশ। নিজেদের একাধিক দাবি মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম থেকে আশ্বাস দিয়েছেন, “জীবন থাকতে কাউকে চাকরি হারাতে দেব না।” যাঁরা চাকরি হারিয়েছেন, তাঁদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, রাজ্য সরকার আবার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হবে। সুপ্রিম কোর্টে যদি প্রত্যাশিত ফল না আসে, তবে সরকার বিকল্প পাঁচটি পথ ভেবে রেখেছে। আর চাকরিহারাদের হয়ে আদালতে লড়বে পাঁচজন বিশেষ আইনজীবীর প্যানেল। কারা থাকছেন এই প্যানেলে? মমতা জানান, অভিষেক মনু সিংভি, কপিল সিব্বল, রাকেশ দ্বিবেদী, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রশান্ত ভূষণ রাজ্য সরকারের হয়ে যোগ্যদের সমর্থনে আইনি লড়াই চালাবেন। কেন এই পাঁচজনকে বেছে নিলেন মমতা? আইনজীবী হিসেবে কী কী উল্লেখযোগ্য মামলা লড়েছেন তাঁরা?

১. রাকেশ দ্বিবেদী

সিনিয়র অ্যাডভোকেট রাকেশ দ্বিবেদী ভারতের আইনজগতের একজন সুপরিচিত ও সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব। বহু হাইপ্রোফাইল মামলায় অংশগ্রহণ করেছেন। আইনি দক্ষতার জন্য সুপ্রিম কোর্ট ও বিভিন্ন হাইকোর্টে বিশেষভাবে স্বীকৃত তিনি। ‘কে. এস. পুট্টাস্বামী বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া’ মামলায় তিনি গুজরাত রাজ্যের পক্ষে সওয়াল করেন, যেখানে ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করে দেশের বিচারব্যবস্থায় একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এছাড়া তিনি ৩৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কিত মামলাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যা জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার প্রশ্নে আলোড়ন তুলেছিল।

রাকেশ দ্বিবেদীকে আদালত প্রায়শই amicus curiae হিসেবে নিয়োগ করে, যেমন ‘কৈলাশ বনাম নানহকু’ এবং ‘মনোজ নারুলা বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া’ মামলা। এসব ক্ষেত্রে তিনি আদালতের সহায়ক হিসেবে জটিল সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক প্রশ্নে আলোকপাত করেন। এছাড়াও, নিজস্ব একটি মামলায় — ‘রাকেশ দ্বিবেদী বনাম সেন্ট্রাল পাবলিক ইনফরমেশন অফিসার, কোল ইন্ডিয়া’ — তিনি তথ্য অধিকার আইনের আওতায় নিজের পদোন্নতির তথ্য জানার জন্য আবেদন করেছিলেন, যা আইনি স্বচ্ছতার এক গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। এলাহাবাদ হাইকোর্ট ও লখনউ বেঞ্চেও তিনি বিশেষ পরামর্শদাতা হিসেবে নিয়মিত নিযুক্ত হন, যা তাঁর প্রজ্ঞা ও দক্ষতাকেই প্রমাণ করে।

আরও পড়ুন- “কারও চাকরি যাবে না”: এসএসসি-র চাকরিহারাদের উদ্দেশে যা বললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

২. কপিল সিব্বল

কপিল সিব্বল ভারতের অন্যতম বিশিষ্ট সিনিয়র অ্যাডভোকেট। তাঁর নাম রাজনীতির মঞ্চে যেমন প্রতিধ্বনিত হয়েছে, তেমনই দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বহু ঐতিহাসিক মামলার প্রেক্ষাপটেও গুরুত্বপূর্ণভাবে উচ্চারিত হয়েছে। তাঁর আইনি জীবন বহু দশকের এবং রাজনৈতিক, সাংবিধানিক ও সামাজিক গুরুত্বসম্পন্ন মামলায় তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি তাঁকে ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী আইনজীবী হিসেবে বিখ্যাত করে তুলেছে। রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ মামলা, ২জি স্পেকট্রাম দুর্নীতি মামলা, তিন তালাক মামলা এবং আধার সংক্রান্ত বিতর্ক— প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি গুরুত্বপূর্ণ পক্ষের হয়ে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন এবং আদালতের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন।

