বঙ্গেশ্বরদের দিনযাপন অথবা পাহাড়তলীর সেই বাড়ি
১) দুআনা সের বেগুন কিনে
মন হল প্রফুল্ল‚
বাড়িতে এসে কেটে দেখি
একি! কানা অতুল্য।
২) ইন্দিরা মাসি বাজায় কাঁসি,
প্রফুল্ল বাজায় ঢোল।
আয় অতুল্য খাবি আয়,
কানা বেগুনের ঝোল।
৩) মাছের শত্রু কচুরিপানা‚
দেশের শত্রু অতুল্য কানা।
সাক্ষর সেনগুপ্ত: এই তিনটে ছড়া ষাটের দশকের শেষদিকে বিশেষত ১৯৬৬-৬৭ সালে সারা বাংলা জুড়ে দেওয়ালে লিখে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল! শুধু তাই না‚ তখন লাইট পোস্টের মাথায়-মাথায় কানা বেগুন ঝুলিয়ে রাখা হতো প্রায়-অন্ধ অতুল্য ঘোষের প্রতি ইঙ্গিত করে ! তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রসের সর্বময় কর্তা অতুল্যবাবুকে 'বঙ্গেশ্বর' বলেও বিদ্রুপ করা হত।
অতুল্য ঘোষের একটা চোখ কেন নষ্ট হয়েছিল, সেটা জানার কোনও দরকার আছে বলে সেদিন বিরোধীদের মনেই হয়নি। কিন্তু কালের নিয়মে হয়তো একজন বাঙালি বা ভারতীয় হিসাবে প্রায়শ্চিত্যের তাগিদেই ফিরে দেখা দরকার। ব্রিটিশ যুগের স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন অতুল্য ঘোষ। ১৯৪২-এ “ভারত ছাড়ো” আন্দোলনের সময় তাঁকে গ্রেফতার করে পাঠানো হয় মেদিনীপুর জেলে। জেলের ভেতরেই এক অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। পুলিশ লাঠিচার্জ করে। লাঠিচার্জের সময়ে, পি কিড নামে এক ইংরেজ অফিসার তাঁর হাতের লাঠি অতুল্য ঘোষের চোখে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। পরে অনেক চিকিৎসা করেও একটি চোখ রক্ষা করা যায়নি। সেবারই জেলে তাঁর স্পাইনাল টিউবারকলোসিস রোগ ধরা পড়ে। কিন্তু জেলের ইংরেজ চিকিৎসক তাঁকে ভুল ওষুধ দেওয়ায় অবস্থার অবনতি হয়। আর একবার জেলেই বন্দিদের উপর অত্যাচারের সময় তাঁর ঘাড় থেকে কোমর পর্যন্ত হাড় ভেঙে দেওয়া হয়। যার ফলে তাঁকে আজীবন খুঁড়িয়ে চলতে হয়েছে এবং শরীরের পিছনের দিকে তাঁকে লোহার খাঁচা জাতীয় একটি সরঞ্জাম বেঁধে থাকতে হয়েছে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর অতুল্যবাবুর চিকিৎসার ভার নিয়েছিলেন প্রখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়।
কারও শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে খোঁটা দিয়ে ছড়া কেটে প্রচার করাটা নিশ্চয়ই খুব উঁচুদরের সংস্কৃতির পরিচায়ক ছিল না। বিশেষ করে সেই প্রতিবন্ধকতা যখন দেশকে স্বাধীন করার যুদ্ধের পুরস্কার হিসাবে অতুল্য ঘোষ পেয়েছিলেন। কিন্তু সে সময়কার বামপন্থীরা এসব কথা ধর্তব্যের মধ্যেই আনেননি। মন্তব্য রাজনৈতিক বিশ্লেষক জয়ন্ত চৌধুরীর।
