বৃদ্ধ বিমানেই কেন বারবার ভরসা রাখছে বামেরা?

নবীন প্রজন্মকে যখন নতুনভাবে লড়াইয়ের ময়দানে শামিল করছেন সেলিম। ঠিক সেইরকম সময়ে, একই সঙ্গে বিমানবাবুর মতো প্রবীণ প্রজন্মকেও লড়াইয়ের প্রত্যক্ষ ধারায় অংশীদার করে দল পরিচালনার ক্ষেত্রে এক অসাধারণ বাস্তববোধের পরিচয় সেল...


সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠকে তাঁদের দলের প্রবীণ নেতা বিমান বসুকে দলের রাজ্য কমিটির বিশেষ আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে আরও দুই প্রবীণ নেতা মৃদুল দে এবং অশোক ভট্টাচার্যকেও দলের রাজ্য কমিটির আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বামপন্থী রাজনীতিতে বিশেষ সম্মানিত বিমান বসু, তাঁদের দলের যাবতীয় পদ থেকে অব্যাহতি নিয়েছিলেন বয়সের কারণে। সিপিআই(এম) দলে বিভিন্ন কমিটিতে থাকার ক্ষেত্রে যে বয়সের মাপকাঠি আছে, অতীতে তা খুব কঠোরভাবে পালিত না হলেও, সাম্প্রতিক সময় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে, বয়সের মাপকাঠিকে মান্যতা দেওয়ার ক্ষেত্রে সিপিআই(এম) বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবেই সদ্য-প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক ড. সূর্যকান্ত মিশ্র বা প্রথম সারির নেতা রবীন দেব এখন আর ওই দলের রাজ্য কমিটিতে নেই।

বয়সের কারণে দলের শীর্ষ কমিটিতে থাকার বিষয়ে সিপিআই(এম) দলে সর্বপ্রথম সম্ভবত ব্যতিক্রমী অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন প্রয়াত জ্যোতি বসু।পরবর্তীতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও তাঁর শারীরিক অসুস্থতার কারণে নামসর্বস্বভাবে দলীয় কমিটিতে থাকেন নি ।নিজেকে দলীয় কমিটির বিভিন্ন পদ থেকে বিলুপ্ত করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন নেতৃত্বের কাছে ।নেতৃত্ব তাঁর অনুরোধকে যথাচিত মর্যাদা দিয়েছেন।

এই দিক থেকে দেখতে গেলে ৮৪ বছর অতিক্রান্ত বিমান বসুকে দলের রাজ্য কমিটিতে বিশেষ আমন্ত্রিত সদস্য এবং বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান হিসেবে পুনর্নির্বাচিত করবার সিদ্ধান্ত কেবল সিপিআই(এমস) দলের ক্ষেত্রেই কোনও অভিনব সিদ্ধান্ত নয়, বামপন্থী রাজনীতির ক্ষেত্রেই একটি ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত। বয়সে বিমানবাবু আশি-অতিক্রান্ত হলেও শারীরিকভাবে তিনি অত্যন্ত সক্রিয়। তাঁর শারীরিক সক্ষমতা, পরিশ্রম করার ক্ষমতার সঙ্গে যে কোনও যুবকের তুলনা করতে পারা যায়।

আরও পড়ুন: চন্দননগরে বামেদের জয় বঙ্গের রাজনীতিতে নতুন মোড়? যে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে

সেক্ষেত্রে বিমানবাবুকে ঘিরে সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহঃ সেলিম যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা অভিজ্ঞতাকে মূল্য দিয়ে, রাজ্য রাজনীতির প্রাঙ্গণে একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। বিমানবাবুর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন, অভিজ্ঞতা, কাজের ধরন, সততা- এই সমস্তকিছুর সমন্বয় নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক ধারা প্রবাহে যে একটা ব্যতিক্রমী স্রোত তৈরি করতে পারে।

বিমান বসু এমন একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি কংগ্রেস আমল দেখেছেন, দেখেছেন বামফ্রন্টের পুরো সময়কাল। আবার এখন দেখছেন বামফ্রন্টকে বিরোধী আসনে। বিমান বসু কখনওই সংসদীয় রাজনীতিতে আসেননি। শোনা যায়, একবার নাকি প্রমোদ দাশগুপ্ত তাঁকে বাঁকুড়ার কোনও একটি কেন্দ্র থেকে লোকসভাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। মানসিকভাবে খুব একটা সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত ছিলেন না বিমানবাবু।পরবর্তীকালে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছিলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত। অসামান্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী বিমানবাবু এমনই একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যিনি রাজনীতির শীর্ষবিন্দুতে থেকেও রাজ্যের প্রশাসনের সদর দপ্তর প্রায় এড়িয়ে গিয়েছেন। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি মহাকরণে গিয়েছিলেন কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। বিরোধী নেতা হিসেবে, বিরোধীদের বক্তব্য জানাতে তিনি নবান্নতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেন এখন। মাঠে-ঘাটে, জনপদে, জনপথে তাঁর অবাধ বিচরণ দলমত-নির্বিশেষে বিমানবাবুকে এক বিশেষ শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছে।