সম্প্রতি, ৩৭০ ধারা বিলোপ মামলায় তিনি সংবিধানিক যুক্তির উপর ভিত্তি করে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। একইসঙ্গে, কলকাতার আরজি কর মেডিকেল কলেজে চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষে তিনি সুপ্রিম কোর্টে সওয়াল করেন, যা রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এই মামলায় তদন্তের গ্রহণযোগ্যতা এবং আদালতের প্রক্রিয়ার সরাসরি সম্প্রচারের প্রশ্নেও তিনি আদালতে বক্তব্য রাখেন। এবারে তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হয়ে সুপ্রিম কোর্টে শিক্ষক নিয়োগ মামলায় সওয়াল করবেন।

৩. প্রশান্ত ভূষণ

প্রশান্ত ভূষণ ভারতের সুপ্রসিদ্ধ জনস্বার্থ আইনজীবীদের মধ্যে অন্যতম, যিনি সুপ্রিম কোর্টে দীর্ঘদিন ধরে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, স্বচ্ছতা ও নাগরিক অধিকারের পক্ষে লড়ে চলেছেন। তাঁর আইনজীবী জীবনের মূল কেন্দ্রবিন্দু পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন বা জনস্বার্থ মামলা, যার মাধ্যমে তিনি একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আদালতের নজরে এনেছেন। নির্বাচনী বন্ড মামলায় তিনি রাজনৈতিক অর্থায়নের স্বচ্ছতার পক্ষে তীব্রভাবে সওয়াল করেন, রাজনৈতিক দলগুলির তহবিল সংগ্রহের উৎস জনসমক্ষে প্রকাশ করার দাবি তোলেন তিনি। পাশাপাশি, ২জি স্পেকট্রাম ও কয়লা ব্লক বরাদ্দ কেলেঙ্কারি মামলায় তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ, যা পরবর্তীতে নীতিগত বিচার এবং দুর্নীতির তদন্তে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

তিনি ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিয়ে মামলা (পুট্টাস্বামী মামলা), তিন তালাক মামলা (শায়রা বানু কেস) এবং হিজাব নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কর্ণাটক হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মুসলিম ছাত্রদের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। পরিবেশ ও মানবাধিকার ইস্যুতে তাঁর অবস্থান সুস্পষ্ট—নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন, ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনা এবং কুডানকুলাম পারমাণবিক প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী গোষ্ঠীর হয়ে তিনি সওয়াল করেছেন। এছাড়া ইভিএমের স্বচ্ছতা, বিচার বিভাগের ওপরে তথ্য জানার অধিকার (RTI) এবং বিচারপতিদের জবাবদিহিতা নিয়েও তিনি স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন। ২০২০ সালে সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনামূলক টুইটের কারণে আদালত তাঁকে অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে, যদিও নামমাত্র এক টাকার জরিমানা ধার্য করা হয়।

প্রশান্ত ভূষণের আইনি কর্মকাণ্ডে শিল্পায়ন ও জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত মামলাও এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ২০১৬ সালে টাটা মোটরস সংক্রান্ত জমি অধিগ্রহণ মামলায় তিনি একটি বিশেষ ছাড়পত্র (Special Leave Petition) সংক্রান্ত মামলায় আবেদনকারীর পক্ষে সুপ্রিম কোর্টে সওয়াল করেন। এই মামলা ছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক সিঙ্গুরে টাটা মোটরসের কারখানার জন্য কৃষিজমি অধিগ্রহণকে ঘিরে। যদিও তিনি সরাসরি রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেননি, তবে তাঁর যুক্তি ছিল জমি অধিগ্রহণের পদ্ধতি ও কৃষকদের অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে।

আরও পড়ুন- ভারতীয় মুসলিমকে ‘পাকিস্তানি’ বলা কি আইনের চোখে অপরাধ?