অতুল্য ঘোষকে আক্রমণ করে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার লক্ষ্য নিয়ে সে সময়ে বহু নিন্দা-কুৎসার জন্ম দিয়েছিল বিরোধী দলগুলি। ষাটের দশকের মাঝামাঝি তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির তরফে প্রচার করা হল, কংগ্রেস সরকারকে ব্যবহার করে বর্তমান বিবাদি বাগের স্টিফেন হাউস নামের বাড়িটি মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেন এবং অতুল্য ঘোষ, এই দু’জনে মিলে কিনে নিয়েছেন। বিশিষ্ট সাংবাদিক মিহির গঙ্গোপাধ্যায় অনেক পরে তাঁর স্মৃতিচারণায় জানিয়েছেন, সাধারন মানুষ তো বটেই তাঁর বহু বন্ধুবান্ধবও এ কথা বিশ্বাস করেছিলেন! পরে অবশ্য তাঁদের ভুল ভেঙে গিয়েছিল এই দেখে যে, প্রফুল্ল সেন শেষ বয়সে কী দুঃসহ আর্থিক দুরবস্থায় ছিলেন! অশোককৃষ্ণ দত্ত তাঁর মিডলটন রোডের ফ্ল্যাটে প্রফুল্ল সেনকে শেষজীবনে থাকতে না দিলে, তাঁর থাকার জায়গাও ছিল না। প্রফুল্ল ঘোষ, অতুল্য ঘোষ, প্রফুল্লচন্দ্র সেন, অজয় মুখোপাধ্যায়ের মত নেতাদের ব্যক্তিগত জীবনে প্রায় কোনো স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তিই ছিল না। কিন্তু সেদিনের বিরোধীরা এঁদের একজনকেও কুৎসার মুখে দাঁড় করাতে দু’বার ভাবেননি।
অতুল্য ঘোষের বাঁকুড়া জেলায় একটি ছোট্ট বাড়ি ছিল। গ্রামের বাড়িতে যেমন হয়, এই বাড়ির সামনেও একটি পুকুর ছিল। দূরে দেখা যেত পাহাড়। বামপন্থী নেতা যতীন চক্রবর্তী সেদিন এর বর্ণনা দিয়েছিলেন, “আপনাদের বঙ্গেশ্বর অতুল্য ঘোষ বাঁকুড়ায় সুইমিং পুল করেছেন, বিরাট রাজপ্রাসাদ করেছেন। সেখানে ফুর্তি করেন। বলুন, সেই বঙ্গেশ্বর ও তাঁর দলের পাণ্ডাদের দিয়ে কি সরকার চলে ?” পরবর্তী কালে স্বচক্ষে বাঁকুড়ার দেওলাগড়ের সেই বাড়ি দেখে এসে যতীন চক্রবর্তী তাঁর ওই উক্তির জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। আন্তরিক অনুতপ্তও ছিলেন। নিজে উদ্যোগ নিয়ে হীড়বাঁধ থানার সুপুর গ্রাম থেকে দেওলাগড়ার ‘পাহাড়তলী’র এই বাড়িটি পর্যন্ত দীর্ঘ আট কিলোমিটার পাকা রাস্তা নির্মাণ করে দেন। বিধান শিশু উদ্যানেও যতীন চক্রবর্তীর নিয়মিত যাতায়াত ছিল।
কোথায় সেই পাহাড়তলী? খাতড়া শহর থেকেও যাওয়া যায়, আবার মুকুটমণিপুর কংসাবতী প্রকল্প দেখেও যেতে পারেন। কিছু দূর যাওয়ার পর নজরে পড়বে শাল-পলাশের বনের গায়ে ছোট ছোট জনপদ। দূরে ইতস্তত পাহাড়। শাল-পলাশের জঙ্গলকে দু’পাশে রেখে তাদের নিবিড় আত্মীয়তা আর সুশীতল আহ্বানে কখন যে দেওলাগড়া পৌঁছে গেছেন, টেরও পাবেন না। দেওলাগড়া গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়বে একটি বাড়ি, যেটি আশপাশের আর-পাঁচটা বাড়ির চেয়ে আলাদা। সবুজ বনস্পতির নিবিড় পাহারায় দাঁড়িয়ে আছে ‘পাহাড়তলী’ নামের এই বাড়িটি। গ্রামের মানুষদের কাছে ‘অতুল্যভবন’। অতুল্য ঘোষ তাঁর ‘কষ্টকল্পিত’ বইয়ে লিখেছেন, এই বাড়িটিকে ঐতিহাসিক করার নেপথ্যে ছিলেন বামপন্থী সাংসদ ভূপেশ গুপ্ত। তিনি রাজ্যসভায় এ বাড়ি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “বাড়িটি বিরাট। সরকারি বন বিভাগের বারো জন লোক ঐ বাড়িতে সব সময় কাজ করেন। আর ওঁর পুত্রবধু নাকি ওখানে বাস করেন।” পরে ভূপেশ গুপ্তর সঙ্গে দেখা হলে তিনি বলেছিলেন, “আমার পুত্রবধূ তো বটেই, সমগ্র পরিবার আপনার কাছে কৃ্তজ্ঞ। আপনার জন্যই কাগজ মারফত আমাদের নাম প্রচার পেল। আপনাকে এক দিন ভাল করে খাওয়াব।” এই রকম সরস প্রত্যুত্তরে অভ্যস্ত ছিলেন মানুষটি।