এইরকম এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে দলের রাজ্য কমিটির আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে নিয়ে এসে যে ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত সেলিম নিলেন, তা কেবল বাংলার রাজনীতিতেই নয়, ভারতের রাজনীতিতেই প্রবীণ কণ্ঠকে সম্মান জানানোর প্রশ্নে একটা বিশেষ দিক চিহ্ন হিসেবে স্থান পাবে। আজকের দিনের রাজনীতি যখন মূল্যবোধকে প্রায় জাদুঘরে ঠাঁই দিতে চলেছে, সেই সময়ে বিমান বসুর মতো ব্যক্তিত্ব, নিজের রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মূল্যবোধকে যে জায়গায় অবিচল নিষ্ঠার সঙ্গে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন, তা যাতে নিজেদের দলের আগামী প্রজন্মের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে মেলে ধরতে পারে, আশা করা যায়, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই বিমানবাবুকে দলের রাজ্য কমিটির বিশেষ আমন্ত্রিত সদস্য করার ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেলিম।

বিমানবাবুর অভিভাবকত্ব, তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা আর স্বচ্ছ, সৎ জীবনযাপন, পরিশ্রম করার মানসিকতা, এই ৮৪ বছরেও যে নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন- এসব কিছুই আগামী দিনের বামপন্থী রাজনীতির সর্বস্তরের সৈনিকদের যে নতুন করে লড়াইয়ের দিশা জোগাবে, সেই বিষয়ে একটি সঠিক দিক নির্দেশের লক্ষ‍্যেই সেলিম এই ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

কিছু ব্যতিক্রমী মানুষের ক্ষেত্রে বয়স যে কেবলমাত্র একটি সংখ্যা, বয়স যে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিতে কোনও অবস্থাতেই ছাপ ফেলতে পারে না, বিমান বসু সেটা বারবার দেখিয়েছেন। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নতুন করে সম্মান বা মর্যাদা দেওয়ার প্রশ্নে বিমানবাবুকে ঘিরে যে ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত সিপিআই(এম)-এর দলীয় নেতৃত্ব নিয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে আজকের টালমাটাল রাজনৈতিক দুনিয়ার ক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য অধ্যায় রচনা করবে।

বিরোধী দলের নেত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিকবার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বয়সকে উপহাস করে, "কমিউনিস্টরা দেহত্যাগ না করলে পদত্যাগ করে না" এইরকম নীতিহীন, ব্যক্তি-আক্রমণাত্মক কথাবার্তা বলেছিলেন। মমতার সেই অরাজনৈতিক, ব্যক্তিগত আক্রমণের যোগ্য জবাব জ্যোতিবাবু তাঁর রাজনৈতিক জীবন দিয়েই দেখিয়েছেন।

পরবর্তীকালে মমতা কিন্তু কখনওই তাঁর জ্যোতিবাবু সম্পর্কে ওই ধরনের অরাজনৈতিক মন্তব্য ঘিরে বিন্দুমাত্র দুঃখপ্রকাশ করেননি। মমতার ওই রাজনৈতিক মন্তব্য রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে একটা নেতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে রেখেছে, তা আগামী দিনে মমতাকেও যে উপহাস করবে না, সেকথা জোরের সঙ্গে বলা যায় না‌।

এইরকম একটা সময় বিমান বসুর রাজনৈতিক জীবনে যে পর্যায়ক্রমগুলি এসেছে, তার নিরিখে বলতে হয়, যেভাবে স্বেচ্ছায় দলীয় অনুরোধ উপেক্ষা করে তিনি দলের বিভিন্ন পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন, তা আজকের ভারতের রাজনীতিবিদদের প্রেক্ষিতে এক অনুকরণীয় সিদ্ধান্ত। রাজ্য কমিটিতে বিশেষ আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে বিমানবাবুর উপস্থিতি ঘিরে একটা কথা কিন্তু খুব জোরের সঙ্গে বলতে হয় যে,ওঁদের দলের দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী রাজ্য কমিটির সভায় বিমানবাবু পরামর্শ দিতে পারেন, বক্তৃতা দিতে পারেন। কিন্তু কোনও ভোটাধিকার তাঁর থাকবে না। অর্থাৎ তাঁর ভূমিকাটা হবে একজন অভিভাবকের।

নবীন প্রজন্মকে যখন নতুনভাবে লড়াইয়ের ময়দানে শামিল করছেন সেলিম। ঠিক সেইরকম সময়ে, একই সঙ্গে বিমানবাবুর মতো প্রবীণ প্রজন্মকেও লড়াইয়ের প্রত্যক্ষ ধারায় অংশীদার করে দল পরিচালনার ক্ষেত্রে এক অসাধারণ বাস্তববোধের পরিচয় সেলিম রাখলেন।

More Articles