৪. কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় একজন অভিজ্ঞ আইনজীবী এবং দীর্ঘদিন ধরে কলকাতা হাই কোর্টে আইনচর্চা করে আসছেন। ১৯৮১ সাল থেকে তাঁর আইনজীবী জীবন শুরু হয়। পরবর্তীকালে তিনি রাজনীতির মঞ্চেও সক্রিয় হন, শ্রীরামপুরের সাংসদ হন, তবে তাঁর পেশাগত পরিচয় আইনজীবী হিসেবেই দৃঢ়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষে তিনি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মামলায় সওয়াল করেছেন, বিশেষ করে রাজ্য রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সংবেদনশীল মামলায়। তাঁর আইনি দক্ষতা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা— এই দুইয়ের সংমিশ্রণ তাঁকে তৃণমূল কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ আইনগত মুখ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে যে ঘটনা ও আইনি বিতর্ক তৈরি হয়েছে, সেখানে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি কলকাতা হাই কোর্টে রাজ্য সরকারের পক্ষে সওয়াল করে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে নিরাপত্তা পরিস্থিতির বিপর্যয়, শৃঙ্খলার অভাব এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার কথা তুলে ধরেন। মন্ত্রী ব্রাত্য বসুর বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনকালীন ঘটনার প্রসঙ্গও তিনি আদালতের সামনে আনেন এবং নিরাপত্তার ঘাটতির প্রশ্নে তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করেন। শিক্ষক নিয়োগ মামলায় তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অন্যতম একজন মুখ।

৫ অভিষেক মনু সিংভি

অভিষেক মনু সিংভি ভারতের সুপ্রিম কোর্টের অন্যতম বিশিষ্ট বরিষ্ঠ অ্যাডভোকেট, যিনি সংবিধানিক আইন, রাজনৈতিক বিতর্কমূলক মামলা এবং জটিল বাণিজ্যিক বিরোধে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। আধার মামলায় তিনি তথ্য সুরক্ষা এবং নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকারের পক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরেন। আদালত আধার আইনকে সাংবিধানিক বৈধতা দিলেও তার প্রয়োগে একাধিক সীমা নির্ধারণ করে, যার অনেকটাই সিংভির তত্ত্বসমূহের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। সাহারা-বিড়লা কেসে তিনি আদালতের যুক্তি দেন যে, শুধুমাত্র কাঁচা কাগজ বা ডায়েরিতে লেখা তথ্যকে ভিত্তি করে অপরাধমূলক তদন্ত শুরু করা যায় না— এই মামলাটি রাজনৈতিক দুর্নীতি এবং উচ্চ পর্যায়ে জবাবদিহির প্রশ্নে আইনগত আলোচনার কেন্দ্রে ছিল।

সম্প্রতি অভিষেক মনু সিংভি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ নিয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মামলায় সওয়াল করছেন। সন্দেশখালি ইস্যুতে রাজনৈতিক হিংসা এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার অভিযোগের ভিত্তিতে তিনি রাজ্য সরকারের হয়ে সুপ্রিম কোর্টে সওয়াল করেন। কলকাতা হাই কোর্টের সিবিআই তদন্তের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে তিনি যুক্তি দেন যে, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার অধিকার ও ক্ষমতা রাজ্যের হাতেই থাকা উচিত। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ED) মামলা এবং তাঁর গ্রেফতারের পরবর্তী পর্যায়ে, সিংভি তাঁর অন্তর্বর্তী জামিনের জন্য মূল আইনগত সওয়াল করেন, যা জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক ও আইনি বিতর্ক তৈরি করে। পাশাপাশি, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার ও তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যান্য মামলাতেও তিনি নিয়মিতভাবে প্রতিনিধিত্ব করছেন।

More Articles