জাতীয় কংগ্রেসের জাতীয় স্তরের অনেক নেতাই এখানে কাটিয়ে গেছেন। মোরারজি দেশাই, কামরাজ, সঞ্জীব রেড্ডি, মোহনলাল সুখারিয়া, দেবকান্ত বড়ুয়া... কে না এসেছেন। ১৯৫৯-এ যখন কংসাবতী প্রকল্পের কাজ চলে, তখন সেই প্রকল্পের কাজ পরিদর্শনে এলে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ও রাত্রিবাস করতেন এই বাড়িতে।
অতুল্য ঘোষের সাহিত্যপ্রীতি ছিল অত্যন্ত আন্তরিক। সাহিত্যানুরাগে ছুটে যেতেন কখনও শান্তিনিকেতন, তারাশঙ্করের লাভপুর অথবা কুমুদরঞ্জনের কোগ্রাম। প্রমথনাথ বিশী, গজেন্দ্রকুমার মিত্রর সঙ্গেও যথেষ্ট নিবিড় সম্পর্ক ছিল। দেওলাগড়ায় আসতেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সজনীকান্ত দাস, সুমথনাথ ঘোষ, শান্তিনিকেতনের সুরেন্দ্রনাথ কর প্রমুখ। চলত গল্প-কবিতা পাঠ, সঙ্গে লম্বা আড্ডা। দেওলাগড়ার বাড়িটির ‘পাহাড়তলী’ নামকরণ করেন স্বয়ং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। সজনীকান্তর পরিহাসপ্রিয়তা, সঙ্গে আলপিন ফোটানো শ্লেষ পাহাড়তলীর আড্ডাকে অন্য মাত্রা দিত। সেই আড্ডার গল্প বলেছেন অতুল্য ঘোষ। এক বার দেওলাগড়ার বাড়িতে এক আড্ডায় অতুল্য ঘোষ প্রশ্ন করেন সজনীকান্ত দাসকে। প্রশ্নটা ছিল তাঁর ‘কে জাগে’ কবিতাটি কি এলিয়টের রাপসডি অন আ উইন্ডি নাইট’ অবলম্বনে লেখা? সজনীকান্তর নির্বিকার উত্তর— ‘হতে পারে এলিয়ট আমার কবিতাটি পড়ে তাঁর ঐ কবিতাটি লিখেছেন।’ এই রকম নির্ভেজাল সাহিত্যিক আড্ডায় মশগুল থাকত ‘পাহাড়তলী’। সবাই চলে গেলে সঙ্গী হত এম এস শুভলক্ষ্মী, ডি কে রায় অথবা সুচিত্রা মিত্রর গ্রামোফোন রেকর্ড।
রাজনীতি শেষ পর্যন্ত তাঁর আশ্রয় হয়ে ওঠেনি। গত শতকের ষাটের দশকের একেবারে শেষ ভাগে রাজনীতি থেকে সরেই এসেছিলেন। শিশু আর বনভূমির কাছেই সঙ্গ চেয়েছিলেন। তিনি নেই, কিন্তু তাঁর স্নিগ্ধ আশ্রয় এখনও অটুট আছে। ‘পাহাড়তলী’র গাছগাছালি, পাখিদের কলকাকলি, কিছু মানুষের গাঢ় আতিথেয়তা আর শিশুদের কিচিরমিচিরে কোনও রাজনীতি নেই। এখনও প্রতি রবিবার এখানে ডাক্তারবাবুরা আসেন, পাঁচ-সাতখানা গ্রামের মানুষজন বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধপত্র পান। নানা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু বাড়িটা একটা নিছক বাড়ি হিসেবেই থাকেনি কোনও দিন, এখনও গ্রামবাংলার অন্দরে তাঁর এই বাসভবন আশপাশের প্রান্তিক মানুষদের বিশেষ ভরসার স্থল হিসেবে রয়ে গিয়েছে।
তথ্যসূত্র -
- কষ্টকল্পিত - অতুল্য ঘোষ
- অতুল্য ঘোষঃ এক নিঃসঙ্গ পান্থ
- আনন্দবাজার পত্রিকা - ২৯ আগস্ট, ২০১৯
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য প্রতিবেদকের নেওয